ধূমকেতুর জানালায় ঈদের প্রহর

ট্রেনপ্রতীকী ছবি

ঠিক এই মুহূর্তে আমি যেন এক নিঃশব্দ রহস্যের সাক্ষী। হৃদয়ের গভীরে গড়ে উঠছে এক অপার্থিব পুলক। যেন ভাগ্য নিজ হাতে পুরোনো স্মৃতির পাতায় আবার আঁকছে সেই একই চিত্রপট। গত ঈদের মতো এবারও একই ট্রেন, একই সিট, একই সকাল—এমনকি সময়টাও যেন পূর্বলিখিত ভাগ্যনামায় টানা টানা করে লেখা!

বিস্ময় জাগায়, প্রকৃতির আচরণও যেন অনুরূপ। আকাশে ঘন মেঘ, চারপাশে অদ্ভুত অন্ধকার। ঠিক সেই মুহূর্তে ‘ধূমকেতু’ নামের লোহার দানবটা ছুটে চলছে বিমানবন্দর স্টেশন ছাড়িয়ে। ঘড়ির কাঁটা বলছে সকাল ৭টা ৩২ মিনিট।

জানালায় কনুই রেখে, মাথা ঠেকিয়ে দেখি চলন্ত দৃশ্যপট। বাতাসের গন্ধ, রেলের ঝিকঝিক শব্দ আর বৃষ্টির ছোঁয়া মিলে এক নিঃসীম প্রশান্তি এনে দেয়। ভেতর থেকে বেজে ওঠে প্রিয় গান ‘স্বপ্ন যাবে বাড়ি আমার...।’ সেই সুর হৃদয়ের অলিন্দে বইয়ে দেয় এক আবেগঘন ঢেউ। মস্তিষ্কে যেন ধীরে ধীরে ঝরে পড়ছে ডোপামিন, বৃষ্টির টুপটাপ ধারার মতো।

জানালার কাচে বৃষ্টির ফোঁটা। একটি ফোঁটা গড়িয়ে এসে আমার কনুই ছুঁয়ে যায়। এক তীব্র শিহরণে কেঁপে ওঠে শরীর। মুখে ফুটে ওঠে এক প্রশান্ত, নীরব হাসি। চোখ পড়ে সামনের প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে থাকা এক রমণীর দিকে, যেন বৃষ্টিভেজা কোনো অপ্রকাশিত কবিতা। তাঁর চোখে নিঃশব্দ এক আকাশ।
ঠিক তখনই পেছন থেকে কণ্ঠ ভেসে আসে,  ‘ভাইয়া, ডোপামিন ব্যাপারটা কী?’
চমকে তাকাই। দেখি, এক কিশোর আমার পেছনে দাঁড়িয়ে মুঠোফোনে আমার লেখা পড়ছে। হেসে বলি, ‘ডোপামিন হলো মনের আনন্দের স্বাভাবিক জোয়ার। এই হরমোন আমাদের মস্তিষ্কে নিঃসৃত হয়। আর তাতেই জাগে প্রশান্তি, সুখ আর প্রেরণা।’
সে বলে, ‘ভাইয়া, আপনি দারুণ লেখেন!’
তার প্রশংসায় একটু গর্বিত হই। পরমূহূর্তে চোখ ফেরাতেই দেখি, রমণীটি নেই। যেন হাওয়ায় মিশে গেছে, রেখে গেছে শুধু এক চিরস্থায়ী কবিতার আভাস।

আবার জানালার বাইরের দিকে দৃষ্টি মেলে ডুবে যাই প্রকৃতির আঁচলে। মন ছুটে চলে এক গোপন ঠিকানার দিকে, আমার স্বপ্নবাড়ি, আমার গ্রাম। সেখানে আছেন মা, যাঁর মুখ দেখার জন্য প্রতিটি রক্তকণিকা ব্যাকুল। আছেন একমাত্র বড় বোন, যাঁর হাতের ফালুদা ঈদের সকালকে করে তোলে অলৌকিক। আর আছেন বাবা, যিনি চা বানাতে না জানলেও তাঁর প্রতিটি বাক্যে ঢেলে দেন জীবনদর্শনের অমৃত।

হঠাৎ মাথার ভেতর দুলে ওঠে আরেকটি স্বপ্ন, আমার নিজ গ্রামে গড়ে তুলব একটি পাঠাগার। নাম হবে ‘কুঞ্জকানন’। সেখানে শিশুরা, শ্রমজীবী মানুষেরাও বইয়ের পাতায় খুঁজে পাবেন নিজেকে। থাকবে গল্প, প্রবন্ধ আর কবিতার সুর, যা বদলে দিতে পারে জীবন।

এখন বুঝতে পারি, ক্ষণিকের রমণীরা নয়, সাময়িক মোহ নয়, আমার জন্ম হয়েছে লিখতে। এই জানালার পাশে বসে, এই বৃষ্টির মধ্যে, ঘরমুখী মানুষের সঙ্গে একই নিশ্বাসে বাঁচতে। কলমে থাকবে মায়ের মুখ, ফালুদার স্বাদ, বাবার কথা, আর কুঞ্জকাননের স্বপ্ন।
বৃষ্টির শব্দ জানালার কাচে বাজে স্নিগ্ধ ছন্দে। মন থেকে গেয়ে উঠি, ‘স্বপ্ন যাবে বাড়ি আমার...।’

ট্রেন ছুটে চলে পাবনার পথে। বুকের গভীরে ছুটে চলে আরেকটি ট্রেন, শৈশবের উঠান, সন্ধ্যার পাখির ডাক, বড় বোনের হাতের মিষ্টি, মায়ের চোখের জল আর পাঠাগারের স্বপ্ন বুকে নিয়ে।

শিক্ষার্থী, নিউ মডেল ইউনিভার্সিটি কলেজ, ঢাকা