উদ্ভট চেহারার ভাড়াটে

অলংকরণ: মাসুক হেলাল।

ঘরের মেঝেতে লাফালাফির শব্দে অন্য রুম থেকে ছুটে এসে দরজার সামনে ভ্যাবাচেকা খেয়ে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইলেন আহাদ আহমেদ। অনবরত লাফাচ্ছে তাঁর ১০ বছরের ছেলে ওহাব। ছেলেটা লাফ দিয়ে ১-২ হাত ওপরে উঠছে, আবার নামছে। সঙ্গে খিলখিল শব্দে হাসছে।
আহাদ আহমেদের বাসাটা মহসিন মঞ্জিলের দোতলায়। বিপরীত পাশে আরেকটি ফ্যামিলি বাসা। সেখানে স্বামী-স্ত্রী থাকেন এবং সারা দিন ওই বাসা থেকে ঝগড়ার শব্দ ভেসে আসে। মাঝেমধ্যে তিনি গিয়ে শাসিয়ে আসেন, যেন ঝগড়া না হয়। ওই বাসার পুরুষ লোকটি কিছুটা উদ্ভট টাইপের। জটলা পাকানো চুল, গোঁফে ছেয়ে গেছে মুখ, চেহারা কুচকুচে কালো রঙের।

নিচের তলায় আরও দুটি পরিবার থাকে। আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, অন্যদিন দ্বিতীয় তলায় শব্দ শুনে নিচতলার ভাড়াটেরা আসত। কিন্তু আজ আসছে না। কোনো সমস্যা হয়নি তো! ভাবছেন আহাদ আহমেদ।
ওহাব এখন আর লাফাচ্ছে না। পড়ার টেবিলে বসে পেনসিল দিয়ে ড্রয়িং করছে। আহাদ আহমেদ ভাবতে লাগলেন, তাহলে কি তিনি এতক্ষণ ভুল কিছু দেখেছেন? ছেলেকে লাফাতে দেখাটা কি মনের ভুল! কিছুই মিলছে না। মাথাব্যথা শুরু হয়েছে। নিঃশব্দে ধীরে ধীরে তিনি ওহাবের পেছনে গিয়ে দাঁড়ান। উঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করেন, কী আঁকছে। ভয়ে হকচকিয়ে গেলেন। এ যে তাঁর কৈশোরের ছবি স্কেচ করা, সঙ্গে ওহাবেরও। স্বপ্ন দেখছেন না তো!

হঠাৎ আজ সব আজব ব্যাপার ঘটে যাচ্ছে। ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে আহাদ আহমেদ জিগ্যেস করেন—
: এসব কী আঁকছ বাবা? এঁরা কারা?
: কী বলো বাবা! এঁদের তুমি চিনতে পারছ না? ওপরেরটা আমার আব্বুর স্কেচ, নিচেরটা তোমার ছেলে ওহাবের।
: আচ্ছা বাবা, তুমি আমার কৈশোরবেলার ছবি স্কেচ করলে কীভাবে?
: কী যে বলো বাবা! আমি কি স্কেচ করতে পারি নাকি? পেনসিল দিয়ে হাত ঘুরাচ্ছি তো কেমন যেন মানুষের প্রতিকৃতি হয়ে গেল। আর কে যেন আমার কানে ফিসফিসিয়ে বলল, ওপরের স্কেচটা তোমার বাবার এবং নিচেরটা তোমার। অট্টহাসিতে কথাটা বাতাসে মিলিয়ে গেল। আমি আশপাশে তাকিয়ে কাউকে দেখতে না পেয়ে ভয় পেয়ে গেলাম। তবু মনে কিছুটা সুখের সঞ্চার সৃষ্টি হলো। কৈশোরের আমার বাবাকে দেখতে পেলাম।

এসব শুনে আহাদ আহমেদের মাথায় যেন বাজ পড়ল।
: কী বলছ তুমি! এসব তুমি আঁকনি? তাহলে কে আঁকল? এ ঘরে তো আর কেউ আসেনি। শুধু আমি আর তোমার মা বাসায়। দরজাও ভেতর থেকে বন্ধ করা। তাহলে কে আসতে পারে? তুমি মিথ্যার আশ্রয় নিয়ো না, ওহাব।
: সত্যি বলছি বাবা, আমি ইচ্ছা করে এমন স্কেচ আঁকিনি। এভাবে যে মানুষের চিত্র এঁকে যাবে, কল্পনাও করিনি।
সমাধান না পেলেও আহাদ আহমেদ ভেবে নিলেন, ছোট মানুষ তাই হয়তো ভয়ে বলছে না। তবে ওহাব তো স্কেচ তেমন পারে না। এমন নিখুঁত স্কেচ বড় আর্টিস্ট ছাড়া আঁকা সম্ভব নয়। ছেলে ভয় পাবে ভেবে আর কিছু বলেননি।

এসব ভাবতে ভাবতে আহাদ আহমেদ ওয়াশরুমে গেলেন ফ্রেশ হতে। দরজা ভেতর থেকে লক করে ফ্রেশ হয়ে যেই না বের হবেন, তখনই ঘটল আরেক বিপদ। দরজা কোনোভাবেই খোলা যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে, বাইর থেকে কেউ দরজা লক করে দিয়েছে। অনেকক্ষণ টানাটানি করেও খুলতে ব্যর্থ হলেন। চিৎকার-ডাকাডাকি করেও কারও সাড়া পাওয়া গেল না। মনে হচ্ছে, গলার আওয়াজ বাইরে যাচ্ছে না। কখন যে অজ্ঞান হলেন, টেরও পাননি। জ্ঞান ফেরার পর নিজেকে আবিষ্কার করেন বিছানায়। একদৃষ্টিতে চেয়ে থাকেন স্ত্রী মিতালির দিকে। মুখ থেকে শব্দ বের হচ্ছে না।
ওহাবের বড় বোন মিলি ডাক্তার নিয়ে এলেন। তিনি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বললেন, ‘কিছু ওষুধ লিখে দিচ্ছি। এগুলো খেলে দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠবেন।’ ধীরে ধীরে কথা বলতে শুরু করেন আহাদ আহমেদ। হঠাৎ ওহাবকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন। ওনার দেখাদেখি স্ত্রী, ছেলেমেয়েও কাঁদতে লাগলেন। আশপাশের বাসার সবাই ছুটে এসে দেখে, তাঁরা সবাই একে অপরকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছেন। অথচ আগে এমন কখনো হয়নি।

পরিবেশ কিছুটা শান্ত হলে সবাইর জিজ্ঞাসা, ‘কী হয়েছে ভাইজান? এভাবে সবাই কাঁদছেন কেন?’ আহাদ আহমেদ সব ঘটনা শেয়ার করলেন। শুনে সবাই চমকে ওঠেন! ‘কী বলেন এসব ভাই! এগুলো আপনার মনের ভুল। ভুলে যান।’ ‘না রে ভাই, সত্যি ঘটনাই বলছি।’ সবার শেষে পাশের ফ্ল্যাটের উদ্ভট চেহারার লোকটার আগমন। তাকে দেখে ভয়ে জড়সড় হয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে ওহাব। অমনি আহাদ আহমেদের রক্তবমি শুরু হয়। উদ্ভট লোকটি একদৃষ্টিতে আহাদ আহমেদের দিকে তাকিয়ে আছেন। ঠোঁটে তাঁর বাঁকা হাসি। রক্তবমির পরিমাণ বাড়তে থাকে। আবারও শুরু হয় আহাজারি...