অপরাজেয় অনুভব

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অর্ণবের অবস্থা কি তবে আরও খারাপ হলো! কল করতেই অপর পাশ থেকে কান্নার ধ্বনি ভেসে এল। শফিক সাহেব দ্রুত রেডি হয়ে মোটর সাইকেল নিয়ে বের হচ্ছিলেন, অঙ্কনও দৌঁড়ে এল। দুই চোখ জলে টলমল। খটকা লাগলেও শফিক সাহেব প্রশ্ন করলেন না। অঙ্কন ক্লান্ত স্বরে বলল, ‘বাবা, আমিও যাব।’

মুঠোফোন একনাগারে বেজে যাচ্ছে। শফিক সাহেব টবে জমে থাকা বৃষ্টির পানি পরিষ্কার করছিলেন। অর্ণবের ডেঙ্গু হয়েছে। তিনি দেখতে গিয়েছিলেন। অর্ণব আফতাব সাহেবের বাড়িতে লজিং থেকে পড়ে। আফতাব সাহেব শফিক সাহেবের ঘনিষ্ট বন্ধু। পাশাপাশি জায়গা কিনে বাড়ি করেছেন। শুরুতে অর্ণবকে লজিং রাখতে রাজি ছিলেন না তিনি। লজিং রাখা ও থাকার চল উঠে গেছে। তাছাড়া বর্তমানের বাস্তবতায় অপরিচিত কাউকে আশ্রয় দেওয়া খাল কেটে কুমির আনার মতো। কিছুদিন আগে শহরের শেষ প্রান্তের একটি বাড়িতে চুরি হয়েছে। এ চুরির নেপথ্যে ছিল একজন আশ্রিত। খাবারে অচেতন করার ওষুধ মিশিয়ে সে লক্ষ্য হাসিল করেছে। ইদানিং এ ধরনের ঘটনা অহরহ ঘটছে। যুক্তি দেখিয়ে স্থানীয় বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মহোদয়কে ‘না’ করে দিয়েছিলেন। এমনকি শফিক সাহেব অর্ণবকে ছোট থেকে চেনেন। অর্ণব মেধাবী ছাত্র। স্থানীয় গণ্যমান্যদের কেউ কেউ এ–জাতীয় অনুযোগ করে রাজী করাতে চেষ্টা করলেও আফতাব সাহেব পাত্তা দেননি। শেষমেশ সব ইতস্তত লুকিয়ে শফিক সাহেবকেই কথাটা পাড়তে হয়। শফিক সাহেব অর্ণবের শুভাকাঙ্ক্ষীদের একজন। নিজেও এতিম ছিলেন, বাবা-মা কাউকে দেখেননি। মানুষের সাহায্য নিয়ে বড় হয়েছেন। সহজাত ভাবেই অসহায় মানুষকে সহযোগিতা করেন।

অর্ণবকে নিজের বাড়িতেই রাখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ঘরে সমদ্ধ মেয়ে, স্ত্রী বেঁচে নেই। নানা কাজে দিনের ও রাতের অনেকটা সময় তাকে বাইরে কাঁটাতে হয়। আগুন আর ঘি পাশাপাশি রেখে আগুনের প্রভাব থেকে রেহাই পাওয়া যাবে- এ আশা করা বোকামি। ভেবে আফতাব সাহেবকে বলেছিলেন, ‘অর্ণবকে রাখো। কোনো সমস্যা হবে না। আমি বলছি, নিশ্চিন্তে রাখো।’ মন সাঁই না দিলেও বন্ধুর মুখের ওপর না করতে পারেননি আফতাব সাহেব। ভদ্রলোকের স্ত্রী দোমনা করলেও শফিক সাহেব পোড় খাওয়া অভিজ্ঞ লোক। নির্দ্বিধায় তার ওপর ভরসা করা যায় ইত্যাদি বুঝ দেওয়ায় আর আপত্তি করেননি। তাছাড়া কিছুদিনের মধ্যে প্রমাণও মিলেছে। কথায় কথায় শফিক সাহেব বলেছিলেন, ‘অর্ণব বড় ভালো ছেলে। ওর অনেক গুণ। গুণ দিয়েই ও সবার মন জিতে নেবে।’ হাসপাতালে অর্ণবকে দেখতে গিয়ে কথাটা আবারও স্মরণ করিয়ে দিতেই আফতাব সাহেব তাকে জড়িয়ে ধরেন। স্ত্রীও পাশে ছিলেন। শফিক সাহেবের কথার উত্তরে বেদনামিশ্রিত কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘ভাই, দোয়া করেন। আমার অর্ণবের যেন কিছু না হয়।’

