আর্তনাদ

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
আমার তো গল্পভান্ডার খালি, তাই চুপচাপ অবাক হয়ে শুনে গেলাম তাদের ঈদের গল্প। সেদিন আমাকে কোনো প্রশ্ন করতে হয়নি। প্রশ্ন করার প্রয়োজনও পড়েনি। সেদিন রাতে অবাক আর অবসাদ নামক পাহাড়ের একদম চূড়ায় আমার অবস্থান ছিল।

হলের মধ্যে আমি ছাড়া একটা পিঁপড়াও নেই। আচ্ছা, পিঁপড়াও কি ঈদে বাড়ি যায়?

উসমান ভাইয়ের কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। লোকটা হলের দায়িত্বে আছেন, আমার মতো ছাদহীন মানুষের জন্য ঈদে বাড়ি যাওয়া হয়নি ভাইয়ের। বিবেকের বেড়াজালে আটকা পড়ে থেকে গেলেন হলেই।

আজ সারা দিন ঈদের আমেজে কেটেছে সবার। ঘরে ফেরা মানুষগুলোর মধ্যে ঈদের আনন্দটা একটু বেশিই থাকে, যা বুঝতে পারলাম এই হলে এসে। এই হলে না এলে পৃথিবীর অনেক কিছুই অজানা থেকে যেত।

যখন ঈদ আসি আসি করছিল, তখন হলে থাকা প্রায় প্রত্যেক শিক্ষার্থীর মুখে ছিল কালো আকাশে ঝলমলানো হীরার মতো ঝিকঝিক করা তারার ঝলকানি। ভার্সিটি লাইফ শুরুর মাত্র ছয় মাস হয়েছে। জীবনপথে চলার শুরুও তখন থেকে। আর এই ছয় মাস আমাকে শিখিয়েছে অনেক কিছু, জানিয়েছেও অনেক কিছু।

ঈদে বাড়ি ফেরা নিয়ে সবার মনে এত খুশি দেখে বেশ কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘এই ছুটিতে বাড়িতে কি যেতেই হবে?’ বেশির ভাগই একই রকম উত্তর দিয়েছিল। বলেছিল, ‘পাগল নাকি ভাই? ঈদে বাড়ি যেতে হয় না?’ কথাটা শোনার পর আমার বলার কিছু থাকত না। তাই নীরবতাকেই বেছে নিতাম।

সবার এই বাড়ি ফেরা নিয়ে অনেক প্রশ্নের স্তূপ তৈরি হচ্ছিল কৌতূহলী মনে। কিন্তু আমার এত এত প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার মতো ধৈর্যশীল কাউকে খুঁজে পাচ্ছিলাম না। সৌভাগ্যক্রমে একদিন রাতে মহা আনন্দে আত্মহারা রুমমেটরা ঈদ নিয়ে খোশগল্পে মেতে উঠল। ঈদে কার বাড়িতে কী হতো, কত দিন আগে থেকে ঈদের শপিং শুরু হতো, কে কী করত, সব বলে গেল। প্রতিযোগিতা লেগে গিয়েছিল কে কার ঈদের গল্প আগে বলবে, তা নিয়ে।
আমার তো গল্পভান্ডার খালি, তাই চুপচাপ অবাক হয়ে শুনে গেলাম তাদের ঈদের গল্প। সেদিন আমাকে কোনো প্রশ্ন করতে হয়নি। প্রশ্ন করার প্রয়োজনও পড়েনি। সেদিন রাতে অবাক আর অবসাদ নামক পাহাড়ের একদম চূড়ায় আমার অবস্থান ছিল।

ঈদে নাকি মায়েরা নানা রকম খাবার বানান বাচ্চাদের পছন্দমতো। ঈদের নামাজের পর নাকি সালাম করার ধুম পড়ে আর সালামি কে কত বেশি পেল, তা নিয়ে প্রতিযোগিতা চলতে থাকে ছোটদের মধ্যে। বড় কাজিনরা সালামি দিতে কিপটামো করলে তা নিয়ে মজা করার নাকি শেষ থাকে না। তারপর এবাড়ি–ওবাড়ি ঘুরতে যাওয়া হয়। হইহুল্লোড়ে কাটে ঈদের সময়টুকু। যেন এক অন্তহীন আনন্দের স্রোত বয়ে যায় পুরো সময়টায়।

ওরা একতরফা গল্প করেই যাচ্ছিল। এত সুন্দর সুন্দর মুহূর্ত ওদের মনের খাতায় লিখা, যা ফুরোতে কয়েকটা রাত লেগে যেতে পারে, এক রাতে ওগুলো ফুরোনোর নয়। ওরা ওদের গল্পে এতটাই মেতে ছিল, যার কারণে আমি যে কোনো কথা বলছি না, তা তাদের চোখেই পড়েনি। একদিক দিয়ে ভালোই হয়েছে, আমাকে জিজ্ঞেস করেও লাভ হতো না তেমন।

