বাঙালি, বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধু
একজন মানুষকে সবচেয়ে সুন্দর মনে হয় তখন, যখন তিনি স্বদেশের, স্বজাতির অধিকারের জন্য লড়েন। মানুষের মুক্তির জন্য সংগ্রাম করেন। এ শুধু একজন মানুষ ও নেতার সৌন্দর্য নয়; এ হলো মানবতার সৌন্দর্য। কখনো কখনো একজন মানুষের মধ্য দিয়ে সমগ্র মানবতার প্রতিচ্ছবি ফুটে ওঠে। বঙ্গবন্ধু ছিলেন এমন এক ব্যক্তিত্ব, যাঁর চেতনায় ছিল বাংলার মানুষের মুক্তির ভাবনা। তিনি ছিলেন মূল্যবোধ, দূরদৃষ্টি ও উদারতার প্রতীক। তাঁর মধ্যে ছিল আদর্শ নেতার বৈশিষ্ট্য। পেয়েছিলেন বিশ্বনেতার গুণাবলি; বিপদে মানুষের পাশে থাকার এক অনন্য মানসিকতা। তাঁর কাছে মানুষের চেয়ে আপন আর কিছু ছিল না। এসব মানুষের স্বপ্নপূরণই ছিল তাঁর সারা জীবনের সংগ্রাম। চিরায়ত গ্রামবাংলার প্রতি বঙ্গবন্ধুর ছিল গভীর ভালোবাসা। তিনি গ্রামের সাধারণ মানুষের কাছে যেতেন। তাদের সঙ্গে মিশতেন। খুব ছোটবেলা থেকে এই মানুষগুলোর আনন্দ-বেদনার সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত করেছেন। বাঙালি, বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধু যেন এক অভিন্ন সত্তা।
১৯৪৩ সালে অবিভক্ত বাংলায় এক ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ হয়। তখন বাংলা সাল ছিল ১৯৫০। এ জন্য তেতাল্লিশের এ দুর্ভিক্ষকে পঞ্চাশের মনন্তরও বলা হয়। অন্নবস্ত্রহীন মানুষকে বাঁচিয়ে রাখা এক কঠিন চ্যালেঞ্জ। বঙ্গবন্ধু নিজেকে উজাড় করে ক্ষুধার্ত মানুষের পাশে দাঁড়ান। তাদের জন্য লঙ্গরখানা পরিচালনার নেতৃত্ব দেন।
মানবতার সেবায় বঙ্গবন্ধু
১৯৩৭ সাল। বঙ্গবন্ধু গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলের ছাত্র। তাঁর লেখাপড়ার জন্য এক শিক্ষক ছিলেন। নাম কাজী আবদুল হামিদ। তিনি ছিলেন সেবাপরায়ণ। ‘মুসলিম সেবা সমিতি’ গঠন করেন তিনি। এই সমিতির কাজ ছিল গ্রামের বাড়ি থেকে চাল সংগ্রহ করে বিক্রি করা। যে টাকা পাওয়া যেত, তা গরিব ছাত্রদের লেখাপড়ার জন্য দেওয়া। যে ছাত্রদের থাকার জায়গা নেই, তাদের থাকার ব্যবস্থা করা। এসব কাজের প্রায় সব ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু শিক্ষককে সহযোগিতা করতেন। এই দয়ালু শিক্ষক হঠাৎই একদিন যক্ষ্মায় মারা গেলেন।
শৈশব থেকেই বঙ্গবন্ধু ছিলেন মানবিক। সব সময় অসহায় মানুষের পাশে থাকতেন। তাঁদের কল্যাণে ঝাঁপিয়ে পড়তেন। তাই শিক্ষকের মৃত্যুর পর তিনি সমিতি পরিচালনার দায়িত্ব নেন। একজন শিক্ষককে সভাপতি করলেন। নিজে হলেন সম্পাদক। সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় থেকেই মানবসেবার কাজে যুক্তে হয়ে যান। জীবনে বড় হওয়ার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে পরিবার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। আর ছোটবেলা থেকেই বঙ্গবন্ধু প্রগতিশীল পরিবার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পেয়েছিলেন।
