কিংবদন্তির কখনো পতন হয় না

অনুশীলনে দারুণ ব্যস্ত ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো।ছবি: রয়টার্স

তারকারাজি সারা জীবন একই জায়গায় স্থির থাকতে পারে না, তাদেরও পতন হয়। জীবনভর কেউ একই রকম অবস্থায় থাকে না। পৃথিবীর নিয়ম এমনই। সেই সত্যই হয়তো ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো এখনো মেনে নিতে পারছেন না।

বয়স ৩৮ ছুঁই ছুঁই। চলতি মৌসুমে পারফরম্যান্সটাও ঠিক নামের সঙ্গে যাচ্ছে না। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের সঙ্গে তিক্ততা শেষ পর্যন্ত চুক্তি বাতিলে পৌঁছেছে। সবাই ধরে নিয়েছিল, বিশ্বকাপে সমালোচকদের কড়া জবাব দেবেন তিনি। কিন্তু চারটি ম্যাচ খেললেও নামের প্রতি সুবিচার করতে পারলেন কই। একটি গোল পেয়েছেন, তা-ও পেনাল্টিতে! সর্বশেষ ম্যাচে তো শুরুর একাদশে সুযোগও মেলেনি।

‘দ্য লায়ন কিং’ নামে হলিউডের একটা সিনেমা আছে। সেখানে বনের রাজা থাকে ‘মুসাফা’ নামের একটি সিংহ। আর তার সন্তানের চরিত্রের নাম ‘সিম্বা’। বাবার মৃত্যুর পর সে-ও একটা সময় বনের রাজা হয়। তার আগে অবশ্য মুসাফার ভাই ‘স্কার’ ওই জায়গা দখল করে নেয়। এই তিনটি চরিত্র পর্দায় সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তোলার মধ্য দিয়ে পরিচালক একটা বিষয় স্পষ্ট করেছেন, যত প্রভাবশালী রাজাই হোক, একটা সময় তার প্রভাব কমে যায় এবং শরীরেও সেই শক্তি থাকে না। নতুনকে সুযোগ দেওয়ার জন্য জায়গা ছেড়ে দিতে হয় কিংবা অন্য কেউ এসে সেই জায়গা দখল করে নেয়। পর্তুগিজ অধিনায়কও এখন ক্যারিয়ারের গোধূলিলগ্নে। তরুণদের সঙ্গে তাল মেলাতে পারছেন না!

পর্তুগিজ বেঞ্চে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো
ছবি: রয়টার্স

সর্বশেষ ম্যাচটির কথাই ধরা যাক। কাতার বিশ্বকাপে পর্তুগালের অধিনায়ক ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো গ্রুপ পর্বের প্রথম তিনটি ম্যাচেই ছিলেন শুরুর একাদশে। তবে তৃতীয় ম্যাচে তাঁকে মাঝপথেই উঠিয়ে নেন কোচ ফার্নান্দো সান্তোস। সেটা যে সিআরসেভেন ঠিক খুশি মনে মেনে নেননি, তা টেলিভিশনের পর্দায় স্পষ্টই দেখা গেছে। গুঞ্জন রয়েছে, এ নিয়ে নাকি কোচের সঙ্গে ক্রিস্টিয়ানোর মনোমালিন্যও হয়েছে। যদিও সেটা অস্বীকার করেছেন পর্তুগিজ কোচ। তবে গুঞ্জনটি আরও সত্যি হয় দ্বিতীয় রাউন্ডে সুইজারল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচে। দলটির ইতিহাসের সেরা তারকাকে ছাড়াই শুরুর একাদশ নামানো হয়।

সাইড বেঞ্চে বসে যে পাঁচবারের ব্যালন ডি’অরজয়ী মোটেও খুশি ছিলেন না, তা ক্যামেরায় বারবার ধরা পড়েছে। এমনকি তাঁর জায়গায় খেলতে নামা ২১ বছর বয়সী গনসালো রামোস যখন প্রথম গোলটি করেন, তখনো ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর চোখে উচ্ছ্বাস দেখা যায়নি। অবশ্য তাঁকে ছাড়াই ৬-১ গোলের বিশাল ব্যবধানে সুইসদের উড়িয়ে দিয়েছে পর্তুগিজরা। হ্যাটট্রিক করেছেন গনসালো রামোস। একে তো জাতীয় দলের হয়ে মাত্র চতুর্থ ম্যাচে মাঠে নামা এবং বিশ্বকাপে প্রথমবার শুরুর একাদশে, তার ওপর রোনালদোর জায়গায় খেলতে নামার একটা বিশাল চাপ! সব যেন অনায়াসে জয় করে ফেললেন এই তরুণ তারকা। একই সঙ্গে জানান দিলেন, রোনালদো-পরবর্তী যুগে দলের আক্রমণভাগের নেতৃত্বের ভার নিতেও তিনি প্রস্তুত।

ঠিক যেন সিনেমাটির মতোই চিত্রনাট্য! কেবল এ চিত্রনাট্যে ‘স্কার’ চরিত্রটি নেই। মুসাফা ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো থেকে উত্তরাধিকার সরাসরি চলে যাচ্ছে সিম্বা গনসালো রামোসের কাঁধে।

বিশ্বকাপের ৫টি ভিন্ন আসরে গোলের রেকর্ড গড়েছেন ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো
ছবি: এএফপি

দুই দশকের ক্যারিয়ারে ব্যক্তিগত প্রায় সবকিছুই অর্জন করেছেন ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো। টানা ১৫-১৬ বছর ধরে লিওনেল মেসির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ফুটবল বিশ্ব শাসন করেছেন। আন্তর্জাতিক ও ক্লাব—উভয় পর্যায়ে হয়েছেন ইতিহাসের সর্বোচ্চ গোলদাতা। দলীয়ভাবে কেবল বিশ্বকাপটাই জেতা বাকি। সেটা হলে ষোলোকলাই পূর্ণ হবে এই কিংবদন্তির। গোধূলিলগ্নটা হবে রঙিন।

সবশেষে শুরুর কথায় আবার ফিরে যাই। তারকারাজির পতন হলেও কিংবদন্তির কখনো পতন হয় না। ‘মুসাফা’র মতো রাজাদের প্রভাবও কখনো শেষ হয় না। তাঁরা যুগ যুগ ধরে বেঁচে থাকে। ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো বেঁচে থাকবেন ফুটবল ইতিহাসের পাতায়, কোটি কোটি মানুষের হৃদয়ে, গনসালো রামোসদের মতো তরুণদের অনুপ্রেরণা হয়ে।