নিরাবরণ

রেলস্টেশন, প্রতীকীছবি: সংগৃহীত

‘পাঁচটা টাকা হবে?’

আমি ঘুরে তাকালাম। যুবকের বয়স ২২-২৩ বছর হবে। পরনে প্যান্ট আর নীল রঙের হাফহাতা গেঞ্জি। মানিব্যাগ খুলে ১০ টাকার একটা নোট বের করে দিলাম। টাকাটা হাতে নিয়ে সে একটু সামনে এগিয়ে গেল। তারপর দোকান থেকে একটা সিগারেট কিনল। সিগারেট মুখে দিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে আমার সামনে দিয়ে চলে গেল। পেছন থেকে ডাক দিলাম। ছেলেটি দাঁড়াল না। মনে হয় আশপাশের মানুষের চেঁচামেচিতে ঠিক শুনতে পায়নি। পাঁচ টাকায় সিগারেট কিনে বাকি পাঁচ টাকা পকেটেই রেখে দিয়েছে।

রেলস্টেশন আমার খুব প্রিয় একটি জায়গা। সময় পেলেই চলে আসি। প্ল্যাটফর্মে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করি। বিচিত্র মানুষের সঙ্গে দেখা হয়। ট্রেনে ঝুলে আসা যাত্রীর ফ্যাকাশে চেহারা আর ট্রেনের জানালা দিয়ে উঁকি দেওয়া মুখ; এসব দেখে তাকিয়ে থাকি। টঙে বসে থাকা দোকানদার আর মাথায় ঝুড়ি নিয়ে হাঁটাহাঁটি করা দরিদ্র হকার দেখলে পার্থক্য খুঁজে পাই না। সবাই বেঁচে থাকার জন্য কত সংগ্রাম করে যাচ্ছে। হাইস্কুলের বাংলার শিক্ষক হয়েও আমি অসুখী নই।

বৃহস্পতিবার অর্ধবেলা স্কুল। বাসায় এসে একটু বিশ্রাম নিই। তারপর আশপাশের গ্রামগুলোতে হেঁটে, কখনোবা রিকশায় করে ঘুরে বেড়াই। বেশ ভালো লাগে। ছুটির দিনে দূরে কোথাও যাওয়ার চেষ্টা করি। রুটিন অনুযায়ী চলার চেষ্টা করে ব্যর্থ হই। বড্ড একঘেয়ে লাগে। ছাত্রজীবনে রুটিন অনুযায়ী চলেছি। সেই সময়টা কোনোরকমে কাটিয়ে দিয়েছি। এখন আর সেভাবে চলতে পারি না।

একদিন স্টেশনের কাছে সস্তা একটা রেস্তোরাঁয় ঢুকেছি। বাইরে চা তেমন একটা খাই না। সেদিন কী মনে করে চা খেতে ইচ্ছা হলো। একটা শুকনা রুটি আর সামান্য হালুয়া নিয়ে বসেছি। চা হাতে নিয়ে একজন সামনে এসে দাঁড়াল। চেয়ে দেখি সেই যুবক, যাকে সিগারেট কেনার টাকা দিয়েছিলাম! পুনরায় তার সঙ্গে দেখা হওয়ায় ভাবছি স্টেশনে কত মানুষকে দেখি। কারও সঙ্গে মুহূর্তের পরিচয় হয়। কিন্তু পরেরবার আর দেখা হয় না সহজে।
ছেলেটি আমাকে দেখে একটু হাসার চেষ্টা করল। বললাম, ‘কী ব্যাপার, এখানে কাজ করো নাকি?’
‘জি।’ বলেই আবারও একটু মুচকি হাসল।
‘চা কি তুমি বানিয়েছ?’
‘জি।’
‘নাম কী?’
‘আলমগীর।’
আমি বললাম, ‘আলমগীর, তোমাকে দেখলে কিন্তু বোঝা যায় না যে, তুমি একজন হোটেলের পরিচারক। বাড়ি কোথায় তোমার?’
‘নেত্রকোনা।’
‘ভৈরবে নতুন?’
‘জি। রাগ করে চলে এসেছি।’
‘রাগ করে? রাগ করে বাড়ি ছাড়াটা নেহাত বোকামি ছাড়া অন্য কিছু না।’
আলমগীর অন্যদিকে তাকিয়ে বলল, ‘বাড়িতে আর যাব না।’

