ইরাবতী

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

ইরাবতীর হাত কাঁপছে। সে নিজের নাম স্বাক্ষর করতে পারছে না। কলম থেকে কালি যেন বের হচ্ছে না। সারা শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে। জীবনে এ রকম বড় ধরনের কোনো সিদ্ধান্ত সে আগে কখনো নেয়নি। আজ সকালেই দ্রুত এ সিদ্ধান্তটা নিয়েছে। অনেক আগে থেকেই সে জানত, এ সিদ্ধান্তটা তাকে নিতে হবে। কিন্তু আজ নেওয়ার পর থেকে তার নিজের মধ্যে কেমন যেন অস্বস্তি শুরু হচ্ছে। ঠিক, না ভুল করছে, তা বুঝতে পারছে না। কাউকে বলতেও পারছে না। বলার মতো সহজ বিষয়ও নয় এটা।

পাশের চেয়ারে বসা কামরুল বলল, ‘তুমি একটু সময় নাও, তাড়াহুড়ার কিছু নেই। জল খাবে?’ ইরাবতী মুখে কিছু না বললেও মাথা ঝাঁকিয়ে না করল। কামরুল তবু টেবিলে রাখা জলভরা কাচের গ্লাসটা এগিয়ে দিয়ে ইশারায় ইরাবতীকে জল খেতে বলল। ইরাবতী গ্লাসটা হাতে নিয়ে জল খেল।

শাহজাহানপুর একটা মফস্‌সল এলাকা। এখানেই বড় হয়েছে ইরাবতী। ইন্টারে পড়ার সময় একই কলেজের এক বছরের সিনিয়র কামরুলের সঙ্গে পরিচয় হয়। পরিচয়টা একপর্যায়ে বন্ধুত্বে এবং তার পর থেকে ভালো লাগা ও ভালোবাসায় রূপ নেয়। ধর্মের ভিন্নতার কারণে দুজনই মনের গভীরতম কথা প্রকাশ করতে পারেনি দীর্ঘ সময়। তারপর প্রকাশ পেল এবং কয়েক বছর কেটে গেল। কামরুল কাজে ব্যস্ত থাকার কারণে ফোনেই তাদের প্রেমালাপ বেশি হতো। কামরুল নিজেকে গুছিয়ে নিলে এবং ইরাবতী স্নাতকোত্তর শেষ করার পর বিয়ে করার পরিকল্পনা করেছিল দুজনই। কিন্তু যখন ইরাবতীর স্নাতক পড়া শেষ হলো, ঠিক তখনই সমস্যাটা শুরু হলো। বাড়ি থেকে বিয়ের জন্য সম্বন্ধ দেখা শুরু করেছে। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে ইরাবতী সবচেয়ে ছোট। তাই সবার আদরেরও সে। এ কারণে মুখ ফোটে পরিবারের সদস্যদের নিজের মনের কথা খুলে বলতে পারেনি।

ইরাবতী তার বাবার সবচেয়ে আদরের মেয়ে। মেয়ের কোনো আবদারই বাবা অপূর্ণ রাখেননি। কয়েক দিন আগে ইরাবতী অনেক ভেবে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যেভাবেই হোক সে তার বাবাকে সম্পর্কের কথাটা জানাবে। বাবা তার কথা ফেলতে পারবে না। কিন্তু পরক্ষণেই মনে পড়ল, কাকাতো বোন ছন্দার কথা। অন্য ধর্মের ছেলেকে পালিয়ে বিয়ে করায় প্রায় ১০ বছর হলো পরিবারের সঙ্গে তার কোনো যোগাযোগ নেই। তাই ইরাবতী নির্দিষ্ট কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারছে না। আবার তার বাবা দুবার স্ট্রোক করেছে। এ অবস্থায় বাবা উত্তেজিত হয়ে যায়, এমন কিছু বলা উচিত হবে না। তখনই থেমে যায় ইরাবতী।

অন্যদিকে কামরুল ইরাবতীকে মন থেকে ভালোবাসলেও হঠাৎ বিয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে বললে সে দিশাহারা হয়ে পড়ল। মা-বাবা ও তিন ভাইবোনের সংসার টানতে হয় তাকে। প্রাইভেট একটা চাকরি করে সবকিছু সামাল দিতেই হিমশিম খেয়ে যায়। এর মধ্যে এমন সিদ্ধান্ত নিতে সে ভয় পাচ্ছে। আবার সে ইরাবতীকে হারাতেও চায় না। একমাত্র বোনও বিবাহের উপযুক্ত হয়েছে। ছোট ভাইটা সামনের বছর ভার্সিটিতে ভর্তি পরীক্ষা দেবে, বাবা প্যারালাইজড হয়ে বিছানায় রয়েছে প্রায় দুই বছর হলো। এমন সময় কামরুল ঠিক কী করবে, তা বুঝতে পারছে না।

