বছরের শেষ মাস। আজ রোববার। তৃতীয় বর্ষের দ্বিতীয় সেমিস্টার পরীক্ষা শেষ হলো গত শুক্রবার। না, এখনো পুরোপুরি শেষ হয়নি। ভাইভা বাকি। আগামী শুক্রবার ভাইভা। হরতাল-অবরোধের কারণে পরীক্ষাগুলো বন্ধের তারিখে হয়। ভাইভার পড়াশোনা নিয়ে তেমন চিন্তাভাবনা নেই। তাই পরীক্ষা শেষ করেই আত্মীয়ের বাসায় বেড়াতে আসা। বেড়াতে এলে এই এক ঝামেলা, সারা দিন বসে বসে থাকা। কাজটাজ নেই, অলস মস্তিষ্কে কত কিছু যে ঘুরে বেড়ায়, তার হিসাব নেই।
আপাতত ভাবছি, ভাইভায় কী ড্রেস পরব, তা নিয়ে। ভাইভা প্রেজেন্টেশনে একটু ফরমাল সাজুগুজুর ব্যাপার থাকে। এ অবধি একবারও ভাইভায় শাড়ি পরিনি। শাড়ি পরতে একদমই পারি না। এবার অনেক আগে থেকেই ভেবে রেখেছি শাড়ি পরব। সাদা রঙের শাড়ির সঙ্গে পার্পেল হিজাব। ভালোই লাগবে মনে হচ্ছে। আর কী কী প্রয়োজন ভাইভার জন্য? হাতে একটা কিছু পরতে হবে, তা না হলে খালি খালি লাগবে। চুরি বা ব্রেসলেট পরব। না, এগুলো পরা যাবে না। ফরমাল লাগবে না। ঘড়ি পরতে হবে। কিন্তু আমার তো ঘড়ি নেই! এক্সামে ভাইয়ের ঘড়ি নিয়ে গেছি। ওটা ছেলেদের ঘড়ি, অনেক বড়। ওটা মানাবে না। মানাবে এমন একটা ঘড়ি কিনতে হবে। আচ্ছা, অনলাইনে দেখা যাক।
বাক্রুদ্ধ হয়ে মনে মনে ভাবলাম, আমার ঠুনকো সান্ত্বনার প্রয়োজন তাঁর নেই। তিনি যথেষ্ট স্ট্রং। আমি যা শুনেই শিউরে উঠেছি, তিনি তা ফেস করেছেন এবং উঠে দাঁড়িয়েছেন।
অনলাইন থেকে কিনব না আমি। বিশ্বাস করতে পারি না। পরে দেখা যাবে পাটুয়াটুলী থেকেই কিনব। সে নাহয় কিনব, এখন দেখতে তো দোষ নেই। ফ্রি আছি যেহেতু। এই ভেবে একটি জনপ্রিয় অ্যাপ খুলে ফিমেল রিস্ট ওয়াচ লিখে সার্চ করে ঘড়ি দেখতে শুরু করলাম। এত দামি সব পণ্য। আমার যেগুলো পছন্দ, সেগুলোই দামি। আদতে ঘড়ি পরার অভ্যাস আমার নেই। পরীক্ষা এলে কখনো ভাইয়েরটা, কখনো স্টুডেন্টেরটি দিয়ে চালিয়ে দিই। একটা ঘড়ি এত দাম দিয়ে কিনে ঘরে পড়ে থাকবে, তা–ও ভালো লাগে না। কী যে করি! আবার সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছি। এসব চিন্তাভাবনার মধ্যেই একজন এসে বললেন, ‘আপা দরজাটা আটকায় দেন’। (ভদ্রমহিলা হচ্ছেন এই বাসার টেম্পোরারি হেল্পিং হ্যান্ড)
কিছুটা অবাক হয়ে আমি বললাম, ‘ও আপনি! কাজ শেষ?’
‘হ আপা।’
‘এখন বাসায় যাবেন, নাকি অন্য বাসায় কাজ আছে?’
‘না আপা, এহন অন্য বাসায় যামু। আজকে আমার মাইয়াডার বার্ষিক পরীক্ষার প্রথম দিন। কাজের জন্য লগে যাইতে পারলাম না।’
‘কোন ক্লাসে পড়ে মেয়ে?’
