উদ্যোগেই স্বপ্নপূরণ

উদ্যোক্তা হতে হলে

তরুণেরা বরাবরই জীবনে বড় কিছু করার স্বপ্ন দেখেন। নিজেদের তাঁরা সফল মানুষ হিসেবে দেখতে চান। আজকের যুগের ছেলেমেয়েরা অনেক আগে থেকেই তাদের লক্ষ্য সামনে রেখে নিজেদের তৈরি করে। লেখাপড়াসহ নানা দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য পরিকল্পনা করে। কিন্তু সফলতার শীর্ষে পৌঁছানোর পন্থা খুঁজতে গিয়ে অনেকেই তাদের স্বপ্নের গণ্ডিটাকে আটকে ফেলে শুধু ভালো একটা চাকরি পাওয়ার ভেতর। এতে প্রতিযোগিতার দৌড়ে ভালো চাকরি হয়তো পেয়ে যায়, কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই সেই পেশায় নিজের স্বকীয়তা ও সৃজনশীলতা প্রমাণ করার সুযোগ হয় না। ফলে জীবনের সবচেয়ে উজ্জ্বল সময়টাই ব্যয় হয়ে যায়, প্রতিষ্ঠানের স্থির করা লক্ষ্যের পেছনে ছুটতে ছুটতে। ভালো চাকরির এই গৎবাঁধা ধারণা থেকে বের হয়ে এসে তাই নতুন কিছু করার ব্যাপারে তরুণদের আরও উৎসাহী হতে হয়। নিজের আগ্রহ, উদ্যম ও সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে একটি সফল ব্যবসায় উদ্যোগ নেওয়ার এখনই সঠিক সময়।

খুব সহজ ভাষায়, ব্যবসায় উদ্যোগ বলতে আমরা বুঝি, কোনো নতুন কিছু করার উদ্দেশ্যে সব ধরনের সম্পদকে কাজে লাগিয়ে এবং ঝুঁকি নিয়ে কোনো পণ্য উৎপাদন করা বা সেবা প্রদান করা এবং এর বদলে আর্থিক মুনাফাসহ অন্যান্য সুবিধা ভোগ করা। যিনি বা যাঁরা এই কাজ করেন, তাঁদের আমরা উদ্যোক্তা বলে থাকি। অর্থনীতির ভাষায়, ভূমি, মানবসম্পদ ও পুঁজি—উৎপাদনের এই তিন নিয়ামককে কাজে লাগিয়ে শুধু একজন উদ্যোক্তাই পারেন নতুন কিছু তৈরি করতে। আর এভাবেই দেশের অর্থনীতিতে প্রাণসঞ্চার হয় এবং আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা সহজ হয়।

উদ্যোগ নিয়ে যত ভ্রান্তি
উদ্যোগ ও উদ্যোক্তা নিয়ে আমাদের সমাজে বেশ কিছু ভ্রান্ত ধারণা প্রচলিত আছে। যে কারণে ছোটবেলা থেকেই ছেলেমেয়েরা ব্যবসায় উদ্যোগ বিষয়টি থেকে একপ্রকার দূরেই সরে থাকে। আমাদের সমাজে মনে করা হয়, ভালো চাকরি না পেয়েই বোধ হয়। লোকে ব্যবসা করে। উন্নত দেশগুলোতে ছাত্র-বয়স থেকেই ছেলেমেয়েরা উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন দেখে এবং সেভাবেই নিজেদের গড়ে তোলে। অনেকের ধারণা, পারিবারিক সূত্রে ব্যবসায়িক জ্ঞান না থাকলে, নিজে থেকে বড় ব্যবসায়ী হওয়া যায় না, আবার এমনও মনে করা হয় যে তরুণ বয়সে শুরু না করলে পরে ব্যবসায় আসা সম্ভব নয়। কেউ কেউ ভাবেন, অনেক বিশাল পুঁজি ছাড়া বোধ হয় ব্যবসা শুরু করা যায় না। এই সবকিছুই আসলে অমূলক ধারণা। বিশ্বজুড়ে, প্রথম প্রজন্মের প্রচুর উদ্যোক্তা উঠে আসছেন, যাঁরা এ বিষয়টি শিখে পড়ে নিচ্ছেন। তরুণদের পাশাপাশি আজ মাঝ-বয়সেও একটু অভিজ্ঞতা নিয়ে নতুন ব্যবসা শুরু করছেন। আর সঠিক ও বিস্তারিত পরিকল্পনা থাকলে মূলধন জোগাড় করাও খুব কঠিন হয় না। তাই উদ্যোক্তা হওয়ার পথে শুরুতেই এসব ভ্রান্ত ধারণা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।

