এসডিজি রচনা প্রতিযোগিতা (প্রথম স্থান)

টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট
ছবি: সংগৃহীত

টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা কি টেকসই মাসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে কথা বলে?

সারসংক্ষেপ
বাংলাদেশে ৫ কোটি ৪০ লাখ প্রজননক্ষম কিশোরী ও নারীর (১০-৪৯) জন্য আলাদা করে মাসিক স্বাস্থ্যবিধি ব্যবস্থাপনার কোনো নীতিমালা নেই। অন্যদিকে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, জনসংখ্যা, পুষ্টি, লিঙ্গসমতা এবং কিশোর–স্বাস্থ্যের মতো বিভিন্ন প্রাসঙ্গিক খাতের কোনো জাতীয় নীতিই মাসিক স্বাস্থ্যবিধি ব্যবস্থাপনার জন্য একটি সমন্বিত পরিকল্পনা নিশ্চিত করে না। কিন্তু বৈশ্বিকভাবে বাংলাদেশ এমন কয়েকটি দেশের মধ্যে একটি, যে দেশের সরকার সক্রিয়ভাবে মাসিক স্বাস্থ্যবিধি ব্যবস্থাপনায় নিযুক্ত রয়েছে। যেহেতু সুনির্দিষ্ট কোনো নির্দেশিকা নেই। তাই বাংলাদেশ সরকার তাদের জাতীয় মাসিক স্বাস্থ্যবিধি ব্যবস্থাপনা কৌশলপত্র ২০২১-এ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও ইউনিসেফ কর্তৃক প্রবর্তিত মাসিক ব্যবস্থাপনার উপাদানগুলোকে অনুসরণ করার পরামর্শ দিয়েছে। যেখানে রক্ত শোষণকারী পরিচ্ছন্ন উপকরণ, পর্যাপ্ত গোপনীয়তা, সাবান ও পানির সুবিধা এবং মর্যাদার সঙ্গে একটি সুবিধাজনক নিষ্পত্তিব্যবস্থাকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু এ দেশে কিশোরী ও নারীদের মাসিক স্বাস্থ্যবিধিচর্চায় বেশ কিছু সাধারণ চিত্র সর্বত্র পরিলক্ষিত হয়। উদাহরণস্বরূপ, প্রতি তিনজনের মধ্যে একজন নারী মাসিকের সময় সাবান ব্যবহার করেন এবং অন্ধকার এবং স্যাঁতসেঁতে জায়গায় মাসিকের কাপড় শুকান। অধিকন্তু প্রায় ৫৭ শতাংশ প্রজননক্ষম নারী তাঁদের মাসিকের সময় পুরোনো কাপড় ব্যবহার করেন। তাঁদের মধ্যে মাত্র ১২ শতাংশ কিশোরী এবং ১৮ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক কাপড় সাবান এবং পরিষ্কার পানি দিয়ে ধুতে পারেন এবং পুনরায় ব্যবহারযোগ্য পুরোনো ন্যাকড়া রোদে শুকাতে পারেন।

অন্যদিকে শহুরে বস্তি এলাকায় প্রতি ৫০ জন ব্যক্তিকে একটি সাধারণ শৌচাগার ব্যবহার করতে হয়। এই বসতিগুলোতে পুরুষেরা বাড়ির বাইরে থাকলে নারীরা সে সময় শৌচাগার ব্যবহার করেন। এই প্রেক্ষাপটে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও ইউনিসেফের নির্দেশিকা অনুসরণ করে একজন নারী কীভাবে সুস্থ মাসিক স্বাস্থ্যবিধি বজায় রাখতে পারে, বিশেষ করে সেসব নারী, যাঁরা ভাসমান এবং দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছেন। এই প্রান্তিক নারীরা তাঁদের আর্থসামাজিক অবস্থার কারণে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় থাকেন। বাংলাদেশের প্রতিটি নারী মাসিকের স্বাস্থ্যবিধি ব্যবস্থাপনায় সমান সুযোগ পান না। বিভিন্ন ঋতুতে তাঁদের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট থাকে আলাদা। তাই ঋতুস্রাবের সময় নারীর দেশ-নির্দিষ্ট প্রেক্ষাপটগত চাহিদা ও চ্যালেঞ্জ উপেক্ষা করে কেবল বৈশ্বিক নীতি অনুসরণ এ সংকটকে দীর্ঘায়িত করছে। অন্যদিকে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা সরাসরি মাসিক ব্যবস্থাপনাকে অন্তর্ভুক্ত না করলেও লক্ষ্যমাত্রা ৩, ৪, ৫, ৬ এবং ৮–এর মতো লিঙ্গসমতা ও নারীর ক্ষমতায়ন সম্পর্কিত টেকসই উন্নয়নসমূহ ২০৩০ সালের মধ্যে অর্জিত হবে না, যদি সব নারীর জন্য মাসিক স্বাস্থ্যবিধি ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা না হয়।

মাসিক স্বাস্থ্যবিধি ব্যবস্থাপনা কী
মাসিক চক্র বা রজঃচক্র একটি বিশেষ শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া, যা সাধারণত ১০ থেকে ৪৯ বছর বয়স্ক নারীদের দেহে নিয়মিত ঘটে থাকে। এ বয়সে মেয়েদের প্রতি মাসে যোনিপথ দিয়ে যে রক্তস্রাব হয়, তাকে ঋতুস্রাব, মাসিক, পিরিয়ড বা স্থানীয় ভাষায় শরীর খারাপ বলে। বয়ঃসন্ধিকালে মাসিক খুব স্বাভাবিক একটি ব্যাপার; যা পরবর্তী সময়ে একজন নারীর মা হওয়াটা নিশ্চিত করে। সুতরাং এটা নিয়ে ভয় ও সংকোচের কোনো কারণ নেই। কিন্তু বাংলাদেশে মাসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা এখনো নীরব বিষয় হিসেবে প্রচলিত। অন্যদিকে মাসিক স্বাস্থ্যবিধি ব্যবস্থাপনা বলতে নারী বা কিশোরীর রজঃস্রাবের সময় রক্ত সংগ্রহ ও শোষণের জন্য পরিষ্কার উপাদান ব্যবহার করা, যা গোপনীয়তার সঙ্গে রজঃস্রাবের সময় প্রয়োজন অনুসারে পরিবর্তন করা। এ সময় পরিষ্কারের জন্য সাবান এবং ধৌতকরণের জন্য প্রয়োজনীয় পানি ব্যবহারের কথা বলা হয়। এ ছাড়া থাকতে হবে মাসিক বর্জ্যের সঠিক ব্যবস্থাপনা। কিশোরী ও নারীরা যেন তাঁদের ঋতুচক্র সম্পর্কিত প্রাথমিক তথ্য পান এবং কোনো প্রকার ভয়, অস্বস্তি ছাড়া মর্যাদার সঙ্গে মাসিক ব্যবস্থাপনা করতে পারে, সে বিষয়টি এ ব্যবস্থাপনায় উল্লেখ করা হয়েছে (ডব্লিউএইচও/ইউনিসেফ, ২০১২)। ইউনিসেফ নিজে তাদের প্রস্তাবিত এ ব্যবস্থাপনায় প্রান্তিক নারীদের জন্য দুটি বিষয়কে, যথা শারীরিক পরিচ্ছন্নতা এবং গোপনীয়তার সঙ্গে মাসিকের কাপড় পরিষ্কার ও শুকানোকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে চিহ্নিত করেছে (ইউনিসেফ, ২০২২)।

