বর্তমান বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক জাপানি লেখক হারুকি মুরাকামি। তাঁর বেশ কিছু বই বিশ্বের ৫০টিরও বেশি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। মুরাকামি মূলত উত্তরাধুনিক, পরাবাস্তব, অদৃষ্টবাদী বিষয়ে লেখালেখি করেন। ‘অদ্ভুত পাঠাগার’ শিরোনামে তাঁর ‘দ্য স্ট্রেঞ্জ লাইব্রেরি’ লেখাটির বাংলা অনুবাদ করেছেন আরমান কবির। পাঠক হিসেবে মনে হয়, মুরাকামি যেন প্রতিটি গল্পেই কিছু বার্তা দিতে চাইছেন। প্রতিটি লাইনই যেন রূপক। বইটিও ব্যতিক্রম নয়। বইটি পড়ে অধিকাংশ পাঠকই বলছেন, অদ্ভুত পাঠাগার আসলেই অদ্ভুত!
যাহোক, একজন ক্ষুদ্র পাঠক হিসেবে বইটি থেকে ১০টি বার্তা বা শিক্ষা চিহ্নিত করার চেষ্টা করেছি—
১. মস্তিষ্কে বইয়ের প্রভাব: বই কিংবা পাঠাভ্যাস মানবমস্তিষ্ক শুধু দখল নয়, বদলে দেওয়ার সক্ষমতা রাখে। পড়ার ফলে মানুষ অনেক জানে। এর ফলে চিন্তাভাবনাসহ পুরো জীবনযাপনে আসে আমূল পরিবর্তন। বইটির অন্যতম চরিত্র লাইব্রেরির মালিক বুড়ো। বুড়োর সহকারী মেষমানব কেন্দ্রীয় চরিত্র ছোট্ট ছেলেটিকে জানায় বই তিনটি পড়া হলে ছেলেটির মাথা ফাটিয়ে মগজ খাবে ওই বুড়ো। সম্ভবত এই বর্ণনার মধ্য দিয়ে প্রতীকী অর্থে বই পড়ার ফলে যে নতুন চিন্তাধারা ছেলেটির মস্তিষ্ক গ্রাস করে নেবে বা চিন্তাভাবনায় গেঁথে যাবে, সেই বিষয়টি বোঝানো হয়েছে।
২. প্রত্যেক মানুষের নিজস্ব জগৎ রয়েছে: ছেলেটি অদ্ভুত পাঠাগারে বন্দী থাকাকালে সেখানে একটা সুন্দরী মেয়ের উপস্থিতি ছিল। যে নিত্য দুর্দান্ত সব খাবার নিয়ে হাজির হতো। কিন্তু মেষমানবের দাবি, সেখানে সে ছাড়া আর কেউ নেই। প্রথমে ঘটনাটিকে ভ্রম ভাবলেও পরদিন আবারও মেয়েটি এলে এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মেয়েটি বলে, ‘শোনো, তুমি, আমি, মেষমানব—সবারই নিজস্ব একটা জগৎ আছে। একজনের জগতের সঙ্গে আরেকজনের মিল নেই। তোমার জগতে হয়তো কারও অস্তিত্ব আছে, অন্য কারও জগতে হয়তো সে নেই।’
৩. জগতে কারও জন্য কিছু থেমে থাকে না: ছোট্ট ছেলেটি যখন ‘অদ্ভুত পাঠাগারে’ বন্দীরত অবস্থায় মা ও পোষা পাখিটির চিন্তায় হাবুডুবু খাচ্ছে, তখন বুড়ো তাকে উপদেশ দেয়, ‘শোনো, জগৎ সম্পর্কে তোমার কোনো ধারণা নেই বুঝলে! এখানে কারও জন্য কিছু থেমে থাকে না। তুমি না থাকলে কারও কিছু যাবে–আসবে না। সবাই সবার নিয়মে চলবে।’ আসলেই তাই। যখন সে এই গোলকধাঁধা থেকে মুক্তি পায়, বাড়ি ফিরে দেখে সবকিছু স্বাভাবিক চলছে। অথচ সে ভেবেছিল তার অনুপস্থিতিতে বাড়ির অবস্থা অন্য রকম হবে।
