ভালো থেকো শৈশব ও কুয়াশার রাত

শীতের সকালের মিষ্টি রোদ গায়ে মেখে বাবার সঙ্গে স্কুলে যাচ্ছে শিশুটি। প্রতীকীছবি: হাসান মাহমুদ

নিশুতি রাত। চারপাশ নিঝুম নিস্তব্ধ। প্রচণ্ড শীত। ঘন কুয়াশায় ফ্যাকাশে হয়ে গেছে শেষ রাতের উজ্জ্বল চাঁদের আলো। শীতে রাত দীর্ঘ হয়। তা ছাড়া গ্রামে ঠান্ডার প্রকোপে ঘুমানো হতো সন্ধ্যার পরপরই। প্রায়ই ঘুম ভেঙে যেত রাত পোহানোর আগেই। হাড়কাঁপানো শীতে গুটিসুটি মেরে শুয়ে থাকা ছাড়া উপায় নেই। কান পেতে শুনতাম টিনের চালে টুপটাপ কুয়াশা পড়ার শব্দ। কতশত কথাই না ভাবতাম। মনের আঙিনায় উঁকি দিত কত অবান্তর প্রশ্ন। হঠাৎই ঝপ ঝপ শব্দে উড়াল দিত ডালে বসে থাকা রাতজাগা কোনো দাঁড়কাক। দূরে কোথাও ডেকে উঠত তেজি রতা মোরগ। মুহূর্তেই তার সঙ্গে সুর মিলিয়ে আওয়াজ তুলত এবাড়ি-ওবাড়ির ঘরকুনো মোরগ দল। মুরব্বিরা বলত, একটা নির্দিষ্ট সময়েই নাকি তারা ডেকে ওঠে প্রতিদিন। গ্রামে প্রচুর শীত পড়ে। শীতের প্রকোপে কাবু হয়ে যেত গৃহপালিত পশুরাও।

ফজরের আজান হলে যখন মা নামাজের জন্য উঠত, সোয়েটারটা কাঁথার ভেতর দিয়ে যেত। যাতে গরম হয়। উঠে মক্তবে যেতে হবে। সোয়েটার ঠান্ডা বলে কোনো অজুহাত পেশ করার সুযোগ নেই।
আস্তে আস্তে সকাল হয়ে যেত। অজপাড়াগাঁয়ে দেখা দিত সোনালি সূর্য। মিহি কুয়াশাকে ভেদ করে উজ্জ্বল কিরণ এসে পড়ত গাছের সবুজ পাতা ও ঘাসের ওপর। মুক্তাদানার মতো চকচক করত শিশির।

সকালে মক্তবে যাওয়ার আগে কিছু খাওয়া ছিল অলিখিত আইন। বেশির ভাগই বাড়ি থেকে খেয়ে যেতাম। ঘুম থেকে উঠতে দেরি হলে খেতে খেতেই চলে যেতাম মক্তবে।

একটা নীল সোয়েটার পরে মক্তবের ঘরের কোনায় দাঁড়িয়ে আছি। পায়ে খয়েরি রঙের বাটা স্যান্ডেল। পরনে টেইলার্সের দোকানে বানানো মোটা সুতি কাপড়ের হাফ প্যান্ট। মা আব্বুকে বলে সোয়েটারটা কিনিয়েছেন আমার জন্য। এই একটা সোয়েটারের কথাই খুব বেশি মনে পড়ে। এটা আমার সবচেয়ে পুরোনো স্মৃতি। এরও আগের বিক্ষিপ্ত কিছু স্মৃতি ছাড়া তেমন কিছু স্মরণ করতে পারছি না। সত্যি বলতে, সোয়েটারটা একদমই পছন্দ হয়নি। তবু বেশ কয়েকটা শীত পার করে দিয়েছি এটা পরে। কতজনের থেকেই যে তাদের কারুকার্যমণ্ডিত মনোমুগ্ধকর শীতবস্ত্রের দাম জিজ্ঞেস করেছি, তার হিসাব নেই। কিন্তু বাবা-মায়ের কাছে সেই দামের জ্যাকেট বা শীতবস্ত্র কেনার আবদার করার মতো সাহস আমার ছিল না। কালেভদ্রে উচ্চবাচ্য করলেও আমি ছিলাম নিরেট বোকাসোকা। সুবোধ বালক বলতে যা বোঝায়। মক্তবে আমরা গ্রুপ হয়ে পড়তাম। সুরা, কায়দা, আমপারা ও কোরআন শরিফ। সুরার গ্রুপ হলো একদমই ছোটদের। যারা হরফ চেনে না। শুধু মুখে মুখে ছোট ছোট সুরা পড়ে। মুখস্থ করে। এরপর একের পর এক ধাপ অনুযায়ী। প্রতি গ্রুপ আবার একাধিক ভাগে বিভক্ত। ক্বারি সাহেব সবাইকে ছুটির একটু আগমুহূর্তে একসঙ্গে মশকো করাতেন। আমরা ছুটির উন্মাদনায় চিৎকার করে পড়তে থাকতাম। মক্তবে যাওয়ার পর অনেকের সঙ্গেই পরিচয় হয়। ওরা অবসরে ঘুড়ি ওড়ায়, লাটিম ঘোরায়, মারবেল খেলে। আর আমি একা একা ঘরে বসেই খুঁটিনাটি করি। আস্তে আস্তে পরিচিতি বাড়তে থাকে। মক্তবের নিয়ম অনুযায়ী একটা সময় ধাপ পেরিয়ে কোরআন শরিফ হাতে নিই। ক্বারি সাহেব প্রথম সবক শুরু করেন। একত্রে সুর দিয়ে পড়ি।

সকালে রোদে বসে ভাত খাওয়াটা ছিল ভীষণ মজার। পান্তা, শুকনা মরিচ ভাজা আর কয়েক রকম ভর্তা। বিশেষ করে শিম ও শিমপাতা ভর্তার কথা খুব বেশি মনে পড়ে। নতুন ধনেপাতা দিয়ে বানানো। ধনের মতো ঘ্রাণযুক্ত আরেকটি পাতাও দেওয়া হতো। আমরা বলতাম বিলেতি ধনে।

আমাদের ধনেখেতটা এখন আর নেই। নদীতে ভেঙে গেছে। নেই শৈশব আর শৈশবের বাড়িঘরগুলোও। একবুক দীর্ঘশ্বাস ফেলে আকাশের দিকে তাকাই। মনে মনে বলি, ভালো থেকো শৈশব ও কুয়াশার রাত।

হাটহাজারী, চট্টগ্রাম