বাংলাদেশে ঋতুস্রাব ব্যবস্থাপনায় চর্চার ধরন এবং সুযোগের প্রাপ্যতা
ঋতুস্রাব এমন একটি বিষয়, যা বাংলাদেশে প্রকাশ্যে আলোচনা না করাটাকেই সামাজিক নিয়ম এবং  সাংস্কৃতিক বিশ্বাস বলে মনে করা হয়। তাই একজন কিশোরীর প্রথম যখন মাসিক হয়, তখনই সে তার মায়ের থেকে শিখে কীভাবে বিষয়টিকে সবার থেকে গোপন রাখতে হবে। নিম্ন আয়ের দেশের মতো বাংলাদেশেও অসংখ্য কিশোরী তাদের নিয়মিত মাসিক স্বাস্থ্যবিধি পরিচালনার জন্য সঠিক স্থান ও সুযোগ–সুবিধা পায় না। কিন্তু ঋতুস্রাবের মতো একটি প্রাকৃতিক ঘটনাকে এ দেশে নেতিবাচক প্রভাবের সঙ্গে লজ্জাজনক বলে মনে করা হয়। ফলে তা লুক্কায়িত এবং উপেক্ষিত হয়। বরং আর্থসামাজিক এবং সাংস্কৃতিক সীমাবদ্ধতার কারণে এটি একটি নিষিদ্ধ এবং কলঙ্কজনক  এমনকি এটি একটি নীরব এবং অদৃশ্য বিষয় হিসেবে পরিগণিত হয়েছে। (Talha & Alam, 2022)। কিন্তু মাতৃত্বের মতো ঋতুস্রাবও একটি মেয়ের জন্য প্রাক্‌-মাতৃত্বকালীন সময়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ (Cleveland Clinic,2019)। দক্ষিণ-এশীয় দেশগুলোর মতো বাংলাদেশেও ঋতুস্রাবের সঙ্গে জড়িত অনেক লিঙ্গ-নির্দিষ্ট নিষেধাজ্ঞা এবং মিথ রয়েছে, যা শেষ পর্যন্ত নারীদের এ সময় তাঁদের পরিবার এবং সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হতে বাধ্য করে (Garge & Anand,2015)। কলঙ্ক, লিঙ্গবৈষম্য এবং সমাজের বৈষম্যমূলক নিয়মের মতো সামাজিক ঘটনাগুলোর কারণে, প্রান্তিক নারীরা সম্পদের ওপর তাঁদের নিয়ন্ত্রণ হারান (ইউনিসেফ, ২০১৫)। ফলে এই নারীদের পর্যাপ্ত জ্ঞান, সুযোগ-সুবিধা এবং সামাজিক পরিষেবাগুলোতে সীমিত অথবা সুযোগ থাকে না বললেই চলে (Kirk &Sommer,2006)। তাঁদের ঋতুস্রাব নিরাপদে এবং মর্যাদার সঙ্গে পরিচালনা করার জন্য প্রায়ই বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশের অভাব হয় (Kaur&Kaur,2018)। এই বৈষম্য নারীদের বিভিন্ন সমস্যার মুখোমুখি করে।

উদাহরণস্বরূপ:
ঋতুস্রাব চলাকালীন ঋতুবর্তী নারীরা তাঁদের মাসিকের কাপড় পরিবারের পুরুষ সদস্যদের কাছ থেকে লুকিয়ে রাখেন। কারণ, তাঁরা বিশ্বাস করেন, যদি পুরুষেরা মাসিকের রক্ত দেখে ফেলে তাহলে তা তাঁদের জন্য দুর্ভাগ্য বয়ে আনবে। এই সময়ের মধ্যে নারীদের সামাজিক, ধর্মীয়, স্থানগত এবং খাদ্য গ্রহণে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হয়। তাঁদেরকে মাসিকের সময় মানতে হয় বিভিন্ন খাবারে নিষেধাজ্ঞা । মাসিককালীন সে যেমন বাসার বাইরে যেতে পারে না, তেমনি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, রান্নাঘরে প্রবেশে এমনকি গোসলেও অনেক সময় থাকে নিষেধাজ্ঞা (UNICEF, 2018)।
মাসিক চলাকালীন ঋতুবর্তী নারীরা রক্তস্রাব শোষণের জন্য নতুন বা পুরোনো কাপড় ব্যবহার করে থাকে। এসব কাপড় ধোয়ার পর তাঁরা গোপন জায়গায় শুকান, যাতে কোনো পুরুষের চোখে না পরে। ন্যাশনাল হাইজিন সার্ভে ২০১৮ অনুযায়ী, এ দেশে গড়ে প্রায় ৫৭ শতাংশ কিশোরী ও নারী তাঁদের মাসিকের সময় একই কাপড় বারবার ব্যবহার করেন। তন্মধ্যে মাত্র ১২ শতাংশ কিশোরী এবং ১৮ শতাংশ নারী তাঁদের মাসিককালীন ব্যবহৃত কাপড় পুনরায় ব্যবহারের জন্য সাবান ও পরিষ্কার পানি দিয়ে ধুয়ে সূর্যের আলোতে শুকানোর সুযোগ পান। বাকিরা পুরুষের মঙ্গলার্থে সঙ্গোপনে, অন্ধকার, স্যাঁতসেঁতে জায়গাটিকে বেছে নেন অস্বাস্থ্যকর উপায়ে কাপড় শুকানোর জন্য। অনেক মেয়ে স্থানাভাবে রোদের আলোতে মাসিকের কাপড় শুকাতে পারেন না। বর্ষাকালে বিষয়টি আরও জটিল আকার ধারণ করে (আকরাম, ২০২০)। ফলে তাঁরা সহজে বিভিন্ন রোগজীবাণুর সংক্রমণের শিকার হন। আমাদের দেশে শুধু মাসিকে অস্বাস্থ্যকর ব্যবস্থাপনার জন্য লিউকোরিয়া (অনবরত সাদা স্রাব নির্গত হওয়া) রোগীর সংখ্যা প্রচুর (আকরাম, ২০২১)। এতে নারীর রিপ্রোডাকটিভ সিস্টেম ঝুঁকির মুখে পড়ে। অন্যদিকে ৮৩ শতাংশ বস্তিবাসীদের প্রতি ৫০ জনের জন্য মাত্র একটি   শৌচাগারের ব্যবস্থা থাকে (Practical Action, 2017)। এ থেকে খুব সহজেই অনুমেয় হয়, মাসিককালীন ব্যক্তিগত সুরক্ষা এবং গোপনীয়তার অভাবে একজন প্রান্তিক নারীর জন্য এ সময়টা কতটা ভয়াবহ হয়ে ওঠে। দীর্ঘদিন ও দীর্ঘক্ষণ অপরিষ্কার কাপড় ব্যবহারের কারণে নারীদের জরায়ুমুখের ক্যানসার, ইনফেকশন, যৌনাঙ্গে ঘা, চুলকানি, অস্বাভাবিক সাদা স্রাব প্রভৃতি শারীরিক সমস্যা দেখা দেয়। দেশে প্রতিবছর ১০ হাজার নারী মারা যাচ্ছেন জরায়ুমুখের ক্যানসারের কারণে (প্রথম আলো,২০২২)।

