লালন ও নজরুল: বাঙালির কল্পরাজ্যের দুই ভ্রাতৃসূর্যালোক

কাজী নজরুল ইসলাম (১১ জ্যৈষ্ঠ ১৩০৬—১২ ভাদ্র ১৩৮৩)প্রতিকৃতি: সব্যসাচী মিস্ত্রী

লালন-তিরোধানের (১৮৯০) প্রায় এক দশক পর নজরুলের জন্ম (১৮৯৯)। বয়সের ব্যবধান ১২৫ বছর। নজরুল জন্মসূত্রে বর্ধমান তথা রাঢ়বঙ্গের মানুষ, লালনের জন্ম ভাবুকদের দেশ নদীয়ার কুষ্টিয়ায়। রাঢ়বঙ্গের প্রকৃতির দ্বৈতরূপ অর্থাৎ ভূপ্রকৃতির রূঢ়তা ও সবুজের স্নিগ্ধতা তাঁকে দান করেছে শাক্তের বলিষ্ঠতা ও বৈষ্ণবের ভক্তিময়তা। এ কারণে তাঁর কবিতায়–গানে শাক্ত ভাবের পাশাপাশি বৈষ্ণবীয় ভাবরসের সাক্ষাৎ মেলে নানাভাবে। কিন্তু তাঁর গান-কবিতা-উপন্যাসে লালন ফকির তথা গড়াইতীরবর্তী কুষ্টিয়া অঞ্চলের কোনো বাউলের সাক্ষাৎ মেলে না। নজরুল রাজনৈতিক কর্মসূচি ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে যোগ দেওয়ার উদ্দেশ্যে বেশ কয়েকবার চুয়াডাঙ্গার কার্পাসডাঙ্গা ও কুষ্টিয়ায় এসেছিলেন। অথচ একটিবারের জন্যও লালন মাজারে যাওয়ার অন্তর্গত তাগিদ অনুভব করেননি।

কিন্তু কেন? নজরুল কি লালনকে চিনতেন না? লালনের গান-দর্শনের সঙ্গে কি তাঁর কোনোই অন্তরঙ্গতা ছিল না? অথচ বিস্ময়কর ব্যাপার এই, দুজনের চিন্তাধারা ও দর্শনের মধ্যে রয়েছে উল্লেখ করার মতো মিল। দুই বঙ্গসন্তানের দিকে তাকালে মনে হয়, লালন ও নজরুল যেন বাঙালির মানস ভুবনের দুই ভ্রাতৃসূর্যালোক। দুজনেই সারা জীবন মানুষ ও মানবিকতার জয়গান গেয়েছেন। লালন উচ্চস্তরের সাধক আর নজরুল কবি, গীতিরচয়িতা, সাংবাদিক, চলচ্চিত্রকার। দুজন দুই ভিন্ন শতাব্দীর বাসিন্দা, দুজনের যুগ-জগৎ আলাদা, ঘরানাশৈলী আলাদা, পেশা–নেশার মধ্যেও পৃথকতা রয়েছে; অথচ তাঁদের ভাবনার মধ্যে রয়েছে অসাধারণ সাদৃশ্য। ভাগ্যদেবতার বিচারে একজন জীবৎকালে যশ-খ্যাতি, পরিচিতি ও বরমাল্য পেয়েছেন, পেয়েছেন জাতীয় কবির অভিধা। আর অন্যজনকে ভাগ্যের ফেরে লোকচক্ষুর অন্তরালে মানবলীলা সাঙ্গ করতে হয়েছে। একজনের কবিতা-গান-প্রবন্ধ স্কুল-কলেজের পাঠ্যতালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে; আর অন্যজনের রচিত গান শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাঠ্যতালিকায় অন্তর্ভুক্ত হওয়া তো দূরের কথা, শিক্ষাতাত্ত্বিকদের নজরে-গোচরেই আসেনি। মুক্তিযুদ্ধের পর থেকে বাংলাদেশে নজরুলকে নিয়ে বেশ টানাটানি চলছে। তবে লালনের প্রতি বাংলাদেশের শিষ্টসমাজ এবং রাষ্ট্রের শাসকগোষ্ঠী ও সমাজপতিরা তেমন সুবিচার করতে পারেননি। লালন মাজার বা লালন কমপ্লেক্সের নামে কিছু প্রকল্প হাতে নেওয়া হলেও তাঁর দর্শন জনমনে ছড়িয়ে দিতে সত্যিকারের কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। না পারার কারণও আছে। আসলে লালন সাবঅলটার্ন তথা নিম্নবর্গীয় সমাজচ্যুত মানুষের প্রতিনিধি। তাঁর অবস্থান ছিল উচ্চধর্ম, উচ্চবর্ণ ও প্রাতিষ্ঠানিকতার বিরুদ্ধে। তিনি যে গান গেয়েছেন এবং বেঁধেছেন, তাতে পরিস্ফুট হয়েছে নিম্নবর্গীয়দের জীবনযন্ত্রণা। জাতপাত ও বর্ণব্যবস্থার বিরুদ্ধে তিনি গান গেয়েছেন।