কেন উদ্যোক্তা হব
এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন যে ব্যবসায় উদ্যোগ আসলে ব্যক্তিজীবনে বা সমাজজীবনে কীভাবে ভূমিকা রাখে। একটু বিশ্লেষণ করলেই বোঝা যাবে, যেকোনো ক্ষেত্রেই উদ্যোগের ভূমিকা অসীম। প্রথমত, একজন উদ্যোক্তা নতুন কিছু উদ্ভাবনের চেষ্টা করেন, যা হয়তো আগে ছিল না বা থাকলেও এই নতুন আঙ্গিকে ছিল না। তাই উদ্যোগ সব সময়ই নতুন জ্ঞান ও ধারণার প্রসারে সহায়তা করে। এ ছাড়া প্রতিটি ব্যবসাই কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে, যা কিনা দেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। সামাজিক প্রেক্ষাপট বিবেচনা করলে এসব নতুন উদ্ভাবিত পণ্য ও সেবা আমাদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করছে; শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিনোদনসহ নানা খাতে উন্নতি হচ্ছে। এ ছাড়া ক্ষুদ্র উদ্যোগ থেকে তৈরি পণ্য বা সেবা, বড় শিল্পগুলোতে নানাভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এভাবে একটি উদ্যোগ, সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রেই নতুন মাত্রা যোগ করতে পারে।

উদ্যোগের ধরন
উদ্যোক্তা হতে হলে যে সব সময় বিশাল কিছু আবিষ্কার করতে হবে, তা কিন্তু নয়। আর এটা মহাকাশবিদ্যার মতো জটিল কিছুও নয়। আমাদের আশপাশের বিভিন্ন সমস্যা থেকে ধারণা নিয়ে, সেগুলোর সমাধানের জন্য প্রয়োজন, এমন কোনো বিষয় নিয়ে ছোট আকারে একটা ব্যবসার উদ্যোগ নেওয়া সম্ভব। এ ক্ষেত্রে অবশ্যই লক্ষ রাখতে হবে যে উৎপাদিত পণ্যের যেন চাহিদা থাকে বাজারে। ছোট পরিসরে, স্বল্প লাভে, বাড়িতে বসেই কিছু ব্যবসা শুরু করা যায়, যেমন বুটিক শপ, খাবারের ক্যাটারিং, হাতের কাজের দোকান ইত্যাদি। তেমনি আবার নিজের পছন্দের বিষয়টিকেও উদ্যোগের নিয়ামক হিসেবে ব্যবহার করা যায়। যেমন ফটোগ্রাফি, ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট, ট্যুরিস্ট গাইড, অ্যাপস তৈরি করা ইত্যাদি। এসব ফ্রিল্যান্সিং কাজ থেকেও একটি ব্যবসা তৈরি করা যায়। এর বাইরে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে, বড় পরিসরে, লোকজন নিয়োগ করে, পরিকল্পনা করে, নতুন ব্যবসার উদ্যোগও নেওয়া যায়।

উদ্যোক্তা হতে হলে করণীয়
যদিও কোনো ধরাবাঁধা ছক নেই, তবু উদ্যোক্তা হতে হলে একজন মানুষের মধ্যে কিছু বৈশিষ্ট্য ও গুণাগুণ থাকা আবশ্যক। সফল উদ্যোক্তা হতে হলে যে বিষয়গুলো গুরুত্বপূর্ণ, তা হলো—
সাফল্যের ব্যাপারে উচ্চাকাঙ্ক্ষী হওয়া এবং সেই লক্ষ্যে কাজ করতে প্রস্তুত থাকা।
ব্যর্থতায় দমে না গিয়ে পূর্ণোদ্যমে আবার কাজ শুরু করা।
কর্মঠ, সৎ, ধৈর্যশীল ও ইতিবাচক মানসিকতার অধিকারী হওয়া।
সঠিক সময়, সঠিক স্থানে, নিজের বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগ করে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া।
ঝুঁকি নেওয়ার প্রবণতা থাকা।
স্বতঃস্ফূর্তভাবে, আনন্দের সঙ্গে কাজকে উপভোগ করতে পারা।