কিন্তু যাঁরা স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার করেন তাঁদের জন্যও কি বিষয়টিতে সমতা নিশ্চিত হচ্ছে? ন্যাশনাল হাইজিন সার্ভে ২০১৮ অনুযায়ী, দেশে ১০-৪৯ বছর বয়সী নারীদের প্রায় ৩৬ শতাংশ গড়ে মাসে ১০টি স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার করে বছরে ৯০৩৯ মেট্রিক টন বর্জ্য উৎপাদন করছে, যা সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাবে পুরোপুরি অনিষ্পত্তিযোগ্য এবং ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের জন্য একটি ভয়াবহ চ্যালেঞ্জ হতে যাচ্ছে (Akram,2021)। তবে বিষয়টি কেবল বর্জ্য উৎপাদনে সীমিত নয়।
নারীর স্বাস্থ্য সুরক্ষা ফোরাম (নাসাসু) বলে, মাসিক সুরক্ষা পণ্যের (স্যানিটারি প্যাড, টেম্পুন, মেনস্ট্রুয়াল কাপ) উচ্চমূল্যের কারণে বেশির ভাগ নারী মাসিকের সুরক্ষা থেকে বঞ্চিত হন। নাসাসু দেখেছে, প্রায় প্রতি বাজেটে মাসিক সুরক্ষার পণ্যকে ‘বিলাসী দ্রব্য’ বিবেচনা করে এর ওপর উচ্চ শুল্ক ও কর বসানো হয়। রাষ্ট্রীয়ভাবে মাসিক সুরক্ষা বিষয়টি না দেখে এটিকে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের একচেটিয়া ক্ষমতার অধীনে দেওয়া হয়। এর ফলে নারীর মাসিকের মতো গুরুত্বপূর্ণ শারীরবৃত্তীয় বিষয় নিয়ে রীতিমতো পণ্যায়নের প্রতিযোগিতা হচ্ছে। পাশাপাশি এর ওপর পিংক ট্যাক্স বসিয়ে এর মূল্য সাধারণ নারীর হাতের নাগালের বাইরে রাখা এবং ব্যবসায়িক স্বার্থ বিবেচনা করে ক্ষতিকর রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করার ফলে নারীর স্বাস্থ্যে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি করার পথ সুগম করা হচ্ছে (সারাবাংলা,২০২১)। জাতীয় মাসিক স্বাস্থ্যবিধি ব্যবস্থাপনা কৌশলপত্র ২০২১-এও উল্লেখ করা হয়েছে, মাসিক স্বাস্থ্যবিধি ব্যবস্থাপনার পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে এর কাঁচামালের ওপর ভ্যাট প্রত্যাহার করা হলেও ১৫ শতাংশ কর ধার্য করায় উৎপাদন পরবর্তী তৈরি পণ্যের উচ্চমূল্য নির্ধারিত হচ্ছে। ফলে অনেক বালিকা এবং নারীরা বাণিজ্যিক এই পণ্য ক্রয়ের সক্ষমতা রাখেন না।