লেনিন তাঁর ‘অন লিটারেচার অ্যান্ড আর্ট’ বইয়ে বলেছেন, একটি জাতির গভীরে দুটি ভিন্ন ধারার সংস্কৃতি থাকে। একটি শোষকের পক্ষে, অপরটি শোষিতের দিকে। বুঝে হোক আর না-বুঝে হোক, সমাজের প্রতিটি মানুষই এই দ্বন্দ্বে কোনো না কোনো ভূমিকা পালন করেন। এ ক্ষেত্রে কেউই শ্রেণিনিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করতে পারে না। ঠিক তেমনি লালন-নজরুলও শ্রেণিনিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করতে পারেননি। তাঁরাও শোষিত-বঞ্চিত, সামাজিকভাবে দীর্ণ, অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া মানুষের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন, কথা বলেছেন।

লালন ও নজরুল দুজনেই জন্মগ্রহণ করেন অজপাড়াগাঁয়ের অর্থনৈতিকভাবে প্রান্তিক পরিবারে। নজরুলের বাবা ফকির আহমেদ মসজিদ-মাজারে খাদেমগিরি করে যৎসামান্য উপার্জন করতেন, কিন্তু লালনের জাত ও পিতৃপরিচয় সম্পর্কে কোনো কিছুই জানা যায় না। লোকগবেষক মনসুরউদ্দিনও তাঁর পিতৃপরিচয়ের সন্ধান দিতে পারেননি। তাঁর বইয়ে পাই লালন জন্মসূত্রে হিন্দু ছিলেন, তাঁর পিতার নাম জানা যায় না, মায়ের নাম চম্পাবতী। কিন্তু নজরুলের সব থেকেও কেউই ছিল না। বাধ্য হয়ে তাঁকে কৈশোরেই নেমে পড়তে হয় জীবিকা ও উপার্জনের কঠিন-কঠোর সংগ্রামে। সাহিত্য-সংগীত ক্ষেত্রে যশ-খ্যাতি ও সাফল্য পেয়েছিলেন বটে, কিন্তু আর্থিক সংকট ও অনিশ্চয়তার অমানিশা থেকে কোনো দিনই মুক্তি পাননি। দারিদ্র্যের গাঢ় আঁধার লালনকেও ঘিরে রেখেছিল। সারা জীবন পোহাতে হয়েছে দারিদ্র্য–লাঞ্ছিত জীবনের যন্ত্রণা। কিন্তু নিজেকে কখনো গরিব ভাবেননি, দারিদ্র্যের জন্য কারও কাছে নতজানু হননি। নজরুলও দারিদ্র্যকে সম্মানের মুকুট হিসেবে গ্রহণ করেছেন।

ফকির লালন শাহের তিরোধান দিবস উপলক্ষে আখড়াবাড়িতে ভক্ত-অনুরাগীদের ভিড়
ছবি: তৌহিদী হাসান