‘কখন থেকে মোবাইলটা বেজে যাচ্ছে, শুনতে পাচ্ছ না।’ শফিক সাহেব পানির পাত্রটা নিচে রেখে অঙ্কনের দিকে ঘুরে দাঁড়ালেন। অঙ্কনের চোখ-মুখ শুকনা। ‘কি রে মা, খাওয়া-দাওয়া ঠিকমতো করছিস না! চোখ-মুখের এ দশা কেন?’ জিজ্ঞেস করলেন শফিক সাহেব। ‘কি যে বলো না বাবা, কাল রাত জাগা পড়েছে, সেই কারণে হবে হয়তো।’ বলতে বলতেই মোবাইলটা বাবার হাতে দিল অঙ্কন। আফতাব সাহেবের কল। দুইবারের বেশি সহসা কল করেন না ভদ্রলোক। কিন্তু আট বার কল, শফিক সাহেবের বুকটা ডুকরে উঠল। অর্ণবের অবস্থা কি তবে আরও খারাপ হলো! কল করতেই অপর পাশ থেকে কান্নার ধ্বনি ভেসে এল। শফিক সাহেব দ্রুত রেডি হয়ে মোটর সাইকেল নিয়ে বের হচ্ছিলেন, অঙ্কনও দৌঁড়ে এল। দুই চোখ জলে টলমল। খটকা লাগলেও শফিক সাহেব প্রশ্ন করলেন না। অঙ্কন ক্লান্ত স্বরে বলল, ‘বাবা, আমিও যাব।’ জবাবে শফিক সাহেব থেমে থেমে বললেন, ‘শক্ত করে ধরে বসিস। সময়টা ভালো যাচ্ছে না। সাবধান থাকতে হবে। আবেগের বশে যারা ভুল সিদ্ধান্ত নেয় জীবন তাদের ক্ষমা করে না।’ অঙ্কন বাবার কথার ইঙ্গিত আঁচ করতে পারলেও উত্তরে কিছু বলল না।

শুরুর থেকেই অর্ণবের প্রতি অঙ্কনের করুণা ছিল। যেমনটা দুঃখী, অসহায়-সম্বলহীন ছেলেদের প্রতি মেয়েদের থাকে। কিন্তু অর্ণবের একটা ফেসবুক স্ট্যাটাস অঙ্কনকে এলোমেলো করে দেয়। ‘কখনো যদি বিয়ে করি গান জানে এমন একটি মেয়েকে বিয়ে করব। মা-বাবা কাউকে কখনো দেখিনি। মাঝেমধ্যেই আমার মন খারাপ হয়। তখন একমনে, “আজ জ্যোৎস্না রাতে সবাই গেছে বনে” গানটা শুনি। যদি কখনো বিয়ে করি, একটা নিজের মানুষ হয়; তার কোলে মাথা রেখে তার কণ্ঠে গানটা শুনতে শুনতে শান্তি করে ঘুমাব।’ পোস্টটা পড়ে অর্ণবের প্রতি তীব্র মায়া বোধ করে অঙ্কন। আর এই মায়ার দহনেই স্কুলজীবন থেকে যে ছেলেটার সঙ্গে ওর সম্পর্ক; যার হাতে হাত রেখে পার্কের গোপন আলোয় কাটিয়েছে অনেকগুলো প্রহর, তার থেকে ধীরে ধীরে নিজেকে গুটিয়ে নিতে শুরু করে। ছেলেটা অঙ্কনের পরিবর্তন আঁচ করলেও গুরুত্ব দেয়নি। সব পাওয়া হয়ে গেলে উচ্ছ্বাসের মতো হৃদয়ের ব্যথাও কমে যায়। ছেলেটাও দূরত্ব মেনে নিয়েছে। তবে অঙ্কনের কথা যখনই মনে, পড়ে লজ্জায় নিজের মুখের দিকে সে তাকাতে পারে না। তার মনে হয়, একটা মেয়ের একজন পুরুষকে যা যা দেওয়ার থাকে সেই সব দিয়েও অঙ্কন যে তাকে পেছনে ফেলে যেতে পারল, এই অপমান মৃত্যুদণ্ডের সমান। অঙ্কনকে ঠকানো উচিত হয়নি! এই জীবনে কখনো আর মাথা উঁচু করে সে বাঁচতে পারবে না।

