শেষ কথন

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

ডাক্তার হওয়ারও অনেক ঝামেলা। তবে আজ অনেক দিন পর একটু সময় বের করে সৌরভকে নিয়ে বেরিয়েছে নীলিমা। আপাতত নদীর পাড়েই খানিক চিনাবাদাম চিবিয়ে নেওয়া যাক। বেশ হাওয়া বইছে। লাশ কাটাছেঁড়া করা আর বিভিন্ন রোগে নুয়ে পড়া রোগীদের দেখতে দেখতে অনেকটা হাঁপিয়ে উঠেছিল নীলিমা। আজ খানিকটা স্বস্তি। পাশে সৌরভ বসা, মাথার ওপর খোলা আকাশ আর নদীর জলে পা ডুবিয়ে রেখে দূরের ছইওয়ালা নৌকা দেখা...একজন সাধারণ প্রেমিকা হিসেবে আর কী চাই!

—নীলিমা...সৌরভের কণ্ঠ শুনে আড় চোখে নীলিমা তাকাল।
—হুম...বল।
—আমি যদি কখনো তোকে ছেড়ে চলে যাই। তুই কী করবি?
হঠাৎ সৌরভের এমন অবান্তর প্রশ্নে নীলিমা খানিক ভুরু কুঁচকালেও তেমন একটা আমলে নিল না। তবু উদ্‌ভ্রান্তের মতো উত্তর দিল—
—তুই জীবনে আসার আগে যেমন ছিলাম, সে রকম থাকব...আমি সাধারণ মেয়ে। কারও প্রতি অত ক্ষোভ পুষে রাখি না।
—তোর মতো আরও একজনও এই কথা বলেছিল। মেয়েরা অত সহজ জিনিস না। ধোঁকাবাজদের সহজে ছেড়ে দেয় না। আচ্ছা তোকে একজনের গল্প বলি। শোন...। সৌরভ স্মিত হাসি দিয়ে বলল।
—কার গল্প?
—ডা. নিলুফার ইয়াসমিন...তুই ওনাকে সম্ভবত চিনতিস।
—হুম, চিনি। তিন বছর আগে আত্মহত্যা করেছিলেন। ফার্স্ট ইয়ারে ওনার দু-তিনটি ক্লাস পেয়েছিলাম। হঠাৎ ওনার কথা কেন?
—আমার সাংবাদিকতা জীবনে অনেক মানুষের ইন্টারভিউ নিয়েছি। জানলে তুই অবাক হবি, নিলুফার ইয়াসমিন আত্মহত্যা করার আট ঘণ্টা আগে আমিই ওনার জীবনের শেষ ইন্টারভিউ নিয়েছিলাম।
—কী বলিস! তুই নিলুফার ম্যাডামের ইন্টারভিউ নিয়েছিলি?
—হ্যাঁ, নিয়েছিলাম। উনি বিখ্যাত মানুষ। ভেবেছিলাম অ্যাপয়েনমেন্ট নিতে অনেক ঝামেলা পোহাতে হবে। কিন্তু তেমন কোনো সমস্যা হয়নি। তিনি আমায় ডেকেছিলেন ২৭ শ্রাবণ বিকেলে। শীতল বৃষ্টিতে চারপাশ ভেজা স্যাঁতসেঁতে, সবকিছু কেমন যেন বিষণ্ন ছিল সেদিন। বাড়িতে ঢুকতেই বোঝা গেল বিয়াল্লিশ বছরের কুমারী জীবনে ডাক্তারি করে অনেক টাকাই কামিয়েছেন। বাড়ির বর্ণনা না–ই বা দিলাম। সাধারণ ঝাড়বাতির দিকেই মিনিট তিনেক তাকিয়ে ছিলাম। কিছুক্ষণ পরই বাড়ির মালিকের দেখা। নিলুফার ম্যাডামকে এর আগে দূর থেকেই দেখেছি। কিন্তু কাছ থেকে দেখার পর তাঁর এই পড়ন্ত যৌবনের সৌন্দর্য মস্তিষ্কে বিঁধে যায়। তখন সেই সৌন্দর্যের কিছুটা ক্ষয়ে গেলেও বোঝা যায় একসময় তোর মতোই সুন্দরী ছিলেন।