এসব বিষয় রপ্ত করতে পারলে উদ্যোগ নেওয়া অনেক সহজ হয়ে যাবে। ব্যবসায় উদ্যোগের জন্য চারটি ধাপে কাজ করা যায়। যেমন:
১. প্রথমত, উদ্যোক্তা হওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া। এখানে মনস্থির করাটা খুবই জরুরি বিষয়।
২. একটি সফল ব্যবসায়িক ধারণা অর্থাৎ ‘ইনোভেটিভ আইডিয়া’ দাঁড় করানো।
. এরপর সেই ধারণাকে বাস্তবায়ন করে ব্যবসার রূপ দেওয়া।
৪. ব্যবসাটি পরিচালনা করা ও এর প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করা। এভাবেই ধাপে ধাপে একটি সফল ব্যবসায় উদ্যোগ নেওয়া যায়।

ব্যবসায় উদ্যোগের প্রস্তুতি
বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তির যুগে, ব্যবসায় উদ্যোগের কাজগুলো অনেক সহজ হয়ে এসেছে। কম্পিউটার, ইন্টারনেট আর সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলো ব্যবসার প্রসারকে অনেক দ্রুত ও কার্যকর করে তুলেছে। যাঁরা উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন, তাঁরা ছাত্র অবস্থা থেকেই প্রস্তুতি নিতে পারেন। যেমন:
ইন্টারনেটে প্রচুর নতুন ধারণা ও বিশ্বজুড়ে শুরু হওয়া ‘নিউ স্টার্টআপ’ ব্যবসাগুলোর তথ্য পাওয়া যায়, সেগুলো থেকে ধারণা নেওয়া।
ছাত্র বয়সেই নিজেদের ‘ব্যবসার পরিকল্পনা’ তৈরি করা ও অভিজ্ঞ লোকদের দিয়ে সেগুলো যাচাই করানো।
আমাদের দেশে এবং বিদেশেও বছরজুড়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, সরকারি, বেসরকারি ও বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো, ‘বিজনেস প্ল্যান কম্পিটিশন’, ‘কেস কম্পিটিশন’ ইত্যাদি আয়োজন করে, সেগুলোতে নিয়মিত অংশ নেওয়া।
সমমানসিকতার বন্ধুরা মিলে নিজেদের দল গঠন করা ও সবার সঙ্গে নেটওয়ার্কিং করা।
ব্যবসার সঙ্গে প্রাসঙ্গিক বিষয়গুলোতে প্রশিক্ষণ নিয়ে নিজেদের দক্ষতা বৃদ্ধি করা।
ব্যবসার মূলধন বিষয়ে সুস্থ ও সঠিক ধারণা তৈরি করা এবং মূলধন জোগাড়ের উৎসগুলো খুঁজে বের করা।
বিভিন্ন ব্যাংক এসএমই লোন দেয়। এ ছাড়া দেশ-বিদেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান নতুন উদ্যোক্তাদের অর্থ ও কারিগরি সহায়তা দেয়, এসব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা।
সর্বোপরি উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেকে তৈরি করা এবং নিজের ওপর বিশ্বাস রাখা।

এভাবেই ছোট ছোট পদক্ষেপেই পেরিয়ে যাওয়া সম্ভব স্বপ্নের সীমানা। উদ্যোগের মাধ্যমেই নাম লেখানো সম্ভব আগামী দিনের সফলদের তালিকায়। উদ্যোগেই তাই সফল হোক স্বপ্ন।

লেখাটি ২০১৫ সালের অক্টোবরে প্রকাশিত বন্ধুসভা জাতীয় পরিচালনা পর্ষদের ‘তারুণ্য’ ম্যাগাজিনের পঞ্চম সংখ্যা থেকে নেওয়া।