চৈতি ফুলের গল্প (২য় পর্ব)

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
এক জীবনে কয়টা ভালো কবিতা লেখা যায়!’ এই এক কথা ঘুরিয়ে–ফিরিয়ে বলেছে সবাইকে। কিন্তু ‘চৈতি ফুলের গল্প’-এর নাম তো সুনন্দা ছাড়া কেউ জানে না। আর এ ঠিকানাটাই–বা কিসের?

সমরজিৎ বাবু নির্নিমেষ চোখে লোকটার দিকে চেয়ে আছে। ৫ ফুট ৬ ইঞ্চি লম্বা ও শ্যামলা মানুষটাকে সুশ্রী দেখাচ্ছে। মুহূর্তের মধ্যে গায়ের রঙের বদল হওয়া কি সম্ভব? ভাবতে ভাবতে সমরজিৎ বাবুর চোখ পড়ল জানালার দিকে। পর্দার ফাঁক গলে সূর্যের কিরণ লোকটার গায়ে এসে পড়ছে। নিজেকে সামলে প্রশ্ন করল সমরজিৎ বাবু, ‘কে আপনি? আমার কাছে কী চান?’ লোকটা সোফা থেকে উঠে এসে পায়ের কাছে বসল। বাবার বয়সী লোক পায়ে হাত দিয়েছে, এ যে ঘোর পাপ। সমরজিৎ বাবু লোকটার দুই হাত ধরে তুলে সোফায় বসিয়ে নিজে তার পায়ের কাছে বসল।

‘এমন কেন করছেন? কী চান আমার কাছে? দয়া করে বলবেন।’ উত্তরে কিছু না বলে টি-টেবিলের ওপর থাকা চাবি নিয়ে সদর দরজা খুলে লোকটা চলে গেল। সমরজিৎ বাবু সদর দরজার দিকে তাকিয়ে আছে। কে এই লোক, কী চাই; জীবনে বহু ঘটনা, বহু অভাবনীয় অভিজ্ঞতা হয়েছে। কিন্তু আজকের এ ঘটনা সবকিছুকেই হার মানায়। সুনন্দা কি বিশ্বাস করবে? ইত্যাদি প্রশ্ন খেলা করছে মাথায়। কিছু সময় পর লোকটা আবার এল। পাঞ্জাবি ঘামে ভিজে জবজবে। মাথার চুল ভেজা। কপাল চুইয়ে চোখের জলের মতো মুখের ওপর পড়ছে। সমরজিৎ বাবু দৃঢ়কণ্ঠে বলল, ‘আপনি পেয়েছেনটা কী? আমাকে কি জোকার মনে হচ্ছে?’ তবু লোকটা নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে আছে। সমরজিৎ বাবু কাছে গিয়ে হাত ধরল। বরফের মতো ঠান্ডা হাত। মানুষের শরীর এত ঠান্ডা হওয়া কি সম্ভব? না, এর আগে হাত ধরে যখন উঠিয়েছিলাম তখন তো এতটা ঠান্ডা অনুভব হয়নি। হাত ছেড়ে দিয়ে দূরে গিয়ে দাঁড়াল সমরজিৎ বাবু। কোনো কথা না বলে টি-টেবিলের ওপর ছোট্ট একটা কাগজ রেখে লোকটা চলে গেল।

‘চৈতি ফুলের গল্প। সমরজিৎ ভট্টাচার্য্য
১৯ আনন্দ নিকেতন, সেন্ট্রাল রোড, যশোর।’

আরও পড়ুন

প্রায় অক্ষরগুলো আঁকাবাঁকা, বোঝা যাচ্ছে কাঁপা কাঁপা হাতে লেখা। ‘চৈতি ফুলের গল্প’ সমরজিৎ বাবুর প্রথম কাব্যগ্রন্থের নাম। বইটা এখনো বের হয়নি। কেবল পাণ্ডুলিপি রেডি হয়েছে। ১৭ বছরের লেখালেখি জীবনে একাধিক গল্প-উপন্যাসের বই বের করলেও কবিতার বই কেন করেননি? পাঠক, শুভানুধ্যায়ী অনেকেই এ প্রশ্ন করেছে তাঁকে। ‘উত্তরে কবিতা লেখা কঠিন, দুরূহ কাজ। এক জীবনে কয়টা ভালো কবিতা লেখা যায়!’ এই এক কথা ঘুরিয়ে–ফিরিয়ে বলেছে সবাইকে। কিন্তু ‘চৈতি ফুলের গল্প’-এর নাম তো সুনন্দা ছাড়া কেউ জানে না। আর এ ঠিকানাