অমিত্রাক্ষর ছন্দ প্রবর্তনের নেপথ্যে যে ঘটনা

মাইকেল মধুসূদন দত্ত

বাংলা সাহিত্যের উজ্জ্বলতম নক্ষত্র মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত। তাঁর পদচারণে বাংলা সাহিত্য কেবল এগিয়েই যায়নি, সমৃদ্ধির মাইলফলক স্পর্শ করেছে। অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রবর্তন কবির অন্যতম কীর্তি। কিন্তু বিশেষ এই ছন্দরূপ প্রবর্তনে কেন মনোনিবেশ করেছিলেন কবি? উত্তর খুঁজতে ওই সময়ের পারিপার্শ্বিকতা ও কবির জীবনের কিছু ঘটনা জানা জরুরি।

মধুসূদন যখন বড় হয়ে উঠছিলেন, তখন চারদিকে ইংরেজি সাহিত্যের তথা ইংরেজি ভাষার জয়জয়কার। আলাপচারিতা থেকে শুরু করে চিঠিপত্র, সর্বত্রই ইংরেজি ব্যবহৃত হচ্ছে। ইংরেজি না জানাটা তখন ছিল অসম্মানের। লেখাপড়ায় গভীর মনোযোগী, মায়ের কাছে রামায়ণ-মহাভারতের পাঠ শোনা মধুসূদনও নিস্তার পেলেন না। প্রেমে পড়লেন ইংরেজির, ইংরেজি সাহিত্যের। তারপরের ঘটনা কমবেশি সবারই জানা, তাই আর অত্যুক্তি করছি না। তবে ইংরেজিতে ‘ক্যাপটিভ লেডি’, ‘ভিশনস অফ দ্য পাস্ট’ লিখে পরিচিতি পাওয়া; ইংরেজি, লাতিন, গ্রিক ভাষা জানা মধুসূদন বন্ধুদের অনুরোধে কিংবা বাস্তবতা মেনে নিয়েই মাতৃভাষায় কাব্যচর্চা করবেন বলে যখন কলকাতায় ফিরলেন, প্রশ্নটির উত্তর পেতে ওই সময়ের কিছু কথাও উল্লেখ করা আবশ্যক।

১৮৫৬ সাল। বিদেশ থেকে শূন্য হাতে বাংলা সাহিত্যের ভাবি মহাকবি কলকাতায় ফিরলেন। হৃদয়ে কবি হওয়ার, খ্যাতি অর্জনের প্রবল বাসনা। কিন্তু বাংলায় লিখে কি সম্ভব? ইত্যাদি নানা সংশয়, প্রশ্ন, দুঃখ, বেদনা নিয়েই শুরু করলেন। কথায় আছে, বাসনায় বিশুদ্ধতা থাকলে প্রকৃতিও সঙ্গী হয়ে যায়, পথ দেখিয়ে দেয়। মধুসূদনের ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম ঘটেনি। কলকাতায় ফিরেই বেলগাছিয়া নাট্যশালার সঙ্গে যুক্ত হওয়ার সৌভাগ্য হয় কবির। নাটক রচনার মধ্য দিয়ে তাঁর প্রতিভা বিকশিত হতে শুরু করে। প্রথম নাটক ‘শর্মিষ্ঠা’ প্রকাশিত হয় ১৮৫৮ সালে। বেলগাছিয়া নাট্যশালায় নাটকটি ১৮৫৯ সালের ৭ সেপ্টেম্বর অভিনীত হয়। এই নাট্যশালা কবির প্রতিভায় আলো ফেলে। কাব্য-অনুরাগী অনেক গুণী মানুষের সঙ্গে নাট্যশালায় কবির পরিচয় হয়। তাঁদেরই একজন মহারাজা যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর। বাংলা সাহিত্যের গর্বের ধন অমিত্রাক্ষর ছন্দ; মধুসূদন কর্তৃক এ ছন্দ প্রবর্তিত হওয়ার পেছনে এই কাব্য-অনুরাগীর ভূমিকা আছে। সেই গল্পে যাওয়ার আগে বন্ধু রাজনারায়ণ বসুকে লেখা কবির একটি চিঠি থেকে উদ্ধৃত করা জরুরি। চিঠিতে বন্ধুকে কবি লিখেছিলেন, ‘আমরা চাই জনসাধারণের কান ব্ল্যাংক পদ্যের সুরের সঙ্গে মিলিত হোক।’ চিঠির বক্তব্য থেকে অনুমান করতে কষ্ট হয় না যে চিঠি লেখার সময়ই বাংলা কাব্যের ছন্দমুক্তির কথা, তথা ব্ল্যাংক পদ্যের বিষয়ে ভাবছিলেন কবি।