‘থ্রিতে পড়ে আপা, ফোরে উডব কয় দিন পরে।’
‘মাশা আল্লাহ, ভালো তো।’
এবার ভদ্রমহিলার প্রতি আগ্রহ জাগল। এত কষ্ট করে উপার্জন করা টাকা দিয়ে মেয়েকে পড়াশোনা করাচ্ছেন, ব্যাপারটা বেশ ভালো লাগল। এরপর নিজ থেকেই বললাম, ‘মেয়ের বাবা তো যেতে পারত স্কুলে!’
এরপর যা শোনলাম, সেটা শোনার জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিলাম না। ভদ্রমহিলা বললেন, ‘মেয়ের বাপের কথা তুললেন আপা, আমার বিয়ার এক বছর পরে গ্রামের বাড়ি থেইকা ঢাকা আইতেছিলাম, বাস আর বড় মালের ট্রাক অ্যাকসিডেন্টে অর বাপের বাঁ হাতটা কনুই থেইকা কাটা পইরা যায়।’
আর কিছু জিজ্ঞেস করার ভাষা পাচ্ছিলাম না। অবাক দৃষ্টিতে তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে আছি। তিনি তাঁর মতো ব্যাখ্যা দিতে থাকলেন, ‘অর বাপে ভালো একটা ওষুধ কোম্পানিতে চাকরি করত। ভালো বেতনও পাইত আপা। আমার ভাইয়েরা অনেক আগে থেইকাই বিদেশে থাকে, টাকাপয়সা ভালোই। আমি তাগো এক বইন, দেইখা শুইনা ভালো ঘরেই বিয়া দিছিল। অর বাপের অ্যাকসিডেন্টের পরে ভাইয়েরা চাইছিল আমারে বাড়ি নিয়া যাইতে, আবার বিয়া দিতে। আমি এডা কেমনে করি আপা কন! আমার মত আছিল না। মায় আমার পক্ষ নিছিল। মায় কইছে, মা, আল্লাহ চাইছে তাই এই রকম হইছে। ধর, এইটা তোমার লগে হইত যদি, আমার কোনো পোলার লগে হইতো যদি? আল্লাহ তোমার ভাগ্য এই রকম রাখছে, আল্লাহর দান অস্বীকার কইরো না মা। আমার মায় অনেক ধার্মিক।’
এসব যা-ই শুনছি, এখনো মাথায় ঘুরছে। একটা হাত কাটা পড়ে গেছে! আমার সেটাই কৌতূহল এখনো। তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আচ্ছা, হাতটা লাগানোর চেষ্টা করেনি ডাক্তাররা?’
‘সেদিন কী হইছিল জানেন আপা, হাতটা কনুইয়ের চামড়ার লগে লাইগা আছিল। পুলিশ চামড়াটা ছিঁড়া হাতটা আলাদা কইরা পাশে রাইখা দিছিল। সব আমার সামনেই হইছে। রক্তে ভাইসা যাইতেছিল, আমি কিছু করতে পারতেছিলাম না। আমার বোধ ও বুদ্ধি সব হারাইয়া গেছিল। সব দেখতাছিলাম। কিন্তু তারে গিয়া ধরনেরও শক্তি পাইতেছিলাম না, কিছু কওয়ারও শক্তি পাইতেছিলাম না। তারপর পুলিশ কেস হইল, ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি করাইল। ওরে নিয়া একটা মেডিকেল বোর্ড বসছিল। হাতটা যদি লাগাইয়া দিত, তাইলে নাকি কনুইয়ের ওপরের দিকে পচন ধরত। ডাক্তারে কইল, যদি হাতটা একটুখানিও লাগানো থাকত, তাইলে নাকি একটা সম্ভাবনা থাকত। আপা, সেদিন যদি পুলিশেরে বাধা দিতে পারতাম, তাইলে হয়তো আমার জামাইর হাতটা আজকে থাকত।’
কথাগুলো বলতে বলতে অজান্তেই ভদ্রমহিলার গাল বেয়ে পানি ফ্লোরে পড়ছে। সেদিকে যেন খেয়াল নেই তাঁর। একটু শেয়ার করে কিছুটা হলেও হালকা লাগছে তাঁর, আমার তা–ই মনে হচ্ছে। কিন্তু এসব পরিস্থিতিতে কী বলে সান্ত্বনা দিতে হয়, তা জানা নেই। আমার মন প্রচণ্ডভাবে চাইছে তাঁকে শান্ত করতে, কিছু হলেও সান্ত্বনার কথা বলতে। কিন্তু মুখ দিয়ে কিছুই বের হচ্ছে না। বেশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললাম, ‘আল্লাহ আপনার পরীক্ষা নিচ্ছে। সব সময় আল্লাহর সিদ্ধান্ত স্বাভাবিকভাবে মেনে নেওয়া উচিত আমাদের। আপনি অনেক ধৈর্যশীল, এর প্রতিদান একদিন পাবেন নিশ্চয়ই। আল্লাহ সব ঠিক করে দেবেন। তারপর এখন সংসারের খরচ কীভাবে চলছে?’
