নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর ‘কবিতার ক্লাস’

নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর ‘কবিতার ক্লাস’

ক.
‘কবি’ শব্দটি শোনামাত্র অধিকাংশ মানুষের স্মৃতিপটে যে ব্যক্তিবিশেষের ছবি উদ্ভাসিত হয়, তাঁর বৈশিষ্ট্য ঠিক এ রকম—ঝুঁটিওয়ালা লম্বা ফাইবারের মতো চুল, কাঁধে পাটের ঝোলানো ব্যাগ, চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা এবং পরনে ঢিলেঢালা পাঞ্জাবি-পায়জামা। আর মানুষটি সারাক্ষণ আকাশের পানে তাকিয়ে থাকে। এমন ব্যক্তিকে দেখামাত্র আমাদের অবচেতন মন বলে ওঠে, এই তো কাব্যের ফেরিওয়ালা! দৌড়ে তাঁর সাক্ষাৎ অভিলাষ নিবেদন করতে গিয়ে আমাদের ভ্রম ভাঙে।

আমরা কাব্যচর্চা বা কবিতা লেখার যোগ্যতা বা আরও সহজ করে বললে, কবি হওয়ার জন্য এমন কিছুই বিবেচনা করি। তাই মনে হয়, আমাদের দ্বারা হয়তো কবি হওয়া সম্ভব নয়। অনেক সময় কবিতা লেখার যোগ্যতাকে ‘দৈব বা গড গিফটেড’ বলেও ধরে নিই। আবার এমনও বলতে শুনি—‘সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি’।

এত সব বৈশিষ্ট্য আর প্রবাদকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী তাঁর ‘কবিতার ক্লাস’ বইয়ে বলেছেন, ‘কেউ কেউ কবি নয়, সকলেই কবি’। কাব্য প্রতিভা দৈব বা গড গিফটেড কোনো বিষয় নয়। কবিতা লেখার জন্য ঢিলেঢালা জামা পরে কাঁধে ব্যাগ নিয়ে সারাক্ষণ আকাশের দিকেও তাকিয়ে থাকার কোনো দরকার নেই। লেখক বইটির শুরুর দিকে কবিতা লেখার জন্য তিনটি জিনিসের কথা উল্লেখ করেছেন—কিছু কাগজ, একটি কলম ও কিছু সময়। এই তিনটি কারও জোগাড় করার সামর্থ্য থাকলে সে কবি হতে পারবে। বাহ! কত সহজ, তাই না। আমার তিনটিই আছে। তাহলে চলুন লিখে ফেলি একটা কবিতা।

‘জমির মিয়া বাজারে গিয়া
পাটের থলে মাথায় নিয়া
কচু, আলু, পটোল কিনে
বাড়ি ফিরেন সকাল দিনে।’

কী চমৎকার! তাই না? আমিও কবি হয়ে গেলাম। না, কবিতা হয়নি। আমরা মনে করি, অন্ত্যমিল রেখে দু-চার লাইন লিখে দিলেই কবিতা হয়ে যায়। মনে রাখতে হবে, ‘ডিম ছাড়া যেমন অমলেট হয় না, তেমনি কিছু জিনিস না থাকলে সেটা কবিতা হয় না।’ সেই জিনিসগুলো কী? লেখকের মতে এই তিনটি জিনিস হলো—কাব্যগুণ, ছন্দ ও মিল।
অবশ্য মিল ছাড়াও লেখা যায়। তবে লেখক বলেছেন, ‘প্রথমেই মিল ছাড়া লেখা শুরু করে দিলে লোকজন বলবে, তোমার যোগ্যতা নেই। তাই আগে মিল রেখেই লিখতে থাকো, পরে মিল ছাড়াও লেখা যাবে।’

খ.
লেখক উপক্রমণিকা থেকে অবসর হয়ে তাঁর পুরো বইয়ের পৃষ্ঠা খরচ করেছেন ছন্দের আলোচনায় আলাপ নিবদ্ধ রেখে। কবিতা লেখার ক্ষেত্রে ছন্দ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ছন্দ না থাকলে কবিতা তার গতি হারিয়ে ফেলে। বাংলা কবিতা মোটামুটি তিন রকম ছন্দে লেখা হয়—অক্ষরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত ও স্বরবৃত্ত। লেখক তাঁর বইয়ে ব্যাখ্যা, উদাহরণ বিশ্লেষণ করে কবিতার ছাত্রদের সামনে এই তিনটি ছন্দের পরিচয় বোধগম্য পন্থায় উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছেন।

