ঢাকা শহর পেছনে ফেলে আসার সঙ্গে সঙ্গে জ্যাম–কোলাহল অনেকটাই কমে এসেছে। রাতের আঁধারে রাস্তার পাশে গাছগুলো ছায়ামূর্তির মতো নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে আছে। গাড়ির ভেতরে সাউন্ডবক্সের গানের সঙ্গে নাচের তালে মেতে উঠেছে আড্ডা। গাড়ি চলেছে চট্টগ্রামের উদ্দেশে। আমাদের গন্তব্য লাল পাহাড়ের দেশ, রাঙামাটি।
ভৌগোলিক অবস্থানে রাঙামাটি জেলা ২২°২৭'–২৩°৪৪' উত্তর অক্ষাংশ ৯১°৫৬'–৯৩° পূর্ব দক্ষিণাংশে অবস্থিত। দূরত্ব ঢাকা থেকে ৩০৮ কিলোমিটার এবং চট্টগ্রাম থেকে ৭০ কিলোমিটার। আয়তনে ৬১১৬.১৩ বর্গকিলোমিটার। আয়তনের দিক থেকে বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ জেলা। রাঙামাটি বাংলাদেশের একমাত্র জেলা, যার আন্তর্জাতিক সীমানায় দুটি দেশ রয়েছে (ভারত ও মিয়ানমার)।
বন্ধু মানেই আনন্দ। এই আনন্দকে কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিতেই ভ্রমণের পরিকল্পনা করে ফেলি আমরা কয়েকজন। মহিলা কলেজে পড়ার সুবাদে কোনো ছেলেবন্ধু নেই। তাই ১৫ বান্ধবী মিলেই একজন ট্যুর গাইডের সাহায্যে রাঙামাটির উদ্দেশে অনেকটা সাহস নিয়েই রওনা হয়ে যাই। ঢাকার সায়েদাবাদ থেকে বাসে করে চট্টগ্রাম শহরে পৌঁছাই মধ্যরাতে। চট্টগ্রামের অক্সিজেন মোড় থেকে জীবনের এক সুন্দর অভিজ্ঞতাকে সঙ্গে নিয়ে রাঙামাটির বাসে করে ছুটে চলেছি আমি সানজিদা, জান্নাত, আর্চি, নীলা, সুখী, মিতু, নাওরিন, রোকশানা, নীলা, দিবা, ইম্মা, সোনিয়া আপু ও বান্ধবী মিতুর আম্মু।
বাস চলছে পাহাড়ের কোল ঘেঁষে আঁকাবাঁকা উঁচু–নিচু কংক্রিটের রাস্তায়। দুপাশে উঁচু উঁচু পাহাড়ের গাছের ফাঁকে ফাঁকে উঁকি দিচ্ছে ভোরের সোনালি আলো। সোনালি আলো আর ডিসেম্বরের কুয়াশা যেন নিজের হাতে সাজিয়ে দিচ্ছে অযত্ন–অবহেলায় পড়ে থাকা সুউচ্চ পাহাড়গুলোকে। কুয়াশা, পাহাড়ি গাছ ও মাটির ঘ্রাণে ভরে উঠেছে চারদিক। সেই ঘ্রাণ ভেদ করে উঁচু–নিচু রাস্তার দুপাশে পাহাড়ের সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে কখন যে হোটেলের সামনে চলে এসেছি, বুঝতেই পারিনি।
সকালে একটু বিশ্রাম নিয়ে নাশতা খেয়ে বেরিয়ে যাই ঘোরার জন্য। প্রথম গন্তব্য রাজবন বিহার। এটি বাংলাদেশের বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের বৃহত্তম বিহার। ১৯৭৭ সালে বনভান্তে লংগদু এলাকা থেকে স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য এখানে আসেন। বনভান্তে ও তাঁর শিষ্যকুলের জন্য ভক্তরা নির্মাণ করেন এই বিহার। তারপর যাই চাকমা রাজবাড়ি। ভারতের লুসাই পাহাড় থেকে উৎপন্ন রাঙামাটির উত্তর–পূর্ব সীমান্তে ঠেগা নদীর মোহনা হয়ে প্রবেশ করেছে রাঙামাটির একমাত্র নদী কর্ণফুলী। কর্ণফুলীর বুকে বড় বড় পাহাড় পেরিয়ে ইঞ্জিনচালিত নৌকায় কখনো গান, নৌকার ছাদে নাচ, কখনো আড্ডা ও গল্পে পৌঁছে যাই উপজাতি বাজারে। উপজাতি বাজারে রয়েছে হাতের তৈরি অনেক জিনিস—ব্যাগ, উপজাতিদের হাতে বোনা জামা, লুঙ্গি, চাদর, শাড়ি, ফতুয়াসহ নানা সামগ্রী। পাহাড়ি বাঁশের ভেতর রান্না করা মাংস, শুঁটকি ভর্তা, ডাল, ভাত ও সালাদে অতুলনীয় স্বাদ। এর মধ্যে দুপুরের খাওয়া সেরে নিই আরেক পাহাড়ের জুম রেস্টুরেন্টে।
এর মধ্যেই সূর্য অনেকটা ঢলে পড়েছে পশ্চিম গগনে। গাছের ফাঁকে ফাঁকে উঁকি দিচ্ছে সোনালি রোদ। চিলতে রোদে পাহাড়ের অপূর্ব সৌন্দর্যকে মনে হচ্ছে এক কুমারী কন্যা। সেই কন্যা তার দেহজুড়ে মিশিয়ে রেখেছে লাল মাটি। যেন তার অপার সৌন্দর্যে ঝলসে যাচ্ছে সারা প্রকৃতি। কর্ণফুলীর স্বচ্ছ পানি যেন কন্যার বিশাল শাড়ির আঁচল, উঁচু উঁচু পাহাড়ি গাছ ও ফুল যেন তার অলংকার, শুভালং ঝরনা সেই কন্যার উদোম পিঠ, আর বয়ে যাওয়া জল যেন তার দীর্ঘ কেশ। সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়ে কুমারী কন্যা। ঘন হয়ে আসা অন্ধকার, নদী ও পাহাড়ের বুকে ঝরে পড়া শুভ্র কুয়াশা, চারদিকের স্তব্ধতা, পানির কলকল ধ্বনি, পাহাড়ি ঝিঁঝি পোকার ডাক জানান দিচ্ছে সেই কন্যা গভীর নিদ্রায়। নিদ্রায় ঝিমিয়ে পড়েছি আমরাও। নৌকার গলুইয়ের ওপর মাথা রেখে আলোচনা করছি জীবনের সুখের কথা, ট্যুর শেষে যে যার ঘরে ফিরে যাওয়ার কথা, পরিকল্পনা করছি পরের দিন কী পোশাক পরব, কোথায় যাব—এসব নিয়ে। সারা দিন নৌকায় পুরো কাপ্তাই লেক ঘুরব, তাঁবুতে রাত কাটাব, ফায়ার ক্যাম্প করব, কায়াকিং করব, নাচব, গাইব, আরও কত কী!
শিক্ষার্থী, ইডেন মহিলা কলেজ