কৈশোর থেকে লালন ও নজরুলকে লড়তে হয়েছে সব ধরনের প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে। মানসিক অস্থিরতার কারণে নির্দিষ্ট ধর্মাদর্শ বা কোনো মতাদর্শের প্রতি তাঁরা একনিষ্ঠ হতে পারেননি। কিন্তু সাম্প্রদায়িকতা বিরোধিতায় দুজনেই ছিলেন উচ্চকণ্ঠ, দৃঢ় ও অবিচল। ধর্মীয় সম্প্রীতির চেতনা ছিল তাঁদের হৃদয়ের মর্মমূলে প্রোথিত। লালন ছিলেন তার্কিক ও যুক্তিবাদী, ধর্মের নানা বিষয় নিয়ে প্রশ্ন করেছেন। কিন্তু নজরুল ইসলাম ছিলেন সব ধর্মের প্রতি সহিষ্ণু ও শ্রদ্ধাশীল। তবে লালনের মতো নজরুলও মানবধর্মকে বড় করে দেখেছেন। মনে–প্রাণে বিশ্বাস করতেন, মানবপ্রেম হিংসার অবসান ঘটায়, জন্ম দেয় সৌহার্দ্য-সহবতের। তাঁরা দুজনেই ধর্মের ভিত্তিতে মানুষ-মানুষে ভাগ করার নীতি সমর্থন করেননি। হিন্দু-মুসলিম সংঘাত ও বিভাজনে লালন ব্যথিত হয়ে বলেছেন, ‘যবন কাফের ঘরে ঘরে/ শুনে আমার নয়ন ঝরে/ লালন বলে মারিস করে/ চিনলিনে মনের ধোঁকায়।’ নজরুল তাঁর ‘হিন্দু মুসলমান’ প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘অবতার পয়গম্বর কেউ বলেনি আমি হিন্দুর জন্য এসেছি, আমি মুসলমানের জন্য এসেছি, আমি ক্রিশ্চানের জন্য এসেছি, তারা বলেছেন আমরা মানুষের জন্য এসেছি, আলোর মতন সকলের জন্য’।

নজরুল শৈশব থেকেই ইসলাম ধর্মের আচার-আচরণ, কোরআন-হাদিসের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন। মুসলমান বংশে জন্মানোর দৌলতে তাঁর ইসলাম–সম্পৃক্তি ছিল প্রবল। তারপরও তাঁকে কেতাবি ধর্মের গৎবাঁধা বুলি দিয়ে আচ্ছন্ন ও আলোড়িত করা যায়নি। বরং নানা মানুষের সঙ্গ-সান্নিধ্য পেয়ে হয়ে ওঠেন সম্প্রদায়-ঊর্ধ্ব মানুষ। কৈশোরে লেটো দলে সম্পৃক্তি তাঁকে অবগাহন করায় সনাতন ধর্ম, আধ্যাত্মিকতা ও ঐতিহ্যের স্রোতে। তাই বলে ইসলামের প্রতি অবহেলা ঔদাসীন্য দেখিয়েছেন? না, সেটাও করেননি। বরং অজস্র ইসলামি অনুষঙ্গের গান, কবিতা, গজল রচনা করেছেন।

লালন ছিলেন নির্জন পথের যাত্রী। কিন্তু সমাজ ও ঐতিহ্যলগ্ন ছিলেন মনে ও মগজে। তাঁর গানে মুসলমানের কোরআন-হাদিসের পাশাপাশি হিন্দুদের পুরাণ, পালা-পার্বণ থেকে অজস্র রূপক-উপমা এসেছে। হিন্দুর ইতিহাস-ঐতিহ্য ও মুসলমানের ইতিহাস-ঐতিহ্য মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে লালনের গানে-দর্শনে, পোশাকে-অবয়বে, বোধে-বোধিতে। বাংলা-বাঙালির কথা তাঁর গানে সেইভাবে উচ্চারিত হয়নি বটে, তারপরও তিনি আপ্লুত ছিলেন বাংলার লোকায়ত পালা, কীর্তন ও যাত্রাভিনয়ে। সেই সঙ্গে গড়াইবিধৌত কুমারখালীর ভাবতরঙ্গ ও উনিশ শতকীয় গ্রামীণ জীবনের অনাবিলতা লালনের মানবিক বিশ্বাসের জগৎকে প্রসারিত করে দেয়। গড়পড়তা বাউল মতবাদকে ছাড়িয়ে-ছাপিয়ে নিজস্ব কনসেপ্টে প্রচলিত ধর্মের ভিন্নমাত্রিক ব্যাখ্যা দিয়ে তাঁর ফকিরি মতবাদকে দাঁড় করান গানের মাধ্যমে। বৈষ্ণবীয় দ্বৈতবাদ ও মরমিয়া সুফিবাদের মিশেলে রচনা করতে থাকেন একের পর এক গান। এসব গানে ইসলামি সুফিবাদের ছাপ থাকলেও কেতাবি ইসলামের ছাপ নেই। অন্তত গানের বিচারে, লালনকে হিন্দু, মুসলমান কিংবা সুফি বলা যায় না। প্রকৃতপক্ষে তিনি ছিলেন ব্যতিক্রমী পুরুষ। সত্যি বলতে কি, তাঁর ব্যক্তি-অনুভূতিতে, বিশ্বাসে, সাধনায়-মননে, গানে-ধ্যানে যা পরিস্ফুটিত হয়েছে, তার সবটাই মানবিক।