৪. কারও একটুখানি সাপোর্ট, শক্তি জোগাতে পারে অনেকখানি: উত্থান–পতনের সমন্বয়ে মানবজীবন। লড়াইটা একান্ত একার। কিন্তু জীবনের ভয়াবহ সংকটাপন্ন সময়ে যদি কেউ একটুখানি মানসিক সাপোর্ট দেয় বা অনুপ্রেরণা দেয়—এইটুকু শক্তি মানুষকে সফলতার পথে অনেকখানি এগিয়ে দেয়। কারাগার থেকে পালানোর পরিকল্পনা মাথায় এলেও যখন তা একেবারে অসম্ভব বলে হাল ছেড়ে দেয় ছেলেটি, তখন মেয়েটি এগিয়ে এসে তাকে চুমু খায়। যার আবেশ ছেলেটিকে মুহূর্তেই আত্মবিশ্বাসী করে তোলে। ছেলেটি নিজের অনুভূতি প্রকাশ করে এভাবে, ‘মনে হলো—আমি আর কিছুকেই ভয় পাই না। কোনো দুশ্চিন্তায়ই আমাকে কুরে কুরে খেতে পারবে না আর। অবাক হয়ে লক্ষ করলাম, কেমন যেন আমার চোয়াল দৃঢ় হয়ে উঠেছে। এখান থেকে আমি বের হবই, প্রতিজ্ঞা করে ফেললাম।’
৫. পিছুটানকে জয় করে সামনে এগিয়ে যাওয়া: পরিকল্পনা অনুযায়ী অদ্ভুত পাঠাগারের অদ্ভুত কারাগার থেকে পালানোর সময় এসে গেছে। মচমচ শব্দ করবে বিধায় ফেলে রেখে আসতে হয়েছে জন্মদিনে মায়ের থেকে উপহার পাওয়া দামি জুতাজোড়া। এ জন্য ছেলেটির ভীষণ মন খারাপ হয়। সে ভাবে, বুড়োর তো বয়স হয়েছে। জুতার শব্দ কানে না পৌঁছাতেও পারে। মেষমানব ছেলেটির মনে ফেলে আসা জুতাজোড়ার থেকে লক্ষ্যে এগিয়ে যাওয়া বেশি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি পুনরায় বুঝিয়ে দেয়। আমাদের জীবনেও মাঝেমধ্যে এমন পরিস্থিতি আসে, যখন প্রিয় কোনো জিনিসের মায়া কাটিয়ে পিছুটানকে জয় করে সামনে এগিয়ে যেতে হয়।
৬. মাঝপথে হাল ছেড়ে না দেওয়া: কারাগার থেকে বের হওয়ার গোলকধাঁধাময় পথে অবস্থা দফারফা। মেষমানব তো বারবার নাকানিচুবানি খাচ্ছিল। এদিকে সময় শেষের দিকে, রাত প্রায় ভোর। মেষমানব দ্বিধাগ্রস্ত, কিন্তু বালকটি তখন পর্যন্ত আত্মবিশ্বাসী। মেষমানবকে ধৈর্য রাখার পরামর্শ দেয়। উল্কার বেগে চলতে চলতে শেষ মুহূর্তে তারা ঠিকই আলোকরশ্মিময় পথের সন্ধান পায়। অথচ তারা এই গোলকধাঁধায় হারিয়ে মাঝপথে যদি হাল ছেড়ে দিত, তাহলে কখনোই বের হওয়া সম্ভব হতো না। কারাগারেই বন্দী থাকতে হতো। এ জন্য জীবনে মাঝপথে কোনো কাজে হাল ছেড়ে দিতে নেই। লক্ষ্যে অবিচল থেকে চেষ্টা চালিয়ে যেতে হয় শেষ পর্যন্ত।
৭. চূড়ান্ত সংকটাপন্ন সময়ে ঘটতে পারে অলৌকিক কিছু: এত কষ্ট করে গোলকধাঁধাময় পথ পেরিয়ে দরজায় দাঁড়াতেই সামনে সেই শয়তান বুড়ো দাঁড়িয়ে আছে একটা কালো কুকুরসহ। যার মুখে ছেলেটির পোষা পাখিটি। তীব্র রাগে-দুঃখে-হতাশায় হতোদ্যম হয় ছেলেটি। মেষমানব আর ছোট্ট ছেলেটি যখন বুঝতে পারে নিজেদের আসন্ন কঠোর শাস্তি, ঠিক তখনই ঘটে একটি অলৌকিক ঘটনা। হঠাৎ কুকুরের পেটে পাখিটা বড় হতে থাকে এবং পেট ফেটে বেরিয়ে এসে বুড়োকে চেপে ধরে। আমরাও যখন জীবনে চূড়ান্ত সংকটাপন্ন সময়ে চারদিকে অন্ধকার দেখি, তখনই কোনো না কোনো দিক থেকে আসতে পারে সহযোগিতা। ঘটতে পারে অলৌকিক কিছু। এ জন্য শেষ পর্যন্ত মনে পজিটিভ বিশ্বাস লালন করা উচিত।
