দেশপ্রেম মানে সততার সঙ্গে নিজের কাজটুকু করা

অলংকরণ: এস এম রাকিবুর রহমান

আমার দাদুর চোখ বড় বড়, লম্বা মানুষ। মেজাজ খানিকটা চড়া। নিয়মনীতি আর শৃঙ্খলায় আপাদমস্তক ঠাসা। ছোটবেলায় দেখতাম এই মানুষটাকে পাড়ার লোকজন ভয় পেত। বাবার কাছে জেনেছি, মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতের বালুরঘাটের প্রতিরাম এলাকায় যে ক্যাম্প ছিল, দাদু প্রয়াত রেয়াজ উদ্দিন চৌধুরী সেই ক্যাম্পের ইনচার্জ ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় দাদা-দাদিসহ বাড়ির সবাই আশ্রয় নিয়েছিলেন ভারতের পশ্চিম দিনাজপুরে।

দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম শেষে দাদু-দাদি ও বাবা অন্য সবার মতো একদিন বাড়ি ফেরেন। আমাদের বসতবাড়ি অবাঙালিরা পুড়িয়ে দিয়েছিল। বসতভিটায় পড়ে ছিল পোড়া টিনের চালার ছাই। পরে রিলিফ হিসেবে পাওয়া ত্রিপল, চাল, গম, শাড়ি কাপড়—এসব দিয়েই চলেছে কয়েক বছর।

মুক্তিযুদ্ধের সময় বাবা স্নাতক শেষ করেছেন মাত্র, ছিলেন মুজিববাহিনীর সদস্য। প্রায় চার মাস ট্রেনিং গ্রহণ করেছিলেন পশ্চিম দিনাজপুরের হিলি বাঙালিপুর ক্যাম্পে। দেশ স্বাধীন হতে যদি দেরি হয় তাহলে দেশের মানুষকে স্বাধীনতাসংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করাসহ অস্ত্র চালানোর ট্রেনিংও নিয়েছিলেন বাবা। তখন বাঙালিপুরের ক্যাম্প ইনচার্জ ছিলেন প্রয়াত বীর মুক্তিযোদ্ধা নওগাঁ জেলার বাসিন্দা আবদুল জলিল। দেশ স্বাধীনের পর আব্দুল জলিলের সঙ্গে ঢাকার আলিয়া মাদ্রাসায় অস্ত্র জমা দিয়েছিলেন বাবা।

সব সময় লক্ষ করি, মুক্তিযুদ্ধের গল্প বলার সময় বাবা কেমন স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েন। শরণার্থী শিবিরের সেই সব মর্মন্তুদ কথা স্মরণ করে চশমার ফাঁক গলিয়ে চোখ মোছেন। বাবাকে বহুবার জিজ্ঞাসা করেছি, ‘তোমার নামের সামনে বীর মুক্তিযোদ্ধা লেখো না কেন?’ বাবা বলতেন, ‘দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের জন্য বাবা-ছেলে লড়াই করেছি, এটাই তো সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি, আত্মতৃপ্তির জায়গা।’

বিজয় দিবসে বাবার চোখে আনন্দাশ্রু দেখি। নিজেকে সামলে নিয়ে প্রসঙ্গ বদলে ফেলেন। দেশপ্রেম মানে সততার সঙ্গে নিজের কাজটুকু করা। কী পেলাম, কী পেলাম না—সেটা বড় কথা নয়। এই শিক্ষা বাবার কাছে পেয়েছি। দেশমাতৃকার জন্য লড়াকু সৈনিক আমার বাবা বীর মুক্তিযোদ্ধা বদরুল আলম চৌধুরী, দেশের সূর্যসন্তান।

সভাপতি, দিনাজপুর বন্ধুসভা