লালন দেহাত্মবাদী হলেও নজরুল সাহিত্যে গুরুবাদ কিংবাদ দেহাত্মবাদের গোপন হাতছানি নেই। আল্লাহ, নবী, আদমকে লালন ফকির এক সত্তার ভিন্ন ভিন্ন প্রকাশ বলে ঘোষণা করেছেন। তবে নজরুল ইসলাম সেই রকম চিন্তা ক্ষুণাক্ষরেও করেননি। তারপরও লালন-নজরুল দুজনেই ছিলেন ষোলো আনা অধ্যাত্মবাদী। ভিন্নমাত্রিক অধ্যাত্মবাদের আলো দিয়ে তাঁরা মানুষকে কাছে টানতে চেয়েছেন। রুমি-হাফিজ-খৈয়ম যেভাবে ইসলামকে গ্রহণ করেছেন, লালন-নজরুলও সেইভাবে ধর্ম ও আধ্যাত্মিকতার চর্চা করেছেন। তাঁদের দুজনের মধ্যেই ছিল সহজিয়া ভাবুকতা, বিনয় ও ভক্তি। সহজিয়া ভাবুকেরা সাধারণত সাদামাটা হন। লালন-নজরুলের আধ্যাত্মিক ভাবনার মধ্যেও কোনো জটিলতা নেই, বরং তা নদীর জলের মতো স্বচ্ছ ও স্বাদু, গানের আবেগের মতো উচ্ছ্বাসে ভরা।

লালন-নজরুলও স্বপ্নকাতর ছিলেন একটি সম্প্রীতিমুখর ও কল্যাণময় সমাজের প্রতিষ্ঠার জন্য। তাঁরা বিদ্রোহ করেছেন অন্যায়, অসত্য, অসুন্দরের বিরুদ্ধে। মধ্যযুগ ছুঁয়ে যাওয়া এক প্রত্যন্ত গ্রামে বসবাস করেও যুক্তি-তর্কের মাধ্যমে আমজনতাকে উদারতা ও মানবতার বাণী শুনিয়েছেন লালন। আর নজরুলের বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর ঘুমন্ত জাতিকে উজ্জীবিত ও অনুপ্রাণিত করেছে শৃঙ্খল ভাঙার জন্য।

পুঁথি-পাঁচালি ঘাঁটাঘাঁটি করলে জানা যায়, আমাদের সমাজে সৌহার্দ্য-সম্প্রীতির ঝকঝকে আলোর পাশাপাশি সাম্প্রদায়িক ভেদ-বিভেদের গাঢ় আঁধারও ছিল। নইলে কেন মধ্যযুগ থেকেই বাংলার কবি-ভাবুকদের ধর্মমোহ ও ধর্মতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হতে হয়েছে? কারণ, সাম্প্রদায়িকতাবাদী জাতবিচারিদের হানাহানিতে বারবার ক্ষতবিক্ষত হয়েছে বাংলার সমাজ-রাষ্ট্র ও সংস্কৃতি। সাম্প্রদায়িক হিংসার লেলিহান শিখায় পুড়ে ছাই হয়েছে আমাদের আটপৌরে জীবন ও বাস্তুভিটা। এসব দেখে লালন ক্ষুব্ধ চিত্তে বলেছেন, ‘জাত-বিচারি ব্যভিচারী/ জাতির গৌরব বাড়াবাড়ি/ দেখিলাম চেয়ে।/ লালন বলে হাতে পেলে/ জাতি পোড়াতাম আগুন দিয়ে।’ লালনের সমকালে সমাজে জাতিভেদের বাড়াবাড়ি, সেই বাড়াবাড়ি থেকে মুক্ত ছিল না বিংশ শতাব্দীর ব্রিটিশ ভারত।