৮. সুযোগের সঠিক ব্যবহার: সুযোগ বারবার আসে না। পাখিটা বের হয়ে এসে একটা ষাঁড়ের আকার ধারণ করে বুড়োকে চেপে ধরে। অন্যদিকে ছেলেটিকে পালাতে বলে। কণ্ঠস্বরটা ছিল সেই মেয়েটির। ছেলেটি সাময়িক হতভম্ব হয়। মেয়েটির মায়া আবিষ্ট করে তাকে। কিন্তু তাৎক্ষণিক সে বাইরে চলে আসে। সে যদি এই সুযোগ কাজে না লাগিয়ে বের না হতো, তাহলে শূন্যে হারিয়ে যেত। মানুষের জীবনেও এমন আকস্মিক সুযোগ আসে। যার সঠিক ব্যবহার করতে না পারলে হেরে যেতে হয়। আর এমন সুযোগ বারবার আসেও না।
৯. মানুষ মূলত একা, নিঃসঙ্গ: মুক্তির আনন্দে বিভোর ছেলেটি বাড়ি ফিরে দেখে সব স্বাভাবিক। তার মা খাবার সাজিয়ে বসে আছে। এই যে চড়াই-উতরাই আর অভিজ্ঞতা সবই তার ব্যক্তিগত। কিছুদিনের মধ্যেই মা মারা যায়। তারপর সে বাস্তবিক অর্থেই একা হয়ে যায়। মা, মেষমানব, পাখি কিংবা সেই মেয়েটি—কেউই থাকে না। অমাবস্যার মতো ভারী আর দুর্ভেদ্য এই একাকিত্ব ও নিঃসঙ্গতা। তার মতোই প্রত্যেক মানুষ জীবনে একান্ত একা, নিঃসঙ্গ। এটাই হয়তো জীবনের মাহাত্ম্য।
১০. অপ্রাপ্তি জীবনের অনুষঙ্গ: জীবন মূলত একটা যাত্রাপথ। এ পথে কত কিছুই ফেলে আসতে হয়। ধরাছোঁয়ার বাইরে কত কিছুই রয়ে যায়। এই যে পোষা পাখিটি কিংবা সুন্দর সেই মেয়েটি—যাদেরকে সে পেয়েও হারায়। আবার অমীমাংসিত থেকে যায় অদ্ভুত পাঠাগারের সেই রহস্য। এমন সব অপ্রাপ্তি নিয়েই তো মানুষ জীবনের অভিযাত্রী।
এত ছোট্ট পরিসরে মানবজীবনের এত দিক উপস্থাপন মুরাকামির পক্ষেই সম্ভব। কৌতূহল, বন্ধুত্ব ও পরিবারের প্রতি মমতা; আবার একই দিকে স্বাধীনতার তীব্র বাসনা—এসব তো আপনার আমারও বৈশিষ্ট্য। মুরাকামির গদ্যে লুকিয়ে আছে এক আশ্চর্য মোহ। লেখক, অনুবাদক, প্রভাষক আরমান কবিরের ঝরঝরে অনুবাদে প্রিমিয়াম পাবলিকেশনসের ছোট্ট এ বইটির আকার-প্রচ্ছদসমেত পুরো শৈলী বেশ আকর্ষণীয়। বেশ কিছু পাতায় রয়েছে বর্ণনাসংশ্লিষ্ট ছবি। আরও সংযুক্ত রয়েছে পাঠকের পাতা। সব মিলিয়ে বইটির পাঠ ফ্যান্টাসিময় এক অদ্ভুতজগতে ভ্রমণ করিয়ে নিয়ে আসবে পাঠককে।
বই সমাচার—
বই: অদ্ভুত পাঠাগার
লেখক: হারুকি মুরাকামি
অনুবাদক: আরমান কবির
সম্পাদনায়: আবদুল আলিম
প্রচ্ছদ: নন্দন
প্রথম প্রকাশ: জুন ২০২৪
প্রকাশক: জিয়াউল হাসান নিয়াজ (প্রিমিয়াম পাবলিকেশনস)
মুদ্রিত মূল্য: ২২৫৳
পৃষ্ঠা: ১১০
বন্ধু, কুড়িগ্রাম বন্ধুসভা