আমি যখন পরিষ্কার করে কথা বলতেও শুরু করিনি, তখন বসন্তের এক বিকেল বেলায় একজন বয়স্ক দাড়িওয়ালা নাকি আমাকে এতিমখানায় দিয়ে যায়। তখন থেকেই আমার নামের সঙ্গে অদৃশ্যভাবে ‘এতিম’ শব্দটা জড়িয়ে যায়। এতিমখানায় কেউ এলে আমাকে দেখে বলত না যে ‘সুন্দর বাচ্চা বা ভালো বাচ্চা। বলত ‘বাচ্চাটা এতিম, বড্ড মায়া লাগে, এই সেই’।
যদিও মা–বাবার জন্য কখনো তেমন করে মন কাঁদেনি। তবে জানতে খুব ইচ্ছে করত ওই দাড়িওয়ালা লোকটা কে ছিল, সে কি আমার মা-বাবাকে চিনত?
ওই লোকটা যদি আবার আসত, তাহলে জিজ্ঞেস করে নিতাম আমি দেখতে কার মতো হয়েছি, বাবার মতো নাকি মায়ের মতো? কিন্তু লোকটা আসেনি কখনো। আমারও আর জানা হয়নি।
বাবা-মা না থাকলেও ওইখানে ভালোই ছিলাম। একজন ছিলাম আরেকজনের আত্মার আত্মীয়। এই ভার্সিটি হলে সবাই কেমন জানি। ভালো লাগে না একটুও।

এতিমখানায় ঈদের দিন সকালবেলা সবাই গোসল করে একসঙ্গে ঈদের জামাতে যেতাম, তারপর এসে হুজুরদের সালাম করে বাবুর্চি মামার হাতে বানানো পায়েস খেতাম। আর দুপুরে ভালো খাবারদাবার থাকত। এ–ই ছিল আমাদের ঈদ।

বাবুর্চি মামা কখনো জিজ্ঞেস করেননি যে আমার পছন্দের কিছু বানিয়ে খাওয়াবেন কি না। আমিও কখনো কারও কাছে বায়না ধরিনি, এটা-সেটা খাওয়ার জন্য। বায়না ধরতে হয়—এমন কথা এই প্রথম শুনলাম ভার্সিটিজীবনে এসে। পৃথিবীতে মনে হয় শুধু মা-বাবার কাছে বায়না ধরতে হয়। তারা বোধ হয় বায়নাগুলো পূরণ করার জন্যই পৃথিবীতে আসেন। তবে সবার কপালে আবার বায়না পূরণ করার মতো ম্যাজিশিয়ানরা জোটে না। যেমন আমার কপালে জোটেনি।

মা–বাবার আঙুল ধরে শপিংয়ে গিয়ে কাপড় কেনার স্বাদ কেমন, সেটাও জানি না। আমাদের ওইখানে বিত্তবান লোকেরা কাপড়চোপড় দিয়ে যেত, আর সেটা আমাদের হাতে হাতে পৌঁছে দেওয়া হতো। সেই কাপড় পেয়েই খুশির সমুদ্রে ভাসতাম সবাই। ঈদের দিন সকালবেলা ওইখানে বড়দের সালাম করার প্রতিযোগিতা লাগত ঠিকই; কিন্তু সালাম করে দুষ্টু–মিষ্টি হাসি হেসে সালামির জন্য মিটমিটিয়ে তাকিয়ে থাকার প্রথাটা ছিল না একদমই।

এতিমখানাতেই ভালো ছিলাম। কখনো তেমনভাবে ইচ্ছে করেনি মায়ের চুমু খেতে, আর বাবার বকুনি। এখন ইচ্ছে করে, খুব ইচ্ছে করে। অবাস্তব ইচ্ছারা আমাকে চেপে ধরেছে ভয়ংকর ভাবে। পারছি না এই অদ্ভুত অবাস্তব ঘোর থেকে বের হতে।

ভার্সিটিতে আসার পর থেকে আরেকটা জিনিস খেয়াল করলাম। আর এটা দেখার পর থেকেই কষ্টগুলো যেন নতুনভাবে জেগে উঠতে শুরু করল। নিজের একাকিত্ব যেন অনুভব করতে শুরু করলাম বহুগুণে। দেখলাম সবার বাবা-মা প্রতিদিন কল দেন, খোঁজ নেন। আর প্রতিদিনই কি খেলো না খেলো—এসব জিজ্ঞেস করেন। মা-বাবা বুঝি এইভাবে খোঁজখবর নেয় সন্তানের? জানা ছিল না।

আমার এ জীবনে তো মা–বাবার কোনো কলই আসেনি। আসবেই–বা কীভাবে? মা–বাবার নাম ছাড়া তো আমি আর কিছুই জানি না। ওঁদের গায়ের গন্ধ কেমন ছিল, ওঁদের হাসি কেমন ছিল, ওঁদের গলার স্বরই–বা কেমন ছিল, কিছুই জানি না।

আচ্ছা মা-বাবা কেন আমার নাম ‘মেঘ’ রেখেছিলেন? ওরা কি আগে থেকেই বুঝতে পেরেছিলেন আমার জীবনটা ওঁদের ছাড়া সুন্দর নীল আকাশ দেখতে বাধা দেওয়া মেঘের মতো হবে? মনে হয় বুঝতে পেরেছিলেন।
মাঝেমধ্যে মনে হয় মা-বাবাও বোধ হয় আমার মতো ছিলেন। সে জন্য আমার নানু-দাদুও নেই। সবাই আমাকে ছেড়ে ওপরে ওই আকাশে পাড়ি জমিয়েছেন। ওই আকাশকে ভাল্লাগে। খুব আপন লাগে। মনে হয়, আমার কাছের মানুষেরা সব আকাশেই আছে। যখনই সুযোগ হয়, আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকি মায়াভরা দৃষ্টিতে; সেটা রাত হোক, অথবা দিন। তাকিয়ে থাকতে থাকতে আকাশে যাওয়ার পর কী কী করব, তা নিয়ে অনেক পরিকল্পনা করতে থাকি।

আমি আকাশে যাব, সবার সঙ্গে দেখা করব, জড়িয়ে ধরব, মায়ের চুমু খাব, আর ইচ্ছেমতো অভিমান করব। তারপর ওরা আমার অভিমান ভাঙাতে ব্যস্ত হয়ে পড়বে, নানু-দাদু আসবে, ভাই বলে ডাকবে; সবাই মিলে ঈদে ছুটিয়ে মজা করব। সবাইকে সালাম করব, তারপর দুষ্টু–মিষ্টি হাসি হেসে হাত পেতে সালামি চাইব। এমন কতশত পরিকল্পনা করেই চলেছি হরদম।

আজ হঠাৎ করে তাদের জন্য মনটা কেঁদে উঠছে বারবার। হয়তোবা এই প্রথম এতটা একা লাগছে বলেই এমন হচ্ছে। এতিমখানায় ঈদটা কাটিয়ে আসতে পারতাম। কিন্তু যাওয়া আর সম্ভব না। ওরা বলে দিয়েছে, আমি নাকি বড় হয়ে গেছি। এখন নিজেকেই নিজের ভালো-মন্দ খুঁজে নিতে। তাই এই ভার্সিটি আর ভার্সিটির হলকে আপন করে নিয়েছি। কিন্তু ভাবিনি কখনো এই হলের সুনসান নীরবতা অদেখা-অচেনা আপনজনদের জন্য আমাকে এভাবে অস্থির করে তুলবে।

রাতের আকাশে এখন প্রচুর তারা। তারাগুলোর মধ্যে দুটি তারা একটু বেশিই মিটমিট করছে। ওগুলোকে বড় আপন মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে খুব কাছের কেউ তারা হয়ে আমাকে দেখছে। আর আমার মাথাটার ভেতরটা তাদের দেখে হাজারটা প্রশ্নের মিছিলে অদৃশ্য গিজগিজ শব্দে ফেটে যাচ্ছে।

আচ্ছা মা! আমি কার মতো দেখতে হয়েছি? বাবার মতো? নাকি তোমার মতো? আচ্ছা বাবা! আমাকে ছেড়ে যাওয়ার কি খুব বেশি প্রয়োজন ছিল? আমি কি তোমাদের অপছন্দের ছেলে ছিলাম? তোমাদের কখনো ইচ্ছে করেনি আমার খোঁজ নিতে? আকাশের তারা হয়ে গেলে কি খোঁজ নেওয়াও যায় না? যায় তো, ইচ্ছে করলেই যায়। তোমাদের ইচ্ছে নেই। তাই আজ এই এত বড় পৃথিবীতে আমি একা, একদম একা। আমার এই ভার্সিটিতে চান্স পাওয়া, আমার সাফল্য অর্জন কোনো কিছু নিয়ে গর্ব করার মতো কেউ নেই। কেন এমন করলে তোমরা?
জানি, আমার প্রশ্নের উত্তর তারা দুটি দেবে না। দূর থেকেই মিটমিট করবে ওরা। এতিমখানাতেই ভালো ছিলাম। কখনো তেমনভাবে ইচ্ছে করেনি মায়ের চুমু খেতে, আর বাবার বকুনি। এখন ইচ্ছে করে, খুব ইচ্ছে করে। অবাস্তব ইচ্ছারা আমাকে চেপে ধরেছে ভয়ংকর ভাবে। পারছি না এই অদ্ভুত অবাস্তব ঘোর থেকে বের হতে।

আজ খুব করে চাইছি আমার মোবাইলে একটা কল আসুক। কেউ বলুক, ‘কী রে খোকা! বাড়ি আসবি না? আর কত দিন এভাবে থাকবি?’ যদিও জানি আসবে না, কল আসবে না।
বাস্তবতার সঙ্গে লড়াই করতে থাকা চাপা আর্তনাদগুলো আর পেরে ওঠে না মনের সেই অদৃশ্য বাক্সে আটকে থাকতে। হঠাৎ করেই সেগুলো চারদিকের নির্জনতা ভেঙে দেয়। সেই আর্তনাদের সঙ্গে মা-বাবার ফিরে আসার ব্যর্থ আকুতি–মিনতির সাক্ষ্য থেকে যায় চারপাশের বিদঘুটে নীরবতা।

বন্ধু, সিলেট বন্ধুসভা