এ ছাড়া নানা কুসংস্কারে প্রায় ৮৬ ভাগ মেয়ে স্কুল বা বাইরে থাকলে প্যাড পরিবর্তন করে না (মজুমদার, ২০১৭)। কারণ, দেশের বেশির ভাগ স্কুল-কলেজের টয়লেট মাসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার উপযোগী নয়। এসব নন–ফাংশনাল টয়লেটগুলোতে কাপড় পরিবর্তন করার সুযোগ থাকে না এবং ব্যবহৃত ন্যাপকিন ফেলারও কোনো ব্যবস্থা থাকে না। অথচ স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞদের মতে, ছয় ঘণ্টা অন্তর ন্যাপকিন পাল্টানো দরকার। তা না হলে ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণের ঝুঁকি থাকে এবং নানা রোগ দেখা দিতে পারে (প্রথম আলো, ২০১৮)। অন্যান্য নিম্ন আয় এবং মধ্যম আয়ের দেশের মতো, প্রায় সব কিশোরী মেয়ে আমাদের দেশে স্কুলে উপযুক্ত এবং সুবিধার অভাবের শিক্ষা খাতে বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। ফলে মাসিকের সময় দেশের অনেক কিশোরী স্কুলে যায় না, এমনকি পরীক্ষায়ও অংশ নেয় না। যা তাদের পড়াশোনায় প্রভাব ফেলছে (ইউনিসেফ,২০১৫)। অথচ এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা ৪.১-এ বলা হয়েছে, ছেলেমেয়ে সবার জন্য সমতাভিত্তিক শিক্ষা নিশ্চিত করা (বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশন,২০১৭)। অন্যদিকে সারা দেশে ১ কোটি ৬২ লাখ কর্মজীবী নারীর জন্য একটিও পাবলিক  ফাংশনাল টয়লেট নেই, যেখানে একজন নারীর জন্য পর্যাপ্ত পানি, সবান, ঢাকনাযুক্ত ময়লা ফেলার বিন, নিশ্ছিদ্র লক সিস্টেম, পর্যাপ্ত আলো বাতাস সর্বোপরি ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে এই সব কটি উপাদানের একযোগে সমন্বিত আছে (স্যানাল, ২০১৯; আকরাম, ২০২২; সুলতানা, ২০২২)। সেখানে গর্ভবতী, শারীরিক প্রতিবন্ধী নারীরা কীভাবে উপেক্ষিত, তা সহজেই অনুমেয়। এসব নারীর উপযুক্ত কর্মপরিবেশের অভাবে ক্ষমতায়ন কীভাবে নিশ্চিত হচ্ছে, তা এখন ভাবার বিষয়।

টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা, বাংলাদেশ সরকার এবং টেকসই মাসিক স্বাস্থ্যবিধি ব্যবস্থাপনা

টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা কেবল পরিবেশ সংরক্ষণ এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নই নয়; বরং সামাজিক এবং মানবিক উন্নয়নও এর আওতাভুক্ত। যেহেতু এটি মানবিক উন্নয়ন নিয়েও কথা বলে তাই টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট ১৭টির মধ্যে ৩ এবং ৬ নম্বরে উল্লেখ্য আছে, সব বয়সী সব মানুষের জন্য সুস্বাস্থ্য ও কল্যাণ নিশ্চিতকরণ এবং সবার জন্য পানি ও স্যানিটেশনের টেকসই ব্যবস্থাপনা এবং প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে হবে (বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশন,২০১৭)। এমনকি ৪, ৫, এবং ৮ নম্বর লক্ষ্যে উল্লেখ আছে মানসম্মত শিক্ষা ও কর্মদক্ষতার সঙ্গে সম্পর্কিত বিষয়, নারী-পুরুষের সমতা এবং সব নারী ও মেয়ের ক্ষমতায়নের কথা। তন্মধ্যে লক্ষ্যমাত্রা ৫.১-এ সুস্পষ্টই উল্লেখ আছে, সর্বত্র নারী ও মেয়ের বিরুদ্ধে সব ধরনের বৈষম্যের অবসান ঘটানোর কথা (বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশন, ২০১৭)। কিন্তু টেকসই উন্নয়নের অভীষ্ট লক্ষ্যমাত্রাতেই নারীর জন্য একটি বড় বৈষম্য হলো লক্ষ্যমাত্রার কোথাও নারীদের মাসিক বা ঋতুস্রাব স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে কোনো কথা বলা হয়নি। এমনকি  লক্ষ্যমাত্রা ৬-এ স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে কথা বলা হলেও সেখানেই নারীর মাসিক ব্যবস্থাপনার বিষয়টি অনুল্লিখিত। কিন্তু মাসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এবং এটি সুস্বাস্থ্য ও কল্যাণ নিশ্চিতকরণের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। দুশ্চিন্তার বিষয় হলো, এ দেশে নারীদের মাসিক স্বাস্থ্যবিধি ব্যবস্থাপনাবান্ধব কোনো রাষ্ট্রীয় এমনকি সামাজিক নীতিমালাও নেই (হাসান, ২০১৮)।

