তারা আমাকে ব্যর্থ হতে দেখতে চাচ্ছিল

সর্বকালের অন্যতম সেরা ক্রিকেটার শচীন টেন্ডুলকার। দুই দশকের বেশি আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে জয় করেছেন বিশ্বকাপসহ অসংখ্য অর্জন। সর্বাধিক ১০০টি সেঞ্চুরি, সর্বাধিক রান সংগ্রাহকসহ অসংখ্য রেকর্ড নিজের করে নিয়েছেন। ২০১৫ সালে দ্য প্লেয়ার্স ট্রিবিউনে প্রকাশিত তাঁর একটি সাক্ষাৎকার আজ পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো। যেখানে উঠে এসেছে ক্রিকেট খেলার শুরু, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের চাপ ও পাকিস্তানের বিপক্ষে খেলার অভিজ্ঞতার কথা।

শচীন টেন্ডুলকারছবি: টুইটার

ভারত ১৯৮৩ সালের ক্রিকেট বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন হয়। স্পষ্ট মনে আছে, চারপাশে সবাই বাঁধভাঙা উল্লাসে মেতে ওঠে। বিশ্বকাপ জেতার গুরুত্বের ব্যাপারটি আমাকে নাড়া দেয়। এর আগে ক্রিকেট ব্যাট কখনোই ধরা হয়নি। জয়ের আনন্দমিছিলে বন্ধুদের সঙ্গে আমিও যোগ দিই। এ খেলাটি মানুষের মধ্যে যে খুশি বয়ে নিয়ে আসে, তা আমাকে প্রভাবিত করে। ক্রিকেট কেবল একটি খেলার চেয়েও বেশি কিছু মনে হয়েছে।

১১ বছর বয়সে স্কুলে ক্রিকেট খেলা শুরু করি। শুরুতে ব্যাট ধরতে পারলেও, রান করতে পারতাম না। এমনকি প্রথম বছর খেলাটির প্রতি ভালোবাসা জন্মাতে বেশ সময় লাগে। তারপর ধীরে ধীরে ভালো পারফরম্যান্স করতে শুরু করি। কোচ রমাকান্ত আচরেকারের সঙ্গে কাজ শুরু করি। ক্রিকেট–দক্ষতা বাড়াতে তিনি আমাকে সহায়তা করেন। মাঝেমধ্যে অনুশীলনের সময় তিনি ক্রিকেট স্টাম্পের ওপর এক রুপির একটি কয়েন রাখতেন। যে বোলার আমাকে বোল্ড করতে পারত, তাকে কয়েনটি উপহার দেওয়া হতো। আর যদি অনুশীলনের পুরো সেশন কেউ আমাকে আউট না করতে পারত, তখন কয়েনটি আমি পেতাম। এটা হয়তো মহামূল্যবান কিছু মনে হচ্ছে না, তবে কয়েনটি দেখে আমার ভেতরে উৎসাহ বেড়ে যেত। রমাকান্ত স্যারের সঙ্গে অনুশীলন করে মোট ১৩টি কয়েন জিতেছি এবং সব কটি কয়েন আজও আমার কাছে রয়েছে।

ধারাবাহিক উন্নতি করে যাওয়ার ফলস্বরূপ স্কুল ক্রিকেটে আমার পারফরম্যান্স সবার নজরে আসে এবং প্রত্যাশা পাহাড়সম হতে থাকে। সত্যি বলতে, এটা আমি উপভোগ করি। চাপের চেয়েও আমি এটিকে প্রশংসা হিসেবে নিই। বুঝতে পারি, যদি আমি যথেষ্ট ভালো না হই, মানুষ আমার কাছ থেকে খুব বেশি প্রত্যাশা করবে না। অল্প বয়সেই মানুষের অধিক প্রত্যাশা আমাকে উৎসাহ দেয় এবং এটি আমার দক্ষতা বাড়াতে সহায়তা করে।

মাত্র ১৬ বছর বয়সে, সবচেয়ে কম বয়সী হিসেবে টেস্ট ম্যাচে ভারতকে প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ পাই। অভিষেক ম্যাচে করাচিতে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তানের বিপক্ষে খেলেছিলাম। ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম, নার্ভাস লাগছিল, কিছুই বুঝতে পারিনি। চারপাশ প্রতিপক্ষ সমর্থকে ভরপুর ছিল এবং তারা আমাকে ব্যর্থ হতে দেখতে চাচ্ছিল। শেষ পর্যন্ত আমি ব্যর্থ হই।

সতীর্থদের কাঁধে শচীন টেন্ডুলকার। ফাইল ছবি

ওই দিন পাকিস্তানের বিপক্ষে এমন ক্রিকেটের অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হই, যেটির অংশ আমি কখনোই ছিলাম না। এমন বোলারদের মুখোমুখি হচ্ছিলাম, যারা আমার চেয়ে বয়সে বড়, কারও কারও বয়স আমার চেয়ে দ্বিগুণ অথবা বেশি। ক্রিজে গিয়ে আউট হওয়ার আগে মাত্র ১৫ রান করতে সক্ষম হই। ড্রেসিংরুমে ফিরে আসার সময় নিজের আত্মবিশ্বাসের ওপর সন্দেহ করতে থাকি। হয়তো আমি একজন সফল ক্রিকেটার হওয়ার জন্য তৈরি হইনি!

