গোলাম মুস্তাফার অভিনয়ে ‘শুভদা’ চিরকালের মায়াজাল

‘শুভদা’ চলচ্চিত্রের একটি দৃশ্যছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশের একজন দরদি আবৃত্তিশিল্পী গোলাম মুস্তাফা। বড় মাপের অভিনয়শিল্পীও তিনি। অমর কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘শুভদা’ উপন্যাসকে মিহি সুতোর কারুকাজের মতো করে বুনতে পেরেছিলেন কিংবদন্তি চলচ্চিত্র পরিচালক চাষী নজরুল ইসলাম। এই চলচ্চিত্রে হারান চরিত্রে গোলাম মুস্তাফার অভিনয় সহজ, সাবলীল, সুন্দর ও প্রাঞ্জল। তিনি যে কত গভীর, অতল ও উচ্চমার্গের শিল্পসাধক, তা মুহূর্তে মুহূর্তে প্রমাণ করেছেন।

হারান একটি ভিন্ন বৃত্তের মানুষ। জুয়া, গাঁজার আসরে, পতিতার বাসরে মেতে থাকে। ঘরে লক্ষ্মীমন্ত স্ত্রী শুভদা, কত কষ্টে সংসারের বোঝা টানে, সেদিকে তাঁর মন থাকে না। নেশার আসরে হারান বাদশাহ বনে যান। এই নেশার ঠেকের চিত্রায়ণে একটা চমৎকার গান আছে ‘এক দমেতে সাধু, দুই দমে সন্ন্যাসী/ তিন দমেতে চোখ বুজে দেখ ভগবানের হাসি/ এ নেশা এমন নেশা...’ মাতাল হারানের অভিনয়ে বেশ আনন্দঘন পরিবেশ সৃষ্টি হয়। গানটি লিখেছিলেন মোহাম্মদ রফিকুজ্জামান, কণ্ঠে নাজমুল হুদা আর সুরারোপিত করেছেন সংগীত পরিচালক খন্দকার নুরুল আলম।

নেশার ঘোর কাটলে অবশ্য হারানের পরিবারের অভাবের কথা মনে পড়ে। অসুস্থ ছেলে মাধবের জন্য ডালিম কিনে নিয়ে যাওয়ার কথা মনে পড়ে। বাড়িতে আছে বাল্যবিধবা কন্যা ললনা, চঞ্চলা কন্যা ছলনা এবং আরও এক বিধবা দিদি।

জমিদারের তবিলদারির কাজে আর্থিক তছরুপের অভিযোগে হারানকে জেলে যেতে হয়। শুভদা গিয়ে ভগবান জমিদারের পায়ে ধরে হারানকে জেল থেকে ছাড়িয়ে আনে। কিন্তু হারান ভাঙবে তবু মচকাবে না। না খেয়ে থাকবে তবু জমিদারের কাছে কাজ করতে আর যাবে না। আবার তাঁর পুরুষত্ব ও কোমল স্বভাবের ভালোবাসার টান এমনই যে ভালোবাসা বিক্রি করা পতিতাও প্রথমে দেবে না দেবে না করলেও, পরে বেশ কিছু টাকা সাহায্য করে।

গ্রামের এক পরোপকারী আধপাগল যুবক সদানন্দ; যে চরিত্রে অভিনয় করেছেন রাজ্জাক। হারানের পরিবারকে নিয়মিত সে আর্থিক সাহায্য করে। শুভদা থেকে শুরু করে ছোট্ট মাধব সবার সঙ্গে তাঁর ভাব। ভাবের ঘোরে বাল্যবিধবা ললনাকে সে কিছু বলতে চায়। ললনা সে কথার মানে কখনো বুঝে উঠতে পারে না।

মেঘ বাদলের দিনে কলসি কাঁখে ললনা যখন তাঁর বাড়িতে এসে ওঠে, খোল বাজিয়ে সে গান ধরে। সুবীর নন্দীর কণ্ঠে, মোহাম্মদ রফিকুজ্জামানের লেখা ও খন্দকার নুরুল আলমের সুরে বেশ মায়াবী সেই গান ‘তুমি এমনই জাল পেতেছ সংসারে/ কার বা এমন সাধ্য আছে/ এই মায়াজাল ছিঁড়ে যেতে পারে...’। চলচ্চিত্রের শুরুতেও এই গানের সুর বাজতে থাকে।
সংসারে অভাবের তাড়নায় রূপবতী যুবতী ললনা একদিন বাড়ি ছেড়ে চলে যায়। নদীর পাড়ে মাচার খুঁটিতে তার বৈধব্যের সাদা শাড়ি রাখা থাকে। সবার মনে হতে থাকে ললনা আত্মঘাতী হয়েছে। গ্রামের অন্য এক যুবক সারদা, সদানন্দকে সেই জায়গাটায় নিয়ে গিয়ে দেখায়। সদানন্দ নদীতে নেমে খুঁটি ছুঁয়ে দেখে আর ললনার জন্য দুঃখে পরান তাঁর ফেটে যায়। আবহে তখন বাজতে থাকে বিসর্জনের বাজনা। আবার সারদার সঙ্গে একসময় ললনার প্রেম ছিল। নিরুদ্দেশ হওয়ার বাসনার কিছুদিন আগে রাতে শিবতলায় গিয়ে সে সারদাকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। বিধবা মেয়েকে কীভাবে বিয়ে করবে? বাবা মেনে নেবে না, পুরোনো ভালোবাসার কথা মনে করেও সারদা রাজি হতে পারে না। ললনা তখন প্রস্তাব দেয় বোন ছলনাকে সে যেন বিয়ে করে।

