২০১৬ সালের ১৮ জুলাই, সকাল সাতটা। প্রতিদিনের মতোই বাবা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম থেকে ডেকে দিলেন। ঘুম ঘুম চোখ নিয়ে দাঁত ব্রাশ করতে গেলাম। ঘুম তখনো পুরোপুরি কাটেনি বলে বাবাই ব্রাশ করিয়ে দিলেন। তখন সপ্তম শ্রেণির অর্ধবার্ষিক পরীক্ষা চলছে। বাবা আমাকে পড়তে বসিয়ে বললেন, গোসল করে এসে আমার সঙ্গে বসে নাশতা করবে। বাবার সেই নাশতা করাটা আর হলো না। বিদ্যুতায়িত হয়ে তিনি পৃথিবী ছেড়ে বিদায় নেন। আমাকে একবার বলেও গেলেন না।
বাবাকে যখন হাসপাতালে নেওয়া হচ্ছিল, তখন গাড়ির পেছন পেছন দৌড়ে হাসপাতালে পৌঁছে গিয়েছিলাম। কিন্তু ওনাকে নিয়ে বাসায় ফিরতে পারলাম না। অন্য একদিন বাসায় ফেরার সময়ের গল্প বলব। আজ অন্য একটা স্মৃতিচারণা করা যাক।
আমার চতুর্থ কিংবা পঞ্চম জন্মদিন হবে। বাবার সঙ্গে ঘুরতে বেরিয়েছি। যে রিকশায় করে যাচ্ছিলাম, সেই রিকশাচালককে বাবা আমার জন্মদিন উপলক্ষে আমড়া কিনে খাইয়েছিলেন। রিকশাওয়ালা আমার জন্য দোয়া করে দেন। এখন পর্যন্ত সেটাই আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ উপহার।
আরেকবার বাবার সঙ্গে বাসে ফিরছিলাম ফুপ্পির বাসা থেকে। পথে জানালার কাচে হাত লেগে আমার হাত কেটে যাওয়ার পর বাবা আমায় কোলে করে নিয়ে ফার্মেসি থেকে ব্যান্ডেজ করিয়ে আনেন। বিষয়টা এতটুকু পর্যন্ত সাধারণ ছিল, কিন্তু বাবার চোখের কোণে জল দেখেছিলাম।
বন্ধুদের সঙ্গে স্কুলে যাব বলে বায়না ধরলে তিনি আমিসহ বন্ধুদেরও স্কুলে নিয়ে যেতেন। ঝালমুড়ি খেতে ভালোবাসতাম বলে ঝালমুড়িওয়ালাকে অ্যাডভান্স টাকা দিয়ে রাখতেন প্রতি মাসের শুরুতেই। পৃথিবীর সবার বাবা হয়তো সেরা, কিন্তু বাবা এখনো আমার সেরা বন্ধু। যখনই ভয় পাই, বাবাকে স্মরণ করলে ভয় কেটে যায়। এখনো প্রতি রাতে স্বপ্নে এসে বাবা আমার সঙ্গে কথা বলেন। মাঝেমধ্যে ওনাকে বলি, ‘বাবা, তোমার মতো করে কেউ টেনস পড়াতে পারে না, কেউ এত ভালো অঙ্ক করাতে পারে না, এখন আমার বেতন আমাকেই মনে করে দিয়ে আসতে হয়। বেতনের রসিদ ভুল করে বাসায় রেখে গেলে কেউ গিয়ে দিয়ে আসে না। তোমার মতো করে রাত জেগে আমার সঙ্গে সিনেমা দেখতে কেউ রাজি হয় না। তোমার মতো করে এখন আমাকে কেউ আর দোয়েল পাখি বলে ডাকে না।’
শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়