উঠানে বসে টিভি-সিডি দেখার দিনগুলো

একসঙ্গে সবাই মিলে টিভি দেখাফাইল ছবি

স্কুল বন্ধ হলেই দামামা বাজত নানাবাড়িতে বেড়াতে যাওয়ার। যদিও যাওয়াটা এত সহজ ছিল না। একে তো প্রত্যন্ত অঞ্চল, তার ওপর যাতায়াতব্যবস্থা খুবই বাজে। মাইল তিনেক পথ পায়ে হেঁটে পাড়ি দিতে হতো। যেই-না মামাদের কাঠের দোতলা বাড়িটা চক্ষুগোচর হতো, সব কষ্ট মিলিয়ে যেত নিমেষেই। হাঁটার গতি বেড়ে যেত, কখন এসে পৌঁছাব। হইহুল্লোড়, খেলাধুলার পর দিন শেষে আমাদের একটাই আবদার থাকত, একদিন রাতে টিভি-সিডি দেখব। সরাসরি সে কথা নানার কাছে বলার সাহস কারও ছিল না। ছোট মামা, ছোট খালার কাছে আবদার থাকলেও তাঁদের মাধ্যমে দিন চারেক সেই আবেদন ঘুরে বেড়াত নানুর কাছে। অতঃপর একদিন অনুমতি মিলেও যেত।

সিডি আনতে হতো ভাড়ায়, সেই সঙ্গে সিনেমাপ্রতিও আলাদা একটা চার্জ রাখা হতো। ক্যাসেটপ্রতি আলাদা চার্জ। এক রাতের জন্যই আনা হতো বেশির ভাগ সময়, কখনো দুই দিন। সিডির জন্য যেতে হয় ছয়-সাত কিলোমিটার দূরের বাজারে, তা-ও আবার পায়ে হেঁটে। গ্রামে বিদ্যুৎ না থাকায় টিভি, সিডি চালানোর একমাত্র উপায় ছিল বড় ব্যাটারি। জনাপাঁচেকের একটা ছোটখাটো দল বিকেলের দিকেই চলে যেত সিডি আনার জন্য। কেউ নিয়ে আসত সিডি আর কেউ ব্যাটারি। কাঁধে করে ব্যাটারি আনাটাই ছিল কষ্টের; কিন্তু সিনেমা দেখার জন্য তাঁদের কাছে এ কষ্ট যেন কোনো কষ্টই নয়।

সিডি আনার খবর সন্ধ্যারাতের মধ্যেই পুরো গ্রামে ছড়িয়ে পড়ত কীভাবে জানি। রাতের খাওয়াদাওয়া একটু আগেই সেরে ফেলত সবাই। সন্ধ্যার পর আস্তে আস্তে উঠানে মানুষ জমতে শুরু করে। সিনেমাকে লোকজন আঞ্চলিক ভাষায় ‘বই’ বলত। সবারই একটা আবদার, সামাজিক বই লাগাও। বউ-শাশুড়ির যুদ্ধ, সত্যের মৃত্যু নেই, বেদের মেয়ে জ্যোৎস্না, রূপবান, গুরুদক্ষিণা, বড় বউ, ছোট বউ ইত্যাদি কাহিনিনির্ভর সিনেমা ছিল তাদের পছন্দের তালিকায়।

একটা টেবিলের ওপর টিভি-সিডি রাখা হতো, আর সবাই নিচে বসে দেখত; ছোট-বড়, নারী-পুরুষ সবাই। নারীরা পানের বাটা নিয়ে বসত। কোনো বাড়তি কথা নেই, সবাই একদৃষ্টে টিভির দিকে মনযোগ দিত। সিনেমার গল্পে নিজেদের হারিয়ে ফেলত; সিনেমা দেখে হাসত, কাঁদত, আফসোস করত, ভিলেনকে তিরস্কার করত, শেষে মিল দেখে স্বস্তি পেত। তাদের আবেগ, অনুভূতি দেখে মনে হতো সিনেমাই যেন বাস্তব জীবনের প্রতিচ্ছবি।

নানা উৎসব, অনুষ্ঠানেও সিডি দেখানোর ব্যবস্থা থাকত তখনকার সময়ে। সবই চলত ভাড়ায়। একটা রমরমা ব্যবসা ছিল সিডির। বেশির ভাগ দেখতাম বিয়ের অনুষ্ঠানে। উঠানে রাতভর দেখানো হতো সিনেমা। অনেকেই সিনেমা দেখতে দেখতে সেখানেই ঘুমিয়ে যেত, পরবর্তী সময় যতটুকু মিস করেছে, তার জন্য আফসোসও করত। পরবর্তী সময় অন্যদের থেকে সেই গল্পটা শুনত যে কী হয়েছে।

বর্তমানে আমাদের সামনে কত সুযোগ সিনেমা দেখার। হাতের কাছেই সিনেমা, ভিন্ন রুচি, ভিন্ন মাত্রার। বড় পরিসরের কথা ভাবতে গেলে কত কত সিনেমাহল, স্টার সিনেপ্লেক্স গড়ে উঠেছে। কিন্তু চোখ বন্ধ করে সেই অতীতে ফিরে গেলে আমার কাছে ওই উঠানটাকেই সবচেয়ে সুন্দর সিনেপ্লেক্স মনে হয়।

নেত্রকোনা, ময়মনসিংহ