তাঁর বাবা সরকারি চাকরি করতেন। তিনি ছিলেন উদার-আধুনিক। কিশোরকাল থেকে তিনি বঙ্গবন্ধুকে সমকালীন রাজনৈতিক চিন্তাভাবনা ধারণ করে বড় হতে সহযোগিতা করেন। আবার বঙ্গবন্ধুও একই সঙ্গে লেখাপড়া, খেলাধুলা, সামাজিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত থাকেন।
এরই ধারাবাহিকতায় তিনি হলেন মহাকালের নায়ক। নিপীড়িত মানুষের বন্ধু। গভীর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, আত্মত্যাগ। জনগণের প্রতি সীমাহীন মমত্ববোধের কারণে তিনি হয়ে ওঠেন বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা। বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসে তিনি এনে দিয়েছেন একটি স্বাধীন দেশ। তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা। তাঁর মধ্যে ছিল প্যাট্রিস লুমুম্বার মতো সাহস, নেলসন ম্যান্ডেলার মতো ঔদার্য, সুকর্ণের মতো বাগ্মিতা, হো চি মিনের মতো দৃঢ়তা।
দরিদ্র মানুষই ছিল জীবনের অন্তঃপ্রাণ
১৯৪৩ সালে অবিভক্ত বাংলায় এক ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ হয়। তখন বাংলা সাল ছিল ১৯৫০। এ জন্য তেতাল্লিশের এ দুর্ভিক্ষকে পঞ্চাশের মনন্তরও বলা হয়। অন্নবস্ত্রহীন মানুষকে বাঁচিয়ে রাখা এক কঠিন চ্যালেঞ্জ। বঙ্গবন্ধু নিজেকে উজাড় করে ক্ষুধার্ত মানুষের পাশে দাঁড়ান। তাদের জন্য লঙ্গরখানা পরিচালনার নেতৃত্ব দেন। তাঁর ছিল এক জাদুকরি সাংগঠনিক ক্ষমতা। কাজের প্রতি নিষ্ঠা ও পরিশ্রম করার দক্ষতা। তিনি ছিলেন প্রায় সবার একান্ত আপন। তাই কলকাতা ইসলামিয়া কলেজের এই তরুণ ছাত্রনেতা দ্রুত সোহরাওয়ার্দীর পছন্দের মানুষ হয়ে ওঠেন।
বঙ্গবন্ধু তাঁর সহযোগীদের স্বপ্ন দেখাতেন। স্বপ্নের সমান বড় হতে উৎসাহ দিতেন। সবাইকে কাছে টেনে নিতেন। মানুষের অধিকারের প্রশ্নে সারা জীবন ছিলেন আপসহীন। এ জন্য তিনি হতে পেরেছিলেন সবার প্রিয় ‘মুজিব ভাই’। তাঁর কাছে সবকিছুর ঊর্ধ্বে ছিল মানুষ।
জেলখানায়ও তিনি সবার প্রিয় নেতা। তিনি জগতের কল্যাণের কথা ভাবতেন। তিনি বলতেন, ‘একজন মানুষ হিসেবে সমগ্র মানবজাতি নিয়েই আমি ভাবি। একজন বাঙালি হিসেবে যা কিছু বাঙালিদের সঙ্গে সম্পর্কিত, তা-ই আমাকে গভীরভাবে ভাবায়। এই নিরন্তর সম্পৃক্তির উৎস ভালোবাসা। অক্ষয় ভালোবাসা, যে ভালোবাসা আমার রাজনীতি এবং অস্তিত্বকে অর্থবহ করে তোলে।’ বঙ্গবন্ধু সবকিছু করতেন একটা লক্ষ্যকে সামনে নিয়ে, সেটা হলো মানুষের কল্যাণ। একটা কথা তিনি প্রায়ই বলতেন, তাঁর স্বপ্ন হলো দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানো। শৈশব থেকেই বঙ্গবন্ধুর মধ্যে এ বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। তিনি তখন স্কুলের ছাত্র। একই সঙ্গে রাজনীতি ও সমাজসেবা করছেন। বঞ্চিত মানুষের মুক্তির আকাঙ্ক্ষাই ছিল তাঁর রাজনীতির দর্শন।
