অর্ধেক নারী অর্ধেক ঈশ্বরী

ছবি: সংগৃহীত

‘অর্ধেক নারী অর্ধেক ঈশ্বরী’ জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক আহমদ ছফার একটি আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস। লেখক তাঁর জীবনে চলার পথে কয়েক নারীর সঙ্গে প্রেম-ভালোবাসায় জড়িয়ে পড়েন। লেখকের সেই ঘটনাগুলোর ওপর ভিত্তি করে সম্পূর্ণ উপন্যাস রচিত হয়েছে।

উপন্যাসজুড়ে কথক জাহিদ তার অতীত জীবনের স্মৃতিগুলো এক নবাগত প্রিয়াতমার উদ্দেশে বয়ান করেছে। এখানে জাহিদই মূলত লেখক। কথক তার প্রিয়াতমাকে সোহিনী নামে সম্বোধন করেছে। অতীত জীবনে আসা দুজন নারী চরিত্রের বয়ান করেছে নবাগত প্রিয়াতমা সোহিনীর কাছে।

তাদের মধ্যে প্রথমজন হচ্ছে দূরদানা। দূরদানার ভাই ইউসুফ জোয়ারদার চরমপন্থী রাজনীতি করত এবং তাকে সবাই কুখ্যাত সন্ত্রাসী ও খুনি হিসেবে জানত। দূরদানা আফরাসিয়াব ছিল ডাকসাইটে মেয়ে। সে ওই ষাট-সত্তরের দশকে ঢাকা শহরে শার্ট-প্যান্ট পরে সাইকেল চালাত, পকেটে চাকু নিয়ে ঘুরে বেড়াত, এমনকি ছেলেদের সঙ্গে মারামারি করতেও তার বাধত না। যেখানে-সেখানে সিগারেটের ধোঁয়া ওড়ানো ছিল তার অনন্য বৈশিষ্ট্য। লেখকের ভাষ্যমতে, দূরদানার প্রতিটি প্যাডল ঘোরানোর মধ্য দিয়ে মুসলিম সমাজের সামন্তযুগীয় অচলায়তনের বিধিনিষেধ ভেঙে নতুন যুগের সৃষ্টি হয়। সব থেকে মজার ব্যাপার হচ্ছে, অনেক মেয়েও দূরদানাকে পুরুষ মনে করে তার প্রেমে পড়েছিল। দূরদানার রুমমেট কল্পনা আখতার লুলু জাহিদকে এসে হুমকি দিয়ে যায় এবং সঙ্গে স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর নিয়ে যায়, জাহিদ আর কখনোই দূরদানার সঙ্গে কোনো সম্পর্ক রাখতে পারবে না।

এরপর জাহিদের জীবনে আসে শামারোখ। জাহিদ তার নাম দিয়েছিল কন্যা শামারোখ। শামারোখ ছিল অসম্ভব রূপবতী একজন নারী। শামারোখ যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতার চাকরি পেয়েও বিভাগীয় প্রধান ড. শরিফুল ইসলাম চৌধুরীর কাছে হারতে বসেছে, তখনই তার সঙ্গে পরিচয় হয় জাহিদের।
শামারোখকে প্রথম দেখার পর লেখকের অনূভুতি—
‘ষষ্ঠ দিন শ্রম অন্তে প্রভু,
অপূর্ব বিস্ময় ভরে করে উচ্চারণ
পরবর্তী সৃষ্টি হবে দিব্য অনুপম।
তখন ডাগর আখি মেলেছে নন্দিনী
মরি, মরি দৃষ্টি হেরি,
আপন অন্তর তলে বিধাতাও
উঠেছে শিহরি।’

জাহিদের মতো একজন মানুষের সঙ্গে শামারোখ ঘুরে বেড়াচ্ছে, এটা দেখে অনেকে ঈর্ষান্বিত হয়েছে। এমনকি তার শিক্ষক, বন্ধু ও সহকর্মীদের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হতে থাকে শামারোখকে কেন্দ্র করে। সে শামারোখ চরিত্রে অনেক খারাপ দিক আবিষ্কার করলেও তার সৌন্দর্যের কারণে তাকে উপেক্ষা করতে পারেনি। এর পর থেকে জাহিদ কন্যা শামারোখের চাকরি পাইয়ে দেওয়ার জন্য একপ্রকার উঠেপড়ে লেগে যায়। একসময় সে অসমযুদ্ধে জয়লাভও করে। কিন্তু এর জন্য জাহিদ সবার চোখের কাঁটায় পরিণত হন। এরপর ধীরে ধীরে শামারোখের মধ্যে নানা পরিবর্তন আসতে শুরু করে এবং তাদের এ সম্পর্কের সমাপ্তি ঘটে। পরে শামারোখ যুক্তরাষ্ট্রফেরত তরুণ কবি শাহরিয়ারের মধ্যে সুখ খুঁজে নেয়।

ভালো লাগার দিক হচ্ছে, লেখক এখানে তাঁর অতীত ভান্ডারের সবকিছু অবলীলায় ব্যক্ত করেছেন, যা সচরাচর কেউ করেন না। হতাশার কারণ এই যে লেখক উপন্যাসে সোহিনীর কাছে দূরদানা ও শামারোখের বর্ণনা করলেও সোহিনী সম্পর্কে কিছুই স্পষ্ট করে বলেননি। লেখকের কাছে সোহিনী অর্ধেক আনন্দ, অর্ধেক বেদনা। অর্ধেক কষ্ট, অর্ধেক সুখ। অর্ধেক নারী, অর্ধেক ঈশ্বরী। সোহিনীকে না জানার এক অপূর্ণতা পাঠক মহলে রয়ে গেছে।

উপন্যাসে কিছু উক্তি মনে রাখার মতো—‘নারী আসলে যা, তার বদলে যখন সে অন্যকিছুর প্রতীক হয়ে দাঁড়ায়, তখন তাঁর আকর্ষণ করার শক্তি হাজার গুণ বেড়ে যায়।’ ‘জীবন শিল্প নয়, কবিতা নয়। জীবনে যা ঘটে, শিল্প ও কবিতায় তা ঘটে না। জীবন জীবনই। জীবনের সঙ্গে অন্য কোনো কিছুর তুলনা চলে না এবং জীবন ভয়ানক নিষ্ঠুর। সমস্ত প্রতিশ্রুতি, সমস্ত প্রতিজ্ঞা, সমস্ত স্বপ্ন-দুঃস্বপ্নের ওপারে জীবনের লীলাখেলা।’

বন্ধু, ড্যাফোডিল প্রথম আলো বন্ধুসভা