আমরা কাজিনেরা দাদার মাকে ‘বড় মা’ বলে ডাকতাম। মানুষটি ছিলেন মায়ের মতোই মমতাময়ী। তাঁর সোহাগ, সারল্য আর বাচ্চাদের মতো মুখটেপা হাসি ছিল প্রাণবন্ত। বাড়ির সবাইকে খুব ভালোবাসতেন।
তিনি রাত জেগে ঠুকঠুক করে লাঠিতে ভর দিয়ে সবার রুমে গিয়ে খোঁজখবর নিতেন—কে বাসায় এসেছে আর কে এখনো আসেনি। সবার চিন্তায় উদ্বিগ্ন হয়ে থাকতেন। তিনি যেমন সবাইকে স্নেহ আর ভালোবাসার চাদরে জড়িয়ে রাখতেন, তেমনই সবাই ওনাকে ঘিরে থাকত—যেভাবে বটের ঝুরিগুলো বটবৃক্ষকে পরম মমতায় পেঁচিয়ে রাখে।
ফুফু আর বাবা-কাকারা বড় হয়ে যাওয়ার পরে পরবর্তী প্রজন্ম—মানে আমরা কাজিনেরা বড় মার সঙ্গে রাতে ঘুমানোর জন্য একপ্রকার যুদ্ধ বাধিয়ে দিতাম। যে জিতে যেত, সেই পেত বড় মার সঙ্গে ঘুমানোর সুযোগ। বেশির ভাগ সময় আমি এই সুযোগ পেতাম। ওনার সঙ্গে ঘুমানো মানেই সারা রাত রূপকথার গল্প শোনার সুযোগ!
বড় মার রুমের এক কোণে টিমটিমে আলোয় হারিকেন জ্বালানো থাকত। সে সময় মফস্সলে অনেক বিদ্যুৎবিভ্রাট হতো। যখন–তখন চলে যেত বিদ্যুৎ। বারবার অন্ধকারে দিয়াশলাই হাতড়ে হারিকেন জ্বালানোর ঝামেলা এড়াতেই এটা করতে হতো। হারিকেনের টিমটিম আলো আর কেরোসিন মেশানো সলতে পোড়ার অদ্ভুত এক গন্ধ ঘরটিকে সম্মোহনীয় করে তুলত। সেই পরিবেশে আমরা বুঁদ হয়ে শুনতাম রূপকথার গল্প।
বড় মা গল্প বলার সঙ্গে সঙ্গে এক হাতে আমাদের মাথায় বিলি কেটে দিতেন, আর অন্য হাতে ক্যাঁচক্যাঁচ আওয়াজ করে ঘোরাতে থাকতেন কাপড়ের ফুলতোলা হাতপাখা। আমরা গল্প শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে আবার জেগে উঠে দেখতাম তিনি তখনো এক হাতে আমাদের মাথায় বিলি কেটে যাচ্ছেন আর অন্য হাতে ঘোরাচ্ছেন পাখা। অবাক হয়ে ভাবতাম, আচ্ছা, এই মানুষটার হাত ব্যথা করে না? একসঙ্গে কীভাবে দুহাতে কাজ করে যান! আবার ভাবতাম, বড়দের মনে হয় হাতব্যথা করে না! কিন্তু এখন বুঝতে পারি, মানুষটার ঠিকই হাতব্যথা করত। আমাদের যাতে গরমে কষ্ট না হয়, সে জন্যই তিনি ব্যথা ভুলে পাখা ঘোরাতেন।
শুধু ছোটরাই না, বড়দেরও আড্ডার কেন্দ্রবিন্দু ছিল বড় মার ঘর। সন্ধ্যার পর সবাই একত্র হয়ে মনোমুগ্ধকর আড্ডার আসর সাজিয়ে বসতেন। শীতের সময় এই আড্ডা ভিন্নমাত্রা পেত। বড় মা ভীষণ শীত কাবু ছিলেন, সেই সঙ্গে আগুন তাপানোর তীব্র নেশাও ছিল ওনার। মাটির চুলায় রাতের রান্না শেষে গনগনে কাঠের কয়লাগুলো তিনি একটি মাটির গামলায় তুলে ঘরে নিয়ে যেতেন; ঘুমানোর আগপর্যন্ত সেই কয়লার আগুন তাপাতেন। এটিকে তিনি বলতেন ‘মালসা’। তখন আমরা বড় মার সঙ্গে সেই মালসার চারপাশে গা–ঘেঁষাঘেঁষি করে বসে গল্পে মেতে উঠতাম। গল্প করতে করতে যখন আগুনের আঁচ কমে আসত, একটা লম্বা কাঠি দিয়ে কাঠের কয়লাগুলোকে আবার উসকে দিতাম। অনেক রাত অবধি চলত এই গল্প আর আড্ডার খেলা।
বড় মার রান্নার হাতে আধ্যাত্মিক এক ক্ষমতা ছিল। খুব ভালো রান্না করতেন। বাড়িসুদ্ধ মানুষ ওনার রান্না করা খাবারের জন্য পাগলপ্রায়। তিনি শাক, লতাপাতা যা-ই রান্না করতেন, আমরা মাছ-মাংস রেখে সেই খাবারের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তাম। তিনি যে খুব গুছিয়ে বনেদি আঙ্গিকে রান্না করতেন, তা কিন্তু নয়; খুব সাদামাটাভাবেই রান্না করতেন।
মানুষটি শীত ভয় পেতেন, মৃত্যুও ভয় পেতেন। এত ভয়ের পরেও পৌষের এক কনকনে শীতের বিকেলে বড় মা আমাদের এবং এই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে যান। সেই সঙ্গে ভাঙল আমাদের আড্ডাখানা, শেষ হলো এক অধ্যায়ের।