বঙ্গবন্ধুর পাকিস্তান আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল বাংলার নিপীড়িত মানুষদের জমিদার-মহাজনের শোষণ থেকে রক্ষা করা। এসব মানুষের জন্য তিনি রাজনীতি করেন। তাদের অসম্মান কোনোভাবে মেনে নিতে পারেন না। বঙ্গবন্ধু এক বক্তৃতায় বলেছেন, ‘কার টাকায় ইঞ্জিনিয়ার সাব? কার টাকায় ডাক্তার সাব? কার টাকায় অফিসার সাব? কার টাকায় রাজনৈতিক সাব? কার টাকায় মেম্বার সাব? কার টাকায় সব সাব। আপনি চাকরি করেন, আপনার মাইনা দেয় ওই গরিব কৃষক। আপনার মাইনা দেয় ওই গরিব শ্রমিক। আপনার সংসার চলে ওই টাকায়। আমি গাড়ি চড়ি ওই টাকায়। আমরা ভাত খাই ওদের টাকায়। ওদের সম্মান করে কথা বলেন। ওদের ইজ্জত করে কথা বলেন। ওরাই মালিক।’ এসব মানুষই ছিল বঙ্গবন্ধুর জীবনের অন্তঃপ্রাণ।
শান্তি ও মুক্তির প্রতীক
স্কুলজীবন থেকেই বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠ ছিল সাম্রাজ্য ও উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে। পরবর্তী সময়ে পৃথিবীর মানুষের সংগ্রামের ইতিহাস তিনি জেনেছেন। ১৯৫২ সালে চীনের পিকিংয়ে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের শান্তি সম্মেলন হয়। তিনি এ সম্মেলনে যোগ দেন। সেখানে বিভিন্ন দেশের শান্তিকামী সংগ্রামী নেতাদের সঙ্গে তাঁর কথা হয়। আমার দেখা নয়া চীন বইয়ে তিনি লিখেছেন, ‘রাশিয়া হোক, আমেরিকা হোক, ব্রিটেন হোক, চীন হোক, যেই শান্তির জন্য সংগ্রাম করবে, তাদের সঙ্গে আমরা সহস্র কণ্ঠে আওয়াজ তুলতে রাজি আছি, আমরা শান্তি চাই।’ বঙ্গবন্ধু সারা জীবন কখনো ঘৃণা ও সংঘাতের রাজনীতি করেননি। একাত্তরের ৭ মার্চের ভাষণেও তিনি তাঁর শ্রোতাদের বলেছিলেন, ‘দেখবেন, আমাদের যেন বদনাম না হয়।’
বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের গুণ ছিল অসাধারণ! মুহূর্তে তিনি লাখো মানুষকে সংঘবদ্ধ করতে পারতেন। তিনি কখনো জ্বালাও-পোড়াওয়ের রাজনীতি করেননি। সারা জীবন তাঁর রাজনীতি ছিল গণতান্ত্রিক, শান্তিপূর্ণ ও অহিংস। পাকিস্তানের ২৪ বছরের শোষণ-বঞ্চনার সময় বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলার মুক্তির আন্দোলন ক্রমাগত বেগবান হয়েছে। কিন্তু সব সময়ই তিনি শান্তিপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন করেছেন। একইভাবে ৭ মার্চের ভাষণেও শান্তিপূর্ণ, গণতান্ত্রিক ও মুক্তির আন্দোলন হিসেবে সমগ্র পৃথিবীর সামনে তুলে ধরেছিলেন।
একাত্তরে স্বাধীনতাসংগ্রামে মানবজাতির সামনে বঙ্গবন্ধু ছিলেন শান্তি, মুক্তি ও মানবতার প্রতীক। মহাত্মা গান্ধী ও মার্টিন লুথার কিংয়ের সঙ্গে তাঁর তুলনা করা হতো। বঙ্গবন্ধুর প্রতিটি কাজ প্রমাণ করে, তিনি কতটা মানবিক ছিলেন। তিনি অন্তর থেকে বিশ্বাস করতেন দেশটি একদিন সোনার বাংলা হবে। দেশের মানুষ অন্ন, বস্ত্র, স্বাস্থ্য, শিক্ষায় সমৃদ্ধ হবে। সবার একটি হাসি–আনন্দময় জীবন থাকবে। দেশ পরিচালনার ক্ষেত্রেও তিনি মানবিক দৃষ্টান্ত রেখেছেন।
বঙ্গবন্ধুর পররাষ্ট্রনীতির মূল কথা ছিল সবার সঙ্গে মৈত্রী, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়। ১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের অধিবেশন ছিল। তিনি বাংলায় বক্তৃতা দেন। তিনি অস্ত্র প্রতিযোগিতা বন্ধ করে বিশ্ব শান্তির ওপর গুরুত্ব দেন। বক্তৃতা শেষ করেন মানুষের অজেয় শক্তির ওপর বিশ্বাস রেখে।
আশফাকুজ্জামান, লেখক ও সংগঠক