—ওনার সৌন্দর্যের গল্প শোনাতে আমাকে বসিয়ে রেখেছিস?
—আরে না, শোন। যা বলছিলাম...তখন সবেমাত্র সাংবাদিকতার শুরু। তখনই ওনার মতো একজন মানুষের ইন্টারভিউ...খানিক ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গিয়েছিলাম। ইন্টারভিউ সাধারণ, সব প্রশ্নই মোটামুটি করা শেষ।
—যেমন?
—এই ধর, ডাক্তারি জীবনে ওনার সফলতা নিয়ে কথা। ইন্টারভিউ শেষ করে উঠে যাব...এমন সময় তিনি বললেন, ‘তোমার নামটা যেন কী?’ খানিক ভুরু কুঁচকেই উত্তর দিলাম, ‘সৌরভ’। তিনি বললেন, ‘জীবনে এত ইন্টারভিউ দিলাম। সবার মূল আগ্রহ ছিল আমার বৈবাহিক ও ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে। কিন্তু এই প্রথম দেখলাম কোনো সাংবাদিক আমার বৈবাহিক জীবন নিয়ে প্রশ্ন করল না।’
আমি বললাম, ‘ম্যাডাম অফিস থেকেই বারণ করে দিয়েছে এই বিষয়ে প্রশ্ন না করতে। আপনি নাকি তাতে বিরক্ত বোধ করেন।’ ‘হ্যাঁ, করতাম। তবে আর কদিনই–বা বাঁচব। তাই না বলা গল্পগুলো কাউকে বলে যেতে চাই। তুমি তো কিছুই খেলে না। চা–ও ঠান্ডা হয়ে গেছে। আচ্ছা, দাঁড়াও তোমার জন্য আমি চা বানিয়ে নিয়ে আসি।’

তিনি ফিরলেন। তবে শুধু চা নিয়ে নয়...সঙ্গে শাড়িটাও বদলে এলেন। এবার আমি আর চোখ সরাতে পারছিলাম না। পরনে সাদা সিফনের শাড়ি, গলায় মুক্তোর মালা আবছা অন্ধকার ঘরে ওনাকে প্রেমের দেবী আফ্রোদিতির মতো লাগছিল। তিনি আমায় চা দিয়ে নিজেও নিলেন। অতঃপর বলতে শুরু করলেন, ‘আজ আমার জন্মদিন। সেটা অনেকেই জানে না। কারণ, অফিশিয়ালি আমার জন্মদিন ২৫ ফেব্রুয়ারি। কিন্তু সে এই দিনটার কথা কখনোই ভুলত না। প্রতি ২৭ শ্রাবণ সে আমার জন্মদিন ঘটা করে উদ্‌যাপন করত। এই ঢাকা শহরেও আমার জন্য খুঁজে খুঁজে কদম ফুল নিয়ে আসত। তাঁর নামটা খানিক বাদেই বলি?’