জীবনের বিড়ম্বনায় ললনা অবশ্য মরেনি। বাল্যবৈধব্যের করুণ যন্ত্রণার বিরুদ্ধে আমাদের শরৎবাবুর বিদ্রোহ, ললনাকে নদী থেকে অন্য এক জমিদারের বজরায় তুলে নিয়ে আসে। সেই শহুরে জমিদার ললনার দুঃখের সব কথা শোনে আর বুঝতে পারে, সারদা নয় সদানন্দই ললনাকে প্রকৃত ভালোবাসতো। কিন্তু ললনা বুঝতে পারেনি। এখন সে নিজেই মন–প্রাণ–শরীর ও অর্থবিত্ত সবকিছু দিয়ে নতুন করে ললনাকে কাছে পেতে চায়। কাছে টেনে নেয়, বিয়ে করে।

আমাদের আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে তরুণ মনের ভালোবাসার এত যে ঘাত–প্রতিঘাত, বহুমুখী জটিল সম্পর্কের দ্বন্দ্ব, শরৎচন্দ্র কত আগে বসেই সেই সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে তা বুঝতে পেরেছিলেন। লিখেও গিয়েছেন যথেষ্ট। তাই তো তিনি বাঙালির চিরকালের আধুনিক কথাশিল্পী। প্রতিটি প্রজন্মের কাছেই জনপ্রিয়।

এদিকে আবার ছোট্ট মাধবের জীবন থেকে ছুটি হয়ে গেছে। এই শিশুশিল্পী মাস্টার সুজন অসাধারণ অভিনয় করেছেন। মাধবের মৃত্যুর পর মা শুভদা কিছুক্ষণের জন্য শোকে পাথর হয়ে গিয়েছিলেন। শুভদা চরিত্রে আনোয়ারার অভিনয় কখনো ভুলবার নয়। ললনা চরিত্রে জিনাতের অভিনয়ও হৃদয়স্পর্শী। জানি না এই শিল্পীকে বাংলা চলচ্চিত্রজগৎ পরবর্তী সময়ে সেভাবে আর পেল না কেন?

শেষ দৃশ্যে শুভদা সদানন্দকে পুত্রস্নেহে বুকে টেনে নিচ্ছে। হারানো পুত্র মাধব ও গৃহত্যাগী কন্যা ললনা যেন আবার তাঁর বুকে ফিরে এল। আর অনাথ সদানন্দ জীবন থেকে অনেক কিছু হারিয়েও ফিরে পেল নতুন একটা জীবন। নতুন এক জীবনের নিয়ন্ত্রক ছায়াবৃক্ষ জননীকে। আনোয়ারা আর রাজ্জাক মা সনাতনের ভূমিকায় কী দারুণ মিলিয়ে গেলেন। মা-পুত্রের স্নেহের আলিঙ্গন, বাঁধ না মানা চোখের জল, দূর থেকে দেখে হারানের মুখের অভিব্যক্তিও তখন অপূর্ব সুন্দর। গোলাম মুস্তাফা এই চলচ্চিত্রে ইতিহাস হয়ে থাকবেন।

শরৎচন্দ্রের কাহিনির আবেদন চিরকালীন। শুধু বাংলা ভাষায় নয়, ভারতের অনেক ভাষায় আজকের বলিউডেও তাঁর কাহিনি চলচ্চিত্রায়িত হয়। বাংলাদেশে চাষী নজরুল নিপুণ গাঁথুনিতে বেশ কয়েকটি কাহিনিকে তুলে ধরতে পেরেছিলেন। দৃশ্যায়ন, গান, সংলাপ, সম্পাদনা শুভদা চলচ্চিত্রের প্রতিটি দিকই ভালো। রুচিশীল, পারিবারিক, সর্বজনের বোধগম্য এই চলচ্চিত্রগুলো আপামর বাঙালি দর্শকের জন্য চিরকালের সম্পদ। এই চলচ্চিত্রের মায়াজাল কখনো ছেঁড়া যায় না।

হাওড়া, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত