যেন এক স্বপ্নপুরী

ঘোড়ায় চড়ে কাশ্মীরের সুইজারল্যান্ড যাওয়ার প্রস্তুতিছবি: লেখকের সৌজন্যে

রাতেই ঠিক হয়েছিল যে সকালে নাশতার পর সুইজারল্যান্ডে যেতে হবে। সবার মধ্যে এক অন্য রকম উত্তেজনা। এ এক অদ্ভুত সুইজারল্যান্ড যেখানে যেতে পাসপোর্ট লাগে না, ভিসা লাগে না, বিমানে উঠতে হয় না। একমাত্র বাহন ঘোড়া। আবার হেঁটেও যাওয়া যায়। যাওয়া-আসা প্রায় ১৫ কিলোমিটার। প্রতিটি ঘোড়ার ভাড়া এক থেকে দেড় হাজার রুপি। আমাদের সাতটা ঘোড়া প্রয়োজন। কথায় আছে, ‘ঘোড়ায় চড়িয়া মর্দ হাঁটিয়া চলিল’। আমরা ঘোড়ায় চড়িয়া হাঁটিয়া চলিলাম না। ঘোড়ায় চলিলাম। আমাদের দলে শিশু, কিশোর, নারী, সিনিয়র সিটিজেনসহ বিভিন্ন সদস্য আছে। সবাই ঘোড়ায় চড়তে ভয় পাচ্ছে। কিন্তু চড়ার মধ্যেও উত্তেজনা আছে। কেউ এ সুযোগ থেকে বঞ্চিত হতে চায় না। ভয়, আনন্দ, উত্তেজনা একই সঙ্গে কাজ করছে।

আরও পড়ুন

দলনেতা তো বলেছেনই যে ঝুঁকি ছাড়া কোনো অর্জন হয় না। তাই কোনো না কোনো ঝুঁকি নিতেই হবে। কোনো ছাড় নেই। এ দেশের মানুষ ইউরোপে যাওয়ার জন্য সীমাহীন উত্তাল সাগর পাড়ি দেয়। সাগরে ডুবে কত মানুষের মৃত্যু হয়। আর এখানে বড়জোর কোনো সদস্য ঘোড়া থেকে পড়ে যেতে পারে। আর একান্ত কপালে লেখা না থাকলে মৃত্যু হবে না। অবশ্য পঙ্গু হতে পারে। তাতে কী? তখনো তো সে এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকবে।

ঘোড়ার পিঠে ওঠার সময় কিছুটা বুক দুরুদুরু করে। একবার ঠিকভাবে বসতে পারলে আর সমস্যা নেই। বসার জন্য ঘোড়ার নীল দাঁড়ার ওপর আরামদায়ক করার কোনো ঘাটতি নেই। সৃষ্টিকর্তার নাম স্মরণ করে সবাই ঘোড়ার পিঠে উঠল। প্রথমে কিছুটা ভয় পেলেও একটু পরই সবাইকে মনে হলো যেন পেশাদার ঘোড়াসওয়ার। যাত্রাপথের একটা অংশে কার্পেটিং, তারপর মাটি আর পাথর, এরপর শুধু পাথর আর পাথর। প্রত্যেকের ঘোড়ার নাম আছে। আমার ঘোড়ার নাম বুলবুল, দলনেতার ঘোড়া পাঠান, গালিবেরটা দুলদুল, অয়নের ঘোড়া পঙ্খিরাজ, মেঘলার ঘোড়াটা শাহজাদি, তন্দ্রার ঘোড়ার নাম রাজা আর আহিলেরটা সুলতান। ঘোড়ার পিঠে চড়ে কিসের বাংলা, কিসের হিন্দি, দলনেতার মধ্যে হলিউড সিনেমার নায়কের ভাব এসে গেল।চ

ঘোড়ায় চড়ে কাশ্মীরের সুইজারল্যান্ড যাওয়ার পথে মা-ছেলে
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

যেন এক স্বপ্নপুরী
শুরুতে পাকা রাস্তা দিয়ে ঘোড়া হাঁটছিল। ঠক-ঠক-ঠক-ঠক করে বাজনার মতো শব্দ হচ্ছিল। মনে পড়ে গেল পরিচিত সিনেমার সেই দৃশ্যের কথা, যেখানে নায়ক দস্যুদের কাছ থেকে নায়িকাকে উদ্ধার করে ঘোড়ার পিঠে নিয়ে ছুটে যায়। দ্রুত ছুটতে ছুটতে একসময় ঘোড়া অদৃশ্য হয়ে যায়। শুধু তো দলনেতার সাত ঘোড়া নয়, অসংখ্য ভ্রমণপিপাসুর ঘোড়া সুইজারল্যান্ডে যাচ্ছে। একসঙ্গে এত ঘোড়ার ঠক-ঠক শব্দ কোনো দিন শোনা হয়নি। তাই সবাই ভীষণ পুলকিত, শিহরিত। কোনো কোনো জায়গায় পাহাড় থেকে ঝরনা নেমে এসেছে। ক্লান্ত ঘোড়া সেই ঝরনার পানি পান করছে। আবার কোথাও পানি জমে বরফ হয়ে গেছে।

বিশাল উঁচু পাহাড়ের পাদদেশ দিয়ে ঘোড়া হাঁটছে। চিরদিন মনে রাখার মতো সব স্মৃতি জমা হচ্ছে। যেতে যেতে কাশ্মীরের পুরোনো গ্রাম দেখা যায়। দেখা যায় পাহাড়ের দীর্ঘ উপত্যকা। অদূরে পাহাড়ের চূড়ায় জমে থাকা বরফ। বরফের ওপর গাড়িয়ে পড়ে সকাল, দুপুর ও বিকেলের মিষ্টি রোদ। পাহাড়ের মাটি ফুঁড়ে আকাশের দিকে উঠে গেছে সারি সারি পাইন ট্রি। মনে হয়, এ যেন এক স্বপ্নপুরী।

চলবে...