পালিয়ে এসে অনেকেই এমন বলে। রাগ কমে গেলে কিংবা সমস্যায় পড়লে সব ভুলে যেতে হয়।

সেদিন কিছু জানা হলো না দেখে আমার ঠিকানাটা ওকে দিয়ে এসেছিলাম। ছুটির দিনে সে আসবে বলেছিল। ভেবেছিলাম আসবে না বোধ হয়। কিন্তু তিন দিন পর হঠাৎ বিকেলে আমার বাসায় এসে উপস্থিত সে।

রেস্তোরাঁ প্রায় পুরোটাই ফাঁকা। আলমগীর এখন অবসর আছে ভেবে ওকে পাশের চেয়ারটাতে বসতে বললাম। সে একটু ইতস্তত করে সামনের চেয়ারটায় বসল। নিজ জেলার অপরিচিত লোক। ভাবলাম একটু পরিচিত হওয়া যাক। ক্যাশ টেবিলে বসা ম্যানেজার ইতিমধ্যে ব্যাপারটা লক্ষ করেছেন। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে সাদা দাড়িতে হাত বোলাতে বোলাতে স্বাভাবিক হয়ে বসে আছে।
আলমগীরকে বললাম, ‘আমারও গ্রামের বাড়ি নেত্রকোনা। এখানে একটা হাইস্কুলে বাংলা পড়াই।’ শুনে আবারও মুচকি হাসল সে। তারপর বলল, ‘আপনার সঙ্গে পরিচিত হয়ে ভালো লাগল, স্যার।’
বললাম, ‘বাড়ি থেকে চলে আসার গল্পটা কি বলা যাবে?’
সে বিনয়ের সঙ্গে বলল, ‘আজ একটু কাজ আছে, স্যার। অন্যদিন সময় পেলে আসবেন। তখন বলব।’

সেদিন কিছু জানা হলো না দেখে আমার ঠিকানাটা ওকে দিয়ে এসেছিলাম। ছুটির দিনে সে আসবে বলেছিল। ভেবেছিলাম আসবে না বোধ হয়। কিন্তু তিন দিন পর হঠাৎ বিকেলে আমার বাসায় এসে উপস্থিত সে। তাকে সোফায় বসতে বলি। এমন সময় পাঁচ বছরের ছোট্ট মেয়ে সুমনা অতিথি দেখে আহ্লাদিত হয়ে আমার কোলের কাছে এসে বসে রইল। জিজ্ঞেস করল, ‘এই ভাইয়াটাও কি তোমার ছাত্র ছিল, বাবা?’
আমি বললাম, ‘না, মা। স্টেশনে পরিচয়।’
‘তুমি স্টেশনে গিয়েছিলে? আমাকেও স্টেশনে নিয়ে যাবে, বাবা?’
সুমনার গালে চুমু খেয়ে বললাম, ‘অবশ্যই নিয়ে যাব, বাবা। তুমি এখন মার কাছে যাও।’
সুমনা কোল থেকে নেমে চলে গেল। আলমগীর বলল, ‘আপনার মেয়েটি খুব সুন্দর করে কথা বলে।’
‘হ্যাঁ। নামের সঙ্গেও ওর বেশ মিল। তোমার খবর কী? ভেবেছিলাম হয়তো আমার কথা ভুলেই গেছ।’
‘না, স্যার। ভৈরবে এসে কারও সঙ্গেই বিশেষ পরিচয় হয়ে ওঠেনি। এখানে মানুষ আছে অনেক, কিন্তু মন খুলে কথা বলার মানুষ চোখে পড়েনি। রেস্তোরাঁয় আপনার সঙ্গে কথা বলে ভালো লেগেছিল। তাই ভাবলাম একদিন দেখা করে আসি।’

কথা শুনে মনে হলো সে যথেষ্ট শিক্ষিত এবং ভদ্র। ওর অমায়িক আচরণ এবং পরিচ্ছন্ন ভাব দেখে কেউ বলবে না যে সে কোনো সাধারণ পরিবেশে বড় হয়েছে।
তারপর অনেক কথা হলো। যা সন্দেহ করেছিলাম, তার চেয়ে একটু বেশি।
নেত্রকোনা জেলার মোহনগঞ্জে ছেলেটার বাড়ি। আর্থিক সচ্ছলতা যথেষ্ট। বাজারে কাপড়ের দোকান আছে দুটি। আলমগীর বলতে থাকল—