লালন-নজরুলও স্বপ্নকাতর ছিলেন একটি সম্প্রীতিমুখর ও কল্যাণময় সমাজের প্রতিষ্ঠার জন্য। তাঁরা বিদ্রোহ করেছেন অন্যায়, অসত্য, অসুন্দরের বিরুদ্ধে। মধ্যযুগ ছুঁয়ে যাওয়া এক প্রত্যন্ত গ্রামে বসবাস করেও যুক্তি-তর্কের মাধ্যমে আমজনতাকে উদারতা ও মানবতার বাণী শুনিয়েছেন লালন। আর নজরুলের বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর ঘুমন্ত জাতিকে উজ্জীবিত ও অনুপ্রাণিত করেছে শৃঙ্খল ভাঙার জন্য। কিন্তু তাঁদের সেই আহ্বানে সবাই সাড়া দেয়নি। মুসলমান রক্ষণশীলেরা লালনের প্রতি ‘বেদ্বীন, বেশরা, জাত-ধর্মহীন নাড়ার ফকির’ প্রভৃতি ঘৃণাসূচক অবজ্ঞা বাণী ছুড়ে দিয়েছে। উচ্চবর্গী পণ্ডিতেরা লালনের গানে ‘যথেষ্ট রসবোধের পরিচয়’ খুঁজে পাননি বরং ‘গ্রাম্যতাদোষে দুষ্ট’ বলে তাচ্ছিল্য করতে চেয়েছেন। মাওলানা আকরাম খাঁ লালন ও নজরুল দুজনকেই আক্রমণ করেছেন। সংস্কৃতিমান হিন্দুরা তাঁর গান পছন্দ করতেন, তাঁকে কখনো কখনো গৃহেও আমন্ত্রণ জানাতেন, কিন্তু ব্রাহ্মণ নয় জেনে নজরুলের উপস্থিতিতে অন্যরা অস্বস্তি বোধ করতেন। আর মুসলমান রক্ষণশীলেরা তো তাঁকে ধর্মদ্রোহী, কুলাঙ্গার, শয়তান, নাস্তিক, ফেরাউনসহ নানা অপ–অভিধায় ভূষিত করেছে। নজরুল তাঁর সমালোচকদের আচরণে ক্ষুব্ধ-মর্মাহত হয়েছেন, কিন্তু খুব বেশি পাত্তা দিতে চাননি। লালনও ধর্মীয় গোঁড়ামির কাছে অত্মসমর্পণ করতে চাননি।

নজরুল সম্প্রদায়গতভাবে তো বটেই, বিশ্বাসের দিক দিয়েও খাঁটি মুসলমান ছিলেন। তারপরও চেয়েছিলেন হিন্দু-মুসলমান সংস্কৃতির মধ্যে সমন্বয় ঘটিয়ে দুই পক্ষকে হ্যান্ডশেক করাতে। কাউকে বাদ দিয়ে নয়, বরং সবাইকে নিয়ে সম্প্রদায়-ঊর্ধ্ব হতে চেয়েছিলেন। লালনও সম্প্রদায়-ঊর্ধ্ব মানুষ ছিলেন। ধর্মবিরোধিতা না করে, মানবতাকে তিনিও অধিকতর প্রাধান্য দিয়েছেন। লালন-নজরুল ভিন্ন শতাব্দীর মানুষ হলেও তাঁদের চেতনাজগৎটি ছিল চিরায়ত বাংলার স্বচ্ছ আলোছায়ায় পুষ্ট ও সমৃদ্ধ। কালের পরিক্রমায় বাংলার সেই শাশ্বত রূপটি অনেকাংশেই ফিকে হয়ে গেছে। তারপরও লালন ও নজরুলের গান-কবিতার মাধ্যমে তা জেগে আছে। আপামর বাঙালি যদি সত্যিকার অর্থে তাঁদের গ্রহণ করে নিতে পারে, তবেই যথার্থ মানুষ ও বিশ্বনাগরিক হতে পারবে। সেই সঙ্গে ফিরে পাবে চিরায়ত বাংলাদেশকে। কারণ, দুজনেই এক জায়গায় এসে মিলিত হয়েছেন। লালন বলেছেন, ‘অনন্তরূপ সৃষ্টি করলেন সাঁই, শুনি/ মানবের উত্তম কিছু নাই’। আর নজরুল বলেছেন, ‘মানুষের চেয়ে নাই কিছু বড়, নহে কিছু মহীয়ান।’

সভাপতি, মেহেরপুর বন্ধুসভা ও সহযোগী অধ্যাপক, মেহেরপুর সরকারি কলেজ