এবার গল্পে ফেরা যাক। মহারাজা যতীন্দ্রমোহন ঠাকুরের সঙ্গে কবির পরিচয় হওয়ার পর থেকে দুজনের মধ্যে কাব্য ও সাহিত্যের নানা বিষয়ে আলোচনা হতো। তেমনই একদিন আলাপকালে কথায় কথায় যতীন্দ্রমোহনকে উদ্দেশ করে কবি বললেন, ‘যত দিন বাঙলা ভাষায় অমিত্রচ্ছন্দের প্রবর্তন না হইবে, তত দিন বাঙলা নাটক সম্বন্ধে বিশেষ কোনো উন্নতির আশা নাই।’ যতীন্দ্রমোহন হাসলেন। বিরক্ত বোধ করলেও কিছু বললেন না কবি। ‘বাঙলা ভাষার যেরূপ অবস্থা, তাহাতে এই ভাষায় অমিত্রচ্ছন্দ প্রবর্তিত হওয়ার সম্ভাবনা অল্প।’ যতীন্দ্রমোহনের এ কথার পরিপ্রেক্ষিতে বললেন, ‘আমি তাহা মনে করি না। চেষ্টা করিলে আমাদিগের ভাষাতেও অমিত্রচ্ছন্দ প্রবর্তিত হইতে পারে।’

যতীন্দ্রমোহনও সপক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করলেন। ‘বাঙলা ভাষার গঠন বিবেচনায় ইহাতে অমিত্রচ্ছন্দ প্রবর্তিত হওয়া কোনোমতেই সম্ভবপর নহে। ফরাসি ভাষা আমাদিগের ভাষা অপেক্ষা অধিকতর উন্নত, কিন্তু আমি যত দূর অবগত আছি, তাহাতে ইহাতেও অমিত্রচ্ছন্দ রচিত কোনো কাব্য নাই।’ ‘বাঙলা ভাষা সংস্কৃত ভাষার দুহিতা: এ রূপ জননীর সন্তানের পক্ষে কিছুই অসম্ভব নহে।’ মধুসূদনের জবাব।

কথা বাড়তে বাড়তে অনেক দূর এগোল। একপর্যায়ে আত্মশক্তিতে বলীয়ান মধুসূদন প্রতিজ্ঞা করে বসলেন, নিজেই অমিত্রাক্ষর ছন্দে কাব্য রচনা করবেন। যে কথা সেই কাজ, ‘তিলোত্তমাসম্ভব’ কাব্য রচনা করলেন। নব ছন্দে রচিত কাব্য শুনে মহারাজা যতীন্দ্রমোহন ঠাকুরের মতো সুপণ্ডিত ব্যক্তিরা মধুসূদনের প্রতিভার প্রশংসা করেছিলেন। নিজের সম্পাদিত পত্রিকা ‘সোমপ্রকাশে’ দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণ মধুসূদনের বিশেষ ছন্দরূপ প্রসঙ্গে লিখেছিলেন, ‘এখন দিন দিন লোকের মন যেমন উন্নত হইতেছে, তেমনি উন্নত পদ্য সৃষ্টিও আবশ্যক হইয়াছে। অতএব মাইকেল মধুসূদন দত্তের চেষ্টা যথোচিত সময়েই হইয়াছে, সন্দেহ নাই।’ একই অভিব্যক্তি ছিল ‘বিবিধার্থ সংগ্রহ’ সম্পাদক রাজেন্দ্রলাল মিত্রর কণ্ঠেও। তিনি লিখেছিলেন, ‘আমরা মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করতে পারি, এই নূতন ছন্দ বঙ্গভাষার শ্রীবৃদ্ধি সাধন করিবে।’ তবে প্রশংসার পাশাপাশি ওই সময় সমালোচনাও হয়েছিল। সবাই যে কবির এ কীর্তিকে শুরুতে স্বীকার করে নিয়েছিলেন, প্রশংসা করেছিলেন, তা কিন্তু নয়। ব্যঙ্গবিদ্রূপ করে অনেকেই সমালোচনা করেছিলেন। কোনো কিছুই গায়ে মাখেননি কবি। সৃষ্টির উল্লাসে সৃষ্টিতে নিমগ্ন হন। অমিত্রাক্ষর ছন্দেই রচনা করেন বাংলা সাহিত্যের অমূল্য রত্ন ‘মেঘনাদবধ কাব্য’, যা কবিকে শুধু খ্যাতিই দেয়নি, বাংলা সাহিত্যে অনন্য আসনে অধিষ্ঠিত করেছে। ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ রচনা করে মধুসূদন যেমন যশের অধিকারী হয়েছেন, তেমনি বাংলা সাহিত্যকেও নিয়ে গেছেন অনন্য উচ্চতায়।