পুরোপুরি হতাশ হয়ে ড্রেসিংরুমে বসে থাকি। তখন কথা হয় টিম ম্যানেজার চান্দু বোর্দে এবং সিনিয়র খেলোয়াড় রবি শাস্ত্রীর সঙ্গে। ওই দিন তাদের পরামর্শ অবিশ্বাস্য রকম সহজ ও অমূল্য ছিল। তারা বলেছিল, ‘শান্ত হও’।

নিজেকে প্রমাণের জন্য এতটাই মনোযোগী ছিলাম যে পেছনে ফিরে তাকানোর সময় ছিল না এবং সামনে থাকা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় মনোনিবেশ করি। যখন আপনার ওপর অনেক বেশি প্রত্যাশা থাকে, তখন সবচেয়ে কঠিন হলো মনোযোগ ধরে রাখা এবং নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা। যেকোনো ক্রিকেটারের জন্যই অন্যতম চ্যালেঞ্জের কাজ হলো— পূর্বের বলের কথা চিন্তা না করে আসন্ন বল মোকাবিলায় মনোযোগ ধরে রাখা।

পাকিস্তানের বিপক্ষে পরের ইনিংসে আমার ব্যাট করার সুযোগ আসে এবং নিজেই নিজেকে বলি, আমাকে ক্রিজে অন্তত দেড় ঘণ্টা থাকতে হবে। চেয়েছিলাম সবকিছু আমার পক্ষে আসুক এবং সেটাই আমি করেছি। যত লম্বা সময় আমি ব্যাটিং করি, তত বেশি কমফোর্ট অনুভব করি। মাথা থেকে আমার বয়স ও অভিজ্ঞতার ব্যাপারগুলো ঝেড়ে ফেলি এবং বল মোকাবিলায় মনোযোগী হই। ৫৩ রান করে আমি আউট হই। প্রতিটি রান আমার জন্য মহামূল্যবান ছিল।

ম্যাচ শেষে হোটেল রুমে ফিরে আসি এবং নিজের জন্য উদ্‌যাপন করার মুহূর্ত পাই। এতটাই উত্তেজিত ছিলাম যে রুমে কিছুক্ষণ নাচতে থাকি। ভালো পারফর্ম করতে পেরে নিজেকে খুবই হালকা লাগছিল। সর্বোচ্চ পর্যায়ের ক্রিকেটে নিজের প্রতি যে আত্মবিশ্বাসহীনতা ছিল, সেটা মুহূর্তেই উধাও হয়ে যায়।

অনেক ক্রীড়াবিদের জন্য নিজের প্রতি সন্দেহকে জয় করা একটি বিরাট বাধা। অল্প বয়সে এ অবস্থা থেকে বের হয়ে আসাটাই সম্ভবত ক্যারিয়ারের পরবর্তী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আমাকে প্রস্তুত করে ফেলে।

ক্যারিয়ারজুড়ে পাকিস্তানের বিপক্ষে আমার অসংখ্য স্মরণীয় ম্যাচ রয়েছে এবং প্রতিপক্ষ হিসেবে সত্যিকারের প্রশংসা অর্জন করেছি। দুই দেশেই ক্রিকেট, খেলা থেকেও বেশি কিছু। অন্যতম স্মরণীয় ম্যাচ ছিল ২০০৩ ক্রিকেট বিশ্বকাপে। যদিও আমরা কোয়ার্টার ফাইনালে পাকিস্তানের বিপক্ষে খেলেছি, তবে মনে হয়েছিল এটা শিরোপার লড়াইয়ের ম্যাচ। প্রত্যাশা অনেক বেশি ছিল এবং স্টেডিয়ামের ওই দিনটি কখনোই ভুলব না। গ্যালারির এক পাশে ভারতীয় সমর্থক এবং অন্য পাশে পাকিস্তানি সমর্থক—যেন মানুষের এক সমুদ্র। যদিও আমরা টুর্নামেন্ট জিততে পারিনি, তবে ম্যাচটাতে জয় পেয়েছিলাম। অধিকাংশ ভারতবাসীর কাছে এটাই গুরুত্বপূর্ণ।