এক. অক্ষরবৃত্ত ছন্দ। সহজ কথায় অক্ষরবৃত্ত ছন্দ হলো—যত অক্ষর বা বর্ণ, তত মাত্রা। অর্থাৎ প্রতিটি অক্ষরই এখানে একটি মাত্রার মর্যাদা পেয়ে থাকে। সহজ করে বললে এখানে মাত্রা ও অক্ষর সমান। অন্যান্য অক্ষর যেমন এক মাত্রার মূল্য বহন করবে ঠিক একইভাবে যুক্তাক্ষরকেও এক মাত্রার মূল্যায়ন দেওয়া হবে। উচ্চারণকালের ক্ষুদ্রতম এক একটা অংশকে মাত্রা বলা হয়।

লেখক সাধারণ নিয়মগুলোর প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। অক্ষরবৃত্ত ছন্দে লাইন চার মাত্রার চাল। চারের গুণিতকের সঙ্গে দুই যোগ করে এর লাইনের দৈর্ঘ্য নির্ণীত হবে। সে হিসাবে অক্ষরবৃত্ত ছন্দ ৬, ১০, ১৪, ১৮, ২২ মাত্রার হতে পারে। অক্ষরবৃত্ত ছন্দের আলাপ সংক্ষেপে এতটুকুই।

দুই. মাত্রাবৃত্ত ছন্দ। আমরা অক্ষরবৃত্ত ছন্দে যেমন দেখেছিলাম প্রতিটি অক্ষর এক মাত্রার মূল্য পাচ্ছে, ঠিক অনুরূপ মাত্রাবৃত্তের ক্ষেত্রেও। তবে এক জায়গায় একটু পার্থক্য আছে। তা হলো অক্ষরবৃত্ত ছন্দে যুক্তাক্ষরকেও এক মাত্রার মূল্য প্রদান করা হতো। কিন্তু মাত্রাবৃত্তে এসে যুক্তাক্ষর তার নিজ নিজ অক্ষরের মূল্য পাবে। অর্থাৎ প্রতিটি অক্ষর তো এক মাত্রার মর্যাদা পাচ্ছেই, একই সঙ্গে যুক্তাক্ষর পাবে দুই মাত্রার মূল্য।
মাত্রাবৃত্তের চাল সর্বসাকল্যে চার ধরনের। চার মাত্রার চাল, পাঁচ মাত্রার চাল, ছয় মাত্রার চাল ও সাত মাত্রার চাল।
অনেকে আট মাত্রার চালের বয়ানও দিয়ে থাকেন। তবে সেটি আলাদা একটি চাল।

তিন. স্বরবৃত্ত ছন্দ। এটিকে ছড়ার ছন্দও বলা হয়। সহজ কথায় বললে স্বরবৃত্ত ছন্দ হলো যেখানে প্রতিটি সিলেবলকে এক মাত্রা হিসেবে মূল্যায়ন করা হয়। সিলেবলকে অনেকে আবার শব্দাংশ, পাপড়ি, দল ইত্যাদি নামে বলে থাকেন। সিলেবল হলো কোনো কিছু উচ্চারণ করতে গিয়ে ন্যূনতম চেষ্টায় যতটুকু বলতে পারি ততটুকু। অর্থাৎ একেকটি সিলেবল হচ্ছে উচ্চারণের একেকটি ইউনিট বা একক।

মাত্রাবৃত্তে বাহারি চালের চল থাকলেও স্বরবৃত্ত ছন্দে একটিই চাল আছে। সেটি হলো চার মাত্রার চাল। তবে অনেক সময়ই চার চালের এই রীতির ব্যতিক্রম ঘটতে দেখা যায়। দুই মাত্রা, তিন মাত্রা বা পাঁচ মাত্রার চালেরও মাঝেমধ্যেই হদিস মেলে।

গ.
বইয়ের শেষের দিকে লেখক পয়ার, মহাপয়ার, পদ, যতি ও যতিলোপ নিয়েও কথা বলেছেন। তবে তা গৌণ।

নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী তাঁর ‘কবিতার ক্লাস’ বইয়ের ইতি টেনেছেন এমন কিছু পত্রের উল্লেখের মধ্য দিয়ে, যা তাঁকে এ ক্লাসকেই মলাটবদ্ধ আকারে নিয়ে আসতে দারুণভাবে উৎসাহিত করে।