পৌষসংক্রান্তি বাংলাদেশের একটি ঐতিহ্যবাহী উৎসব। যা প্রাচীনকাল থেকেই গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। শীতকালীন এ উৎসব শুধু আনন্দের উপলক্ষ নয়, এটি বাংলার কৃষিভিত্তিক সমাজব্যবস্থার সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত। পৌষসংক্রান্তি মূলত মাঘ মাসের প্রথম দিন পালিত হয় এবং এটি বাংলার মাটির সংস্কৃতিকে উজ্জীবিত করে। গ্রামীণ মেলাকে কেন্দ্র করে নানা ধরনের সাংস্কৃতিক কার্যক্রম, ঐতিহ্যবাহী খাবার ও সামাজিক মেলবন্ধনের পরিবেশ সৃষ্টি হয়।
পৌষসংক্রান্তির উৎপত্তি ও ঐতিহাসিক পটভূমি
পৌষসংক্রান্তি শব্দটি এসেছে ‘সংক্রান্তি’ শব্দ থেকে; যার অর্থ সূর্যের এক রাশি থেকে অন্য রাশিতে প্রবেশ। পৌষ মাসের শেষ দিনে সূর্য মকর রাশিতে প্রবেশ করে। তাই এটিকে ‘মকরসংক্রান্তি’ নামেও ডাকা হয়। কৃষিভিত্তিক এ উৎসব মূলত ফসল কাটার সমাপ্তি উপলক্ষে উদ্যাপিত হয়। নতুন ধান, খেজুরের রস ও পিঠাপুলির আয়োজন এ উৎসবের অবিচ্ছেদ্য অংশ। গ্রামীণ জীবনে এটি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির প্রতীক।
মেলার বৈচিত্র্য ও আয়োজন
পৌষসংক্রান্তির মেলা গ্রামীণ জীবনের এক অনন্য উৎসব। যেখানে মেলার প্রাণশক্তি হয়ে ওঠে স্থানীয় জনগোষ্ঠী। এ মেলায় পাওয়া যায় হাতের তৈরি বিভিন্ন পণ্য যেমন মাটির পাত্র, বাঁশের তৈরি সামগ্রী, হস্তশিল্প, কাঠের খেলনা ও রঙিন চুড়ি। গৃহস্থালির প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রও পাওয়া যায়। মেলার অন্যতম আকর্ষণ থাকে পিঠাপুলির স্টল। পাটিসাপটা, ভাপা, চিতই এবং দুধপিঠার সুগন্ধ মেলাকে ভিন্ন মাত্রা দেয়। নতুন ধানের গুঁড়া ও খেজুরের গুড় দিয়ে তৈরি এসব পিঠা বাংলার ঐতিহ্যের গল্প বলে।
শিশুদের জন্য মেলায় থাকে নানা ধরনের খেলার আয়োজন। নাগরদোলা, মাটির পুতুল এবং রঙিন বেলুন মেলায় প্রাণবন্ত পরিবেশ তৈরি করে। অন্যদিকে বড়দের জন্য থাকে নৌকাবাইচ, কুস্তি, লাঠিখেলা ও মোরগ লড়াইয়ের মতো ঐতিহ্যবাহী খেলাধুলা।
সাংস্কৃতিক পরিবেশনা
পৌষসংক্রান্তির মেলার আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। বাউলগান, কবিগান এবং লোকনৃত্য মেলাকে জীবন্ত করে তোলে। গ্রামের শিল্পীরা নিজেদের প্রতিভা তুলে ধরার সুযোগ পান এই মেলার মাধ্যমে। বাউলগানের কথা, সুর এবং তালের মধ্যে লুকিয়ে থাকে গ্রামীণ জীবনের সুখ-দুঃখের চিত্র। এ ছাড়া যাত্রাপালা ও পালাগানের পরিবেশনা গ্রামীণ সংস্কৃতির অন্য রকম উদাহরণ।
সামাজিক মেলবন্ধন
পৌষসংক্রান্তির মেলা সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের মধ্যে বন্ধন গড়ে তোলে। ধনী-গরিব, উঁচু-নিচু সব পার্থক্য ভুলে সবাই একত্রিত হয়। এটি গ্রামের মানুষের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ তৈরি করে। মেলাপ্রাঙ্গণে ছোট ছোট বৈঠক, গল্পগুজব ও একসঙ্গে খাবার খাওয়ার মাধ্যমে সামাজিক মেলবন্ধনের এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়।
দুপচাঁচিয়া, বগুড়া