সম্প্রতি ইউনিসেফের সহায়তায় স্থানীয় সরকার বিভাগের পলিসি সাপোর্ট ব্রাঞ্চ (পিএসবি) বাংলাদেশের জন্য একটি জাতীয় মাসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা কৌশলপত্র প্রণয়ন করেছে, যা স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের ওয়াটার সাপ্লাই অ্যান্ড স্যানিটেশন জাতীয় ফোরাম কর্তৃক অনুমোদিতও হয়েছে (National Menstrual Hygiene Management Strategy,2021)। জাতীয় পর্যায়ে এ ধরনের একটি অত্যন্ত সুচিন্তিত ও সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে প্রণীত কৌশলপত্র অত্যন্ত সময়োপযোগী এবং বহু প্রতীক্ষিতও বটে। কৌশলপত্রটিতে মূলত নিম্ন ও মধ্যম আয়ের বালিকা, নারী যাঁরা বস্তিতে বসবাসকারী এবং বাস্তচ্যুত বা জরুরি পরিস্থিতিতে প্রান্তিক নারীদের অবস্থানকে তুলে ধরা হয়েছে। নারীর অধিকার ও ক্ষমতায়নে মাসিক স্বাস্থ্যবিধি ব্যবস্থাপনাকে বিবেচনায় আনতে হবে, তা সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে । কিন্তু একটি সামগ্রিক কৌশলপত্র তৈরির চেয়ে সেটি সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং। এখানে বিভিন্ন স্টেকহোল্ডার, সেবা প্রদানকারী সংস্থা এবং মন্ত্রণালয়গুলোর মধ্যে যে ধরনের আন্তসমন্বয়, স্থানীয় উদ্যোগ, জনসম্পৃক্ততা প্রয়োজন, তা নিশ্চিত করতে হলে কৌশলপত্রটি বাস্তবায়নের শুরুতেই বাজেটসহ একটি কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা দরকার। এ জন্য সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও সেবা প্রদানকারী সংস্থার সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে (জাহান ও রহমান, ২০২১)। নতুবা টেকসই মাসিক স্বাস্থ্যবিধি ব্যবস্থাপনার কথা কেবল কাগজে–কলমে থাকবে, যার কোনো প্রায়োগিকতা লক্ষ করা যাবে না।

পরিশেষে, জাতীয় মাসিক স্বাস্থ্যবিধি ব্যবস্থাপনা কৌশলপত্রটি কার্যকরভাবে বাংলাদেশের প্রতিটি প্রাপ্তবয়স্ক নারীর স্বাস্থ্য, শিক্ষা, অর্থনৈতিক ও অন্যান্য অধিকার আদায় করার জন্য নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ মাসিক ব্যবস্থাপনা অভিগমন নিশ্চিত করার কথা বলে। কিন্তু মাসিক নিয়ে এখন আমরা কেবল আর কথা বলাতেই সন্তুষ্ট নই, এখন সময় এসেছে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ এবং বিনিয়োগ বাড়ানোর। নতুবা ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অনেকটাই বাধাগ্রস্ত হবে কেবল টেকসই মাসিক স্বাস্থ্যবিধি ব্যবস্থাপনার প্রায়োগিকতার অভাবে। আর এর প্রভাবে শিক্ষা, স্বাস্থ্য বা কর্মক্ষেত্রে লিঙ্গ–অসমতায় নারীর ক্ষমতায়ন টেকসই হবে না।

সহযোগী অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ,
হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়