‘দশম শ্রেণিতে পড়ার সময় সহপাঠীর প্রেমে পড়ি। মেয়েটির নাম রোকসানা। কিছুদিনের মধ্যেই আমাদের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তারপর একই কলেজে ইন্টারমিডিয়েট শেষ করে অনার্সে ভর্তি হই। দিনগুলো বেশ ভালোই চলছিল। রোকসানার বিয়ের বয়স পার হয়ে যাচ্ছে ভেবে ওর পরিবার যখন বিয়ে বিয়ে করছিল, তখন আমি নিজেই তার বাসায় গিয়েছিলাম। আমাকে ভালো চোখেই দেখেছিল তারা। আমরা দুজনই বেশ খুশি। এত দিনের প্রণয় যে এবার পরিণয় পেতে যাচ্ছে।’

‘আমার কথায় ওর মা–বাবাও রাজি ছিল প্রথমে। কিন্তু পরিবারের সদস্যদের নিয়ে যেদিন মেয়ে দেখতে যাই, সেদিন ঝামেলা বাধল। জমিসংক্রান্ত আগের এক ঝামেলা নিয়ে দুই পরিবার মুহূর্তেই আক্রমণাত্মক হয়ে উঠল। চেঁচামেচি, হইচই করে আমরা বাসা থেকে বেরিয়ে আসি। কোনো দিনও আত্মীয়তা হবে না বলে উভয় পরিবার শপথ গ্রহণ করল।
সবশেষে ব্যাপারটা এমন হলো যে, যে রাতে রোকসানার বিয়ে হচ্ছিল সেই রাতে কৌশলে আমারও বিয়ের আয়োজন করা হয়। আমাকে বলা হয়েছিল বিয়ে রোকসানার সঙ্গেই হচ্ছে। একইভাবে রোকসানাও জেনেছিল আমার সঙ্গেই ওর বিয়েটা হচ্ছে। কিন্তু দুজনের ক্ষেত্রেই ব্যাপারটা উল্টো হয়ে দাঁড়াল। পরে বুঝতে পারলাম মামাতো বোন আরিফার সঙ্গে বিয়ের কাজটা সম্পন্ন হয়েছে। তখন রাগে, দুঃখে সেদিনই বাড়ি থেকে পালিয়ে চলে আসি।’

ভৈরবে এসে প্রথমে কিছুদিন বেকার ঘুরে বেড়ায় আলমগীর। অর্থসংকটে পড়লে স্টেশনে মানুষজনের কাছে গিয়ে টাকা চাইত। কেউ দিত, কেউ দিত না। টাকা পেলে সিগারেট কিনত। রোকসানাকে ভুলে থাকার জন্য সিগারেট খাওয়া শুরু করে সে। শুনে অবাক হলাম। তারপর পেটের দায়ে একদিন চক্ষুলজ্জা ভুলে রেস্তোরাঁয় পরিচারকের কাজ নিল।
আলমগীর চুপ হয়ে বসেছিল। বললাম, ‘সিগারেট আছে সঙ্গে?’
ঠাট্টা বুঝতে না পেরে সে প্রথমে বিব্রত হয়ে আমার দিকে তাকাল। তারপর মৃদু হাসল। জোর করেই হাসার চেষ্টা করছে। আহ্! বেচারা রোকসানাকে পেল না। আবার সিগারেটে আসক্ত হয়েছে ভুলে থাকার চেষ্টায়। প্রেম হচ্ছে বাঁচিয়ে রাখার বিষয়, ভুলে থাকার বিষয় না।

সুমনা আবার কোলে এসে বসল। আস্তে আস্তে বলল, ‘মা ঘুমুচ্ছে। আমার ঘুমাতে ইচ্ছা করছে না, বাবা। তোমার কাছে এসেছি বলে রাগ করেছ?’
আমি বললাম, ‘না, মা। একটুও রাগ করিনি।’
সুমনা আমার ডান গালে চুমু খেল। আলমগীর বেশ আগ্রহ নিয়ে ব্যাপারটা লক্ষ করল। আমি বললাম, ‘বুঝলে আলমগীর, আমারও একটা রোকসানা ছিল। তাকে হারিয়েছি সড়ক দুর্ঘটনায়। বাস থেকে এক পা মাটিতে ফেলতেই বাসটা ছুটতে শুরু করেছিল। তাল সামলাতে না পেরে মাথায় প্রচণ্ড আঘাত পায়, আর সামনের চাকাটা ওর বাঁ পায়ের ওপর দিয়ে চলে গিয়েছিল। ওর হাতটা ধরতে পারিনি তখন। যদি ধরতে পারতাম তাহলে বেঁচে যেত হয়তো। অনুশোচনায় প্রথম কয়েক দিন ছন্নছাড়া হয়ে পড়ে রইলাম। সময়ের কোনো খেয়াল ছিল না।’