হাসপাতালে পৌঁছাতেই শফিক সাহেব হতচকিত হলেন। কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে গেছে। হাসপাতালের করিডোরে অনেক ভিড়। অর্ণবের রুম পর্যন্ত যেতে বেগ পোহাতে হবে। অঙ্কন ভিড় ঠেলে আগেই চলে গেছে। শফিক সাহেবের শ্বাসকষ্টের সমস্যা আছে। ভিড়ের ভেতর গেলে নিজেকে সামলাতে পারেন না। ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ালেন। বাইরে বাতাস বয়ে যাচ্ছে। ভাদ্র মাস। আকাশের এক কোণে কালো মেঘ জমা হয়েছে। শফিক সাহেব একটা সিগারেট ধরালেন। সচারাচর ব্যালকনির এ দিকটাতে কেউ আসে না। শফিক সাহেব ব্যালকনির সামনের দেয়ালের ওপর সিগারেটটা রেখে দরজা টেনে বন্ধ করে দিলেন। চাকরিজীবনে চেইন স্মোকার ছিলেন। স্ত্রী মারা যাওয়ার পর মেয়ের শাসনে-বারণে সিগারেটের ঝোঁক কিছুটা কমিয়েছেন। কিন্তু পুরোপুরি ছাড়তে পারেননি। সকালে ও রাতে একটা করে দিনে মোট দুটো সিগারেট খান। সিগারেট ধরানো উচিত হয়নি। কিন্তু মাথা ঝিমঝিম করছে। টেনশনের অনেকগুলো বিষয় আছে। কোন বিষয়টা বেশি যন্ত্রনা দিচ্ছে সিগারেটে টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে ভাবছিলেন। আচ্ছা, অঙ্কনের সঙ্গে অর্ণবের কী সম্পর্ক আছে? যদি সত্যি এমন কিছু হয়, সমাজে মুখ দেখাব কেমন করে। আমার কি ছেলেটার মৃত্যু কামনা করা উচিত। এসব আমি কি ভাবছি!... ...মা–মরা মেয়েটার জন্যই তো জীবনের সব শখ-আল্লাদ বিসর্জন দিয়েছি। ও আমার সম্মানের কথা একবারও ভাবল না। শফিক সাহেবের চোখের কোনায় অশ্রু। বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে। ব্যালকনি থেকে ভেতরে এসে দাঁড়ালেন তিনি। ভিড় কমে গেছে, তার যাওয়া উচিত। অর্ণবের কী অবস্থা, খোঁজ নেওয়া উচিত। কিন্তু পা আগাচ্ছে না। ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছেন। মোবাইল ভাইব্রেশন মোডে বাজছে। মিস্টার মণ্ডলের ফোন। একবার মনে হলো ধরবেন না। লোকটাকে পছন্দ করেন না। তারপরও ভদ্রতার খাতিরে ফোন ধরলেন। ‘ছেলেটা খুব অসুস্থ স্যার। ডেঙ্গু হয়েছে। প্লাটিলেট একেবারে কমে গেছে। ঢাকায় আছি, আপনার পরিচিত দু-একজনকে যদি একটু বলে দিতেন।’ বললেন মিস্টার মণ্ডল। শফিক সাহেব তার এক ডাক্তার বন্ধুকে কল করে মিস্টার মণ্ডলকে সহযোগিতা করতে বলে দিয়ে মনে মনে হাসলেন। হাসার অবশ্য কারণ আছে। মিস্টার মণ্ডল এলাকার প্রভাবশালীদের একজন। তার ভয়ে সব পেশার মানুষ তটস্থ থাকে। তার হাতে বান্ডেল না দেওয়া পর্যন্ত কারও একটা ইটের খোয়াও বসানোর ক্ষমতা নেই। সেই মানুষটায় আজ কত অসহায়। সামান্য একটা মশার কাছে পরাজিত।