‘এই যে সারা দিন বাসায় বাসায় ঘুরে কাজ করি, ১২ থেকে ১৩ হাজার আসে প্রতি মাসে। জামাই একটা জায়গায় বসে লেখার কাজ পাইছে। সকাল থেকে বিকেল অবধি থাকে ওইখানে। পাঁচ হাজার দেয়। এক রুমের একটা বাসায় থাকি, অনেক খরচ আপা। বাসাভাড়াই সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা। মেয়ের স্কুলের খরচ, সবকিছু এই আয়ের মধ্য দিয়েই চলে। শহরে তো বোঝেন আপা, পানিডাও কিনা খাইতে হয়। মাঝেমধ্যে হিমশিম খাইতে হয়, তখন ভাইদের কাছে চাই। ভাইয়েরা অনেক সাহায্য করে।’
‘বাহ্ ভালোই তো, আপনার স্বামীর বাড়ির কেউ সাহায্য করেন না?’
‘না, আপা। আমার দেবর পুলিশ, ভাশুর সোনালী ব্যাংকের বড় অফিসার। তাগো লগে কথা কইতে ফোন দিলেও ধরে না ঠিকমতো, মনে করে টাকার জন্য ফোন দিই। তাই যোগাযোগ নাই অত। শ্বশুর–শাশুড়ি নাই তো। ননদের লগে কথা হয় প্রায়ই। ননদ আবার তার ভাইজিরে অনেক ভালো জানে।’ এরপর তিনি তাড়াহুড়া করে বললেন, ‘আচ্ছা, আপা যাই এহন। দোয়া কইরেন, মাইয়াডারে যেন অনেক বড় কিছু বানাইতে পারি পড়ালেখা শিখাইয়া। আরেক বাসায় যাইতে হইব এহন।’
বাক্রুদ্ধ হয়ে মনে মনে ভাবলাম, আমার ঠুনকো সান্ত্বনার প্রয়োজন তাঁর নেই। তিনি যথেষ্ট স্ট্রং। আমি যা শুনেই শিউরে উঠেছি, তিনি তা ফেস করেছেন এবং উঠে দাঁড়িয়েছেন। শক্ত মনে পরিস্থিতি সামাল দিয়েছেন, স্বামীর পাশে থেকে তাঁর জীবনের অপূর্ণতা দূর করেছেন। কজনই-বা পারে এভাবে কারও জীবনের পূর্ণতা হতে! এখনো সংগ্রাম করছেন প্রতিদিন। হয়তো পরিস্থিতিই মানুষকে স্ট্রং করে গড়ে তোলে। ভদ্রমহিলার স্বামীর প্রতি ভক্তি, শ্রদ্ধা, সংসারের প্রতি ভালোবাসা ও দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে সংগ্রামী জীবনের প্রতিটি পদে একটু একটু করে এগিয়ে যাওয়ার গল্প আমাকে নতুন করে শক্তি দিয়ে গেল। আমি ভালোবাসার সংজ্ঞা জানি না। আজকে মন বলছে, এটাই হয়তো ভালোবাসা। সব পরিস্থিতিতে সঙ্গীর পাশে থাকা, কখনো ছেড়ে না যাওয়া। ১০ মিনিটের এ কথোপকথন আমাকে কতগুলো শিক্ষা দিয়ে গেল। ভদ্রমহিলা সত্যিই সার্থক, কারও জীবনের পূর্ণতা হতে পেরেছেন তিনি। এখন আমার না পাওয়াগুলোকে বড্ড ঠুনকো মনে হচ্ছে। এমন অনেক পরিপূর্ণতা আমার আছে, যেগুলোর অভাবে মানুষের জীবনে নেমে আসে বিপর্যয়। তবু আমরা হতাশ। আমরা পাওয়াগুলোর চেয়ে না পাওয়া বিষয়গুলো নিয়ে বেশি চিন্তিত। এই যে আমি মানানসই ঘড়ি কিনতে ব্যস্ত, অথচ কারও ঘড়ি পরার সেই হাতটাই নেই।
শিক্ষার্থী, লোকপ্রশাসন বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়