বিকেলে বাসায় ঘরভর্তি মেহমান। ইরাবতীকে ছেলের বাড়ি থেকে পাকা দেখা ও আশীর্বাদ করতে এসেছে। ছেলে অস্ট্রেলিয়ায় থাকে, পড়াশোনার সুবাদে গিয়ে সেখানেই সেটেল্ড হয়েছে। ছেলের বাড়ি আর ইরাবতী উভয়ের আর্থিক অবস্থা ভালো—তাই সব কথা হয়ে গেছে। এখন শুধু ছেলে ও মেয়ের দেখা আর পছন্দ হওয়া বাকি। সেটা হলে আজই আশীর্বাদ হওয়ার কথা। ছবি দেখে ও বিস্তারিত জেনে দুই পক্ষেরই পছন্দ হয়েছে।

স্বাক্ষর না করেই খাতা থেকে হাতটা সরাল ইরাবতী। কামরুল কাজি সাহেবকে বলল, ‘আমরা একটু পর আসছি, ওর শরীরটা খারাপ লাগছে, আপনি একটু অপেক্ষা করুন।’ প্রত্যুত্তরে কাজি সাহেব বলল, ‘একটু তাড়াতাড়ি হলে ভালো হয়, আমার তাড়া আছে। আধঘণ্টা আগে একজন কল দিয়ে বলল তাদের বাড়িতে গিয়ে বিয়ে পড়াতে। বিকেল গড়িয়ে এল, আপনারা যদি তাড়াতাড়ি করেন, তাহলে ভালো হয়।’ জ্বি, আচ্ছা, বলে কামরুল ও ইরাবতী বের হয়ে গেল। সঙ্গে আসা সাক্ষীরাও বের হয়ে গেল। সব ব্যবস্থাই কামরুল দ্রুত করেছিল।

বাইরে বের হওয়ার পর ফোন হাতে নিয়ে ইরাবতী দেখল, তার মা বারবার কল করছে। সে কল ধরার সাহস পাচ্ছে না। এদিকে বাসা থেকে বের হয়েছে প্রায় দুই ঘণ্টা হয়ে গেল। ইতিমধ্যে ছেলের বাড়ির লোকজনও মনে হয় এসে পড়েছে। পারলারে যাব বলে দুপুরে বান্ধবী মেঘলার সঙ্গে ইরাবতী বের হয়েছিল। ছেলের বাড়ি থেকে জানিয়েছে, মেয়ে তাদের পছন্দ হয়েছে। ছেলে সরাসরি এসে দেখার পর উভয়ের পছন্দ হলে আজই তারা আশীর্বাদ করতে চায়।

ইরাবতী ফোন রিসিভ করল। ওপাশ থেকে মা বলছে, ‘কিরে তোরা কই, ছেলের বাড়ির লোকজন এসে পড়েছে, তোর সাজা এখনো হলো না। তাড়াতাড়ি আয়, তোর বাবা খুব চিন্তা করছে।’ আসছি মা বলে সে কলটা কেটে দিল। কামরুল বলল, ‘তোমার এখন ভালো লাগলে আমরা ভেতরে যেতে পারি, চলো।’ ইরাবতী কামরুলের হাত ধরে কাজি অফিসের ভেতরে গেল।

সন্ধ্যা প্রায় হয়ে এসেছে। আকাশ কালো হয়ে আছে, সম্ভবত বৃষ্টি হবে। ইরাবতী ও কামরুল এক রিকশায় করে যাচ্ছে। কেউ কোনো কথা বলছে না। ইরাবতীর অস্থিরতা এখনো কমছে না। কিন্তু কামরুল শান্ত হয়ে আছে, যেন কিছুই হয়নি। বাসার কাছের মোড়ে ইরাবতীকে নামিয়ে দিয়ে সে বলল, ‘বাসায় গিয়ে একটু বিশ্রাম নিয়ো আর নিজের যত্ন নিয়ো। তোমার জীবন সুন্দর হোক।’

ইরাবতী দাঁড়িয়ে আছে আর রিকশাটার চলে যাওয়া দেখছে, যত দূর দেখা যায়। চলে যাওয়ার সময় কামরুল একবারও ফিরে তাকাল না।

বন্ধু, নরসিংদী বন্ধুসভা