শফিক সাহেব ফেসবুকিং করছিলেন। ডেঙ্গুতে এক মা–বাবার দুই সন্তান মারা গেছে। খবরটা দেখার পর শফিক সাহেব আহত হলেন। বহুদিন বড় পদে চাকরি করেছেন। সিস্টেমের রন্ধ্রে রন্ধ্রে লুকিয়ে থাকা ভূতদের চেনেন। তারপরও ডেঙ্গুর দায় কর্তৃপক্ষের ওপর দিতে চান না তিনি। ‘সচেতনতা নিয়ম করে তৈরি করা যায় না। আমরা সচেতন না হলে ডেঙ্গু আরও ভয়াবহ হবে। বিনীত অনুরোধ সকলের প্রতি সচেতন হন। না হলে কোভিডের চেয়ে ভয়াবহ অবস্থা হবে।’ বাংলায় টাইপ করে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিলেন শফিক সাহেব। তার আইডিতে ফলোয়ারের সংখ্যা দুই লাখের কাছাকাছি। মুহূর্তে অসংখ্য রিঅ্যাক্ট, কমেন্ট জড়ো হলো। শফিক সাহেব হাঁটতে হাঁটতে অর্ণবের রুমের একটা রুম আগে থমকে দাঁড়ালেন। অঙ্কন আর অর্ণবের সম্পর্কের বিষয়টা নিয়ে ভাবতে শুরু করলেন। যদি সত্যিই অর্ণবকে ভালোবাসার দাবি নিয়ে কখনো মেয়েটা সামনে এসে দাঁড়ায় কী করব তখন? কারও মৃত্যু কামনা করলে সত্যিই কি সে মরে যায়? আমি কি অর্ণবের মৃত্যু কামনা করব? নাকি ডেঙ্গুর সুযোগটাকে কাজে লাগিয়ে দ্রুত ওর মৃত্যুর ব্যবস্থা করব। টাকা দিয়ে জীবন রক্ষা করা না গেলেও শেষ করা যায়। এসব আমি কী ভাবছি! আহ! কুল শফিক কুল। শেষ পর্যন্ত দেখ কি হয়। না হলে মিস্টার মণ্ডল তো আছেই। কয়েক পেটি ধরিয়ে দিলে সাঙ্গপাঙ্গ দিয়ে অর্ণবের ভববাসনা সাঙ্গ করে দেবে। ভাবতে ভাবতে এগোতে শুরু করলেন শফিক সাহেব।

অর্ণবের প্লাটিলেট ক্রমশ কমে যাচ্ছে। নিথর শুয়ে আছে সে। মাথার শিয়রে বসে আছে অঙ্কন। এই ছেলেটাকেই তো সে দারুণ ভালোবাসে। তার ধারণা অর্ণব কখনো শরীরের মোহে পড়বে না। অর্ণবের মতো ছেলেরা ভালোবাসতে জানে, ধরে রাখতে জানে, আগলে রাখতে পারে। আমার প্রগাঢ় ভালোবাসা কি এই কারণেই? সত্যিই কি ভালোবাসতে তবে কারণ লাগে! অর্ণবকে কি কোনো দিন আমার ভালোবাসা বুঝবে, আমাকে ভালোবাসবে? নাকি বাবার প্রতি কৃতজ্ঞতার দরুণ এড়িয়ে যাবে। বলবে, তুমি বড়লোক, তোমার সঙ্গে আমার যায় না। আর বাবা, সে কি মেনে নেবে আমাদের সম্পর্ক! ভাবতে ভাবতে গাইতে শুরু করে অঙ্কন,
‘আজ জ্যোৎস্না রাতে সবাই গেছে বনে
বসন্তের এই মাতাল সমীরণে
আজ জ্যোৎস্না রাতে সবাই গেছে বনে।’

কেশবপুর, যশোর