মেসির নেতা হয়ে ওঠা ও ম্যারাডোনার হতাশা

কোয়ার্টার ফাইনালে টাইব্রেকার জয়ের পর মেসি ও মার্তিনেজছবি: রয়টার্স

২০১৮ সালে রাশিয়া বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার ব্যর্থতার পর দেশটির কিংবদন্তি ডিয়েগো ম্যারাডোনা ফক্স স্পোর্টসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘সে মেসি যখন বার্সেলোনার জন্য খেলে। মেসি মেসি হয় যখন সে ওই জার্সিটি পরে এবং সে আর্জেন্টিনার জার্সি পরলে অন্য মেসি হয়ে যায়। সে অসাধারণ খেলোয়াড় হলেও নেতা নয়। যে ব্যক্তি একটি ম্যাচের আগে ২০ বার টয়লেটে যায়, তাকে নেতা বানানোর চেষ্টা করা সময় নষ্ট ছাড়া আর কিছু নয়।’

লিওনেল মেসির আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারকে দুটি ভাগে বিভক্ত করা যায়। ২০০৬ থেকে ২০১৮ সাল এবং ২০১৯ থেকে বর্তমান। প্রথম ভাগে জাতীয় দলের হয়ে তিনি চারটি আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টের ফাইনাল খেলেন এবং সব কটিতে পরাজিত হন। এর মধ্যে তিনটি কোপা আমেরিকা ফাইনাল এবং অন্যটি ২০১৪ সালের বিশ্বকাপ ফাইনাল। এই সময়ে চারটি বিশ্বকাপ খেললেও কখনোই নকআউট পর্বে গোল করতে পারেননি। অন্যদিকে একই সময়ে ক্লাব পর্যায়ে বার্সেলোনার হয়ে ব্যক্তিগত ও দলীয় সম্ভব্য সবকিছুই অর্জন করেছেন মেসি। এর মধ্যে পাঁচবার ফিফা বর্ষসেরা ফুটবলার এবং সমানসংখ্যক ব্যালন ডি’অর জয়ও রয়েছে।

ডিয়েগো ম্যারাডোনা ও লিওনেল মেসি—যখন আর্জেন্টিনার কোচ ছিলেন ম্যারাডোনা
ফাইল ছবি: রয়টার্স

২০১১ সালের আগস্ট মাস থেকে আর্জেন্টিনা ফুটবল দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন মেসি। এর পর থেকে বর্তমান পর্যন্ত সময়কেও দুই ভাগে ভাগ করা যায়। এর মধ্যে ২০১৮ সাল পর্যন্ত সময়টুকুর প্রতিচ্ছবি ডিয়েগো ম্যারাডোনার ওই মন্তব্য। খেলোয়াড় হিসেবে নিজেকে সর্বকালের সেরাদের একজন করতে পারলেও নেতা হিসেবে কখনোই আর্জেন্টাইনদের মন জয় করতে পারেননি এলএম১০। তা ছাড়া দেশটির জনগণ নেতা হিসেবে যেমন মানুষ চান, মেসি ঠিক তেমন নন। তিনি ব্যক্তি হিসেবে খুবই শান্ত স্বভাবের। অন্যদিকে তাঁর মেন্টর ম্যারাডোনা ছিলেন উগ্র স্বভাবের নেতা। যিনি খেলোয়াড় কিংবা কর্তৃপক্ষ—সবার কাছ থেকে নিজের দাবি আদায় করে নিতে পারতেন এবং আর্জেন্টাইনরা এমন নেতাই পছন্দ করেন।

তবে পরিস্থিতি পাল্টাতে শুরু করে ২০১৯ সাল থেকে। নিজে ভালো খেলার পাশাপাশি দলকেও সামনে থেকে নেতৃত্ব দিতে থাকেন। ফল এসে ধরা দেয় ২০২১ সালে কোপা আমেরিকায়। ফাইনালে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ব্রাজিলকে তাদেরই মাটিতে হারিয়ে প্রথমবারের মতো কোনো আন্তর্জাতিক শিরোপার স্বাদ পান লিওনেল মেসি। নিজে জিতেছেন টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ গোলদাতা এবং সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার। নেতা হিসেবে রেকর্ড সাতবারের ব্যালন ডি’অর জয়ীর প্রতি আর্জেন্টাইনদের দৃষ্টিভঙ্গিও বদলে যায়।

আর্জেন্টিনার হয়ে কোপা আমেরিকান জেতেন লিওনেল মেসি। সতীর্থদের নিয়ে ট্রফি হাতে তাঁর উদযাপন
ছবি: এএফপি

মারাকানায় ফাইনাল ম্যাচের আগে ড্রেসিংরুমে মেসির অনুপ্রেরণামূলক কিছু কথায় সম্পূর্ণ বদলে যায় দীর্ঘদিন আন্তর্জাতিক শিরোপা না জেতা দলটির খেলোয়াড়দের শারীরিক ভাষা। যার প্রতিফলন দেখা গেছে ওই ম্যাচে এবং পরবর্তী সময়ে লা ফিলাসিমিয়ায় ইতালির বিপক্ষে।

ঐতিহাসিক মারাকানায় ফাইনাল ম্যাচের আগে সতীর্থদের উদ্দেশে মেসি বলেছিলেন, ‘গত ৪৫ দিনের জন্য আমি সবাইকে ধন্যবাদ দিতে চাই। এটি ৪৫ দিনের পরিশ্রমের ফল, যেখানে আমরা ভ্রমণ, খাবার, হোটেল ও মাঠ—কোনো কিছু নিয়েই কোনো অভিযোগ করিনি। পরিবারকে দেখা ছাড়া ৪৫ দিন। এমিলিয়ানো মার্তিনেজ বাবা হয়েছে ৪৫ দিন হয়ে গেছে। কিন্তু এখনো নিজের সন্তানকে দেখতে পারেনি। কেন? কারণ, এই মুহূর্তটার জন্য।’