আমি হ্যাঁ–সূচক মাথা নাড়ালাম। তিনি বলতে লাগলেন...‘আমার এই বিয়াল্লিশ বছর অবিবাহিত থাকার কারণ সে। মেডিকেল কলেজের ফার্স্ট সেমিস্টারের রেজাল্ট অবধি খারাপ করেছিলাম তাঁর কথা ভাবতে ভাবতে। কিন্তু একসময় আমি তাঁর কাছে পুরোনো হয়ে যাই। ছেলেদের রুচি খুব গতিশীল ...ক্ষণে ক্ষণে বদলায়। বর্ষার এক বিকেলে রেজিস্ট্রি করা চিঠি এল। তাঁর হাতের লেখা ছিল অসাধারণ। গোটা গোটা অক্ষরে লেখা—তার নাকি আর আমাকে মনে ধরছে না। সে মনপুরা নামের অন্য এক সুন্দরীকে বিয়ে করবে। করুক তাতে কী! আমি আমার মতো থাকব। আমি সাধারণ মেয়ে, কারও প্রতি অত ক্ষোভ পুষে রাখি না। কিন্তু ক্ষোভ ছিল। খুব সূক্ষ্ম ক্ষোভ। তাকে ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করছিলাম। ডাক্তার হিসেবে জীবনে অনেক পোস্টমর্টেম করতে হয়েছে। এই কাজটাই ডাক্তারি জীবনে খুব খারাপ লাগত করতে। মৃত মানুষের শরীর কাটাছেঁড়া করা...তাদের অঙ্গপ্রতঙ্গগুলো কেটে বের করা খুব বিচ্ছিরি ব্যাপার। কিন্তু জীবনে একজনের পোস্টমর্টেম আমি খুব আগ্রহ নিয়ে করেছিলাম। তাঁর পোস্টমর্টেম।’
কথাটা বলে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। আমি খানিকটা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কার পোস্টমর্টেম?’
—তাঁর, যে আমাকে ছেড়ে এক বর্ষার বিকেলে চলে গিয়েছিলেন। তাঁর হৃৎপিণ্ডটা আমি বের করে দেখেছিলাম... মনে আদৌ ভালোবাসার কোনো রেশ ছিল কি না। দেহটা কেটেছিঁড়ে দেখতে খুব আনন্দ হচ্ছিল...হয়তো সেই সূক্ষ্ম ক্ষোভটা উগরে দিতে পেরেছিলাম। মজার ব্যাপার কি জানো,  তিনি খুন হয়েছিলেন তাঁর স্ত্রী মনপুরার হাতেই। হয়তো মনপুরার ওপর থেকেও মন উঠে গিয়েছিল। আর সেটা জানতে পেরে মনপুরা তাঁকে মেরে ফেলল...।’ কথাগুলো বলে তিনি ঘর ফাটিয়ে হাসতে লাগলেন। যেন এতক্ষণ যা বললেন সব পাগলের প্রলাপ।

তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, ‘তোমাকেই কেন এত কথা বললাম জানি না। হয়তো তাঁর সঙ্গে তোমার খানিক মিল পেয়েছি তাই। আমার পরনের শাড়িটাও তিনি উপহার দিয়েছিলেন। প্রতি জন্মদিনে আমি এই শাড়িটা পরি। নিজের জীবনটাকে নিয়ে অনেক জুয়া খেলেছি। আর খেলতে ইচ্ছা হচ্ছে না।’ খানিক বিরতি দিয়ে বললেন, ‘তুমি এবার আসতে পারো।’ তিনি সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে গেলেন।
এগুলোই ছিল ওনার জীবনের শেষ কিছু কথা। ইন্টারভিউটি আর ছাপানো হয়নি। অফিস যদি আমাকে উদ্ধার না করত তাহলে হয়তো ওনার আত্মহত্যার কেসে আমি ফেঁসে যেতাম। কিন্তু আজও আমার ডায়েরিতে পুরো ইন্টারভিউটা লেখা আছে। শিরোনাম দিয়েছিলাম ‘she has written her death sentences...’ চল আজ উঠি সন্ধ্যা নেমে আসছে।’
নীলিমা এতক্ষণ কথা শুনছিল। সৌরভের শেষ কথায় সচকিত হয়ে বলল, ‘আচ্ছা নিলুফার ম্যাডামকে যে ঠকিয়েছিল ম্যাডাম তাঁর নাম বলে যায়নি?’ সৌরভ পড়ন্ত বিকেলের সূর্যের দিকে ম্লান হাসি হেসে বলল, ‘বলে গিয়েছিলেন বৈকি। কাকতালীয়ভাবে তাঁর নামও ছিল সৌরভ।’