আলমগীর স্থির হয়ে বসে রইল। ধীর গলায় বলল, ‘আমি এখন কী করব, স্যার।’
বললাম, ‘দুই পরিবারের কলহ ও অস্থিরতার কারণে যা ঘটেছে, তার জন্য তুমি অন্য একটি মেয়েকে কষ্ট দিতে পারো না। এখন যদি স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে পারো এবং তাকে যদি স্ত্রীর মর্যাদা দাও তাহলেই বেশ হবে।’
‘আমি যদি রোকসানার জন্য অপেক্ষা করি?’
‘এটা ভেবো না কখনোই।’
‘কেন স্যার? আমরা তো জীবিতদের জন্যই অপেক্ষা করি, মৃতদের জন্য না।’
বললাম, ‘মাঝেমধ্যে জীবিতদের মধ্যে কাউকে মৃতের চেয়েও বেশি কিছু ভাবতে হয়। প্রেম বিষয়টা আবশ্যক। রোকসানা তোমার সঙ্গে প্রেমখেলা খেলেনি। যদি তোমার সঙ্গে প্রতারণা করা হয়ে থাকে, তাহলে সেটা করেছে দুজনের পরিবার। মাঝখানে তোমার নববধূ কষ্ট পাবে কেন? ভালোবেসে কাউকে চাওয়াটাই প্রেম। পেয়ে গেলে ট্রফি জয়ের মতো মনে হবে। তখন চকচক করতে থাকা ট্রফিটাই শুধু চোখে ভাসবে, প্রেম না। বুঝেছ আলমগীর? মেনে নিতে হবে। তবে ভুলে যাওয়া চলবে না। অন্য কারও চোখে হলেও সেই প্রেমকে জাগিয়ে রাখতে হবে।’
আলমগীর বলল, ‘কিন্তু আমি রোকসানাকে ছাড়া অন্য কাউকে চিন্তাই করতে পারি না।’

তারপর আরও কথা হলো। সে মনোযোগ দিয়ে আমার কথা শুনল। অনেকটা সময় কেটে গেল। বড় কোনো বাণী শুনিয়ে কাউকে প্রভাবিত করার ইচ্ছা ছিল না।
আজ আর কোথাও বের হতে পারিনি বলে তেমন আফসোস হলো না। প্রসঙ্গ বদলে বললাম, ‘ভৈরব শহরটা তোমার কাছে কেমন লাগল?’
‘মন্দ না। এই কয়েক মাসে অনেক ঘুরেছি। অনেকের সঙ্গেই পরিচয় হয়েছে। যতটুকু বুঝলাম, এখানকার অধিকাংশ মানুষই বাইরে থেকে এসেছে। আমি যেখানে কাজ করি, সেই রেস্তোরাঁর মালিকও এখানকার স্থায়ী বাসিন্দা না।’

বিদায় নেওয়ার সময় হলে ছেলেটা বলল, ‘আপনি যা যা বলেছেন তার কতটুকু মেনে নিয়েছি, তা বলব না। তবে আমার ভালো লেগেছে। আর একটা কথা বলতে ভুলে গিয়েছিলাম, যার সঙ্গে আমার বিয়ে হয়েছে, সেই আরিফা নাকি আমাকে মনে মনে পছন্দ করত। এ কথা পরে জেনেছিলাম।’
ওর কথা শুনে মনে মনে প্রফুল্ল অনুভব করলাম। বললাম, ‘মেয়েরা যাকে পছন্দ করে তাকে ভালোবাসার চেয়েও বেশি মূল্যায়ন করে। তাই আরিফার ব্যাপারে ভিন্ন চিন্তা করো।’
‘অনেক দিন পর হয়তো আবার আসব।’ বলেই সে উঠে দাঁড়াল।
আমি বললাম, ‘নেত্রকোনা কখন যাচ্ছ?’
মৃদু হেসে বলল, ‘আগামীকাল।’ তারপর দরজা খুলে বেরিয়ে গেল।

বন্ধু, ভৈরব বন্ধুসভা