আর্জেন্টিনা অধিনায়ক লিওনেল মেসি
ছবি: এএফপি

করোনা মহামারির প্রাদুর্ভাবের কারণে ২০২১ সালের কোপা আমেরিকায় দর্শক উপস্থিতি ছিল না। টুর্নামেন্ট শুরুর সপ্তাহ দুই আগে থেকেই সবাই আইসোলেশনে ঢুকে যান। ফলে টুর্নামেন্ট শেষ হওয়া পর্যন্ত সবাইকে পরিবার থেকে দূরে থাকতে হয়েছে। ওই দিন মেসি আরও বলেন, ‘আমাদের একটি লক্ষ্য আছে এবং সেটা অর্জন করা থেকে আমরা মাত্র এক ধাপ দূরে। সবচেয়ে ভালো দিক হচ্ছে এটি এখন আমাদের হাতে। সুতরাং আমরা সেখানে (মাঠ) যাব এবং ট্রফি উঁচিয়ে ধরব। আমরা এটিকে আর্জেন্টিনায় নিয়ে যাব এবং পরিবার, বন্ধু এবং যারা আমাদের সমর্থন করেছে, তাদের সঙ্গে নিয়ে উপভোগ করব।’

আসরটির আয়োজক ছিল আর্জেন্টিনা। কিন্তু শেষ মুহূর্তে তারা আয়োজনে অস্বীকৃতি জানায়। সপ্তাহ দুই আগে ব্রাজিলকে আয়োজনের অনুমতি দেয় কনমেবল। তবে এটিকে সেভাবে দেখতে রাজি নন মেসি। সতীর্থদের উদ্দেশে আর্জেন্টাইন অধিনায়ক বলেন, ‘এই টুর্নামেন্টটি ব্রাজিলেই হওয়ার কথা এবং কেন সেটা কি জানেন? কারণ, সৃষ্টিকর্তা এখানে এটা নিয়ে এসেছেন, যেন মারাকানায় আমরা জিততে পারি। সুতরাং চলুন, আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে মাঠে যাই এবং ট্রফি জয় করি।’

কোয়ার্টার ফাইনালে হলুদ কার্ড দেখেছেন লিওনেল মেসি
রয়টার্স

তাঁর এই কথাগুলোই প্রমাণ করে নেতা হিসেবে তিনি কতটা বদলে গেছেন। চলমান কাতার বিশ্বকাপে তো সম্পূর্ণ ভিন্ন মেসিকে দেখা যাচ্ছে। তাঁর নেতৃত্ব ম্যারাডোনার কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। যিনি সতীর্থদের পক্ষে কথা বলেন, তাঁদের জন্য প্রতিপক্ষের সঙ্গে লড়াই করেন। এর ঝলক দেখা গেছে কোয়ার্টার ফাইনালে নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে ম্যাচে। অনেকেই বলছেন, মেসির এমন রুদ্রমূর্তি আগে কেউ কখনো দেখেনি! তারপর টাইব্রেকারে যখন দল জিতে যায়, সবাই মাঠের এক দিকে দৌড় দিলেও মেসি একা অন্য পাশে দৌড়ে যান, যেখানে আগে থেকেই শুয়ে থাকেন গোলকিপার এমিলিয়ানো মার্তিনেজ। তাঁকে জড়িয়ে ধরে বুকে টেনে নেন। কারণ, পিএসজি ফরোয়ার্ড জানেন ম্যাচটি জয়ের বড় নায়ক তিনি। দুটি পেনাল্টি ফিরিয়ে দেন এমিলিয়ানো। আরও একটি উদাহরণ দিতে হয়। দ্বিতীয় রাউন্ডে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ২-১ ব্যবধানে জেতা ম্যাচে বদলি নেমে বেশ কয়েকটি গোলের সুযোগ মিস করেন লাওতারো মার্টিনেজ। এ নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার শিকার হন এই স্ট্রাইকার। তবে ৩৫ বছর বয়সী সর্বকালের অন্যতম সেরা এই ফুটবলার তাঁর সতীর্থকে মাথা উঁচু রাখতেই বলেন। সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, ইন্টার মিলান তারকা আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ জয়ে বড় ভূমিকা রাখবেন। অধিনায়কের বিশ্বাস যে সঠিক ছিল, সেটি বেশ ভালোভাবেই প্রমাণ করেছেন লাওতারো মার্টিনেজ। কোয়ার্টার ফাইনালে টাইব্রেকারে দারুণ এক গোল করে দলের জয়ে বড় ভূমিকা রাখেন।

এই যে নেতা মেসির প্রতি সতীর্থদের সম্মান, ত্যাগ স্বীকার করার মানসিকতা, সেটা পিএসজি তারকা অর্জন করে নিয়েছেন। একইভাবে সতীর্থদের আগলে রাখা নিয়ে মেসির এসব উদাহরণ এটাই প্রমাণ করে যে তিনি নেতা হিসেবে কতটা পরিপূর্ণ। কেউ এখন আর বলতে পারে না লিও আর্জেন্টিনার নন। বরং তিনি সবার আগে আর্জেন্টাইন। যে বন্ধন ছিন্ন হওয়ার নয়। স্বর্গ থেকে হয়তো ডিয়েগো ম্যারাডোনাও নিজের শীষ্য নিয়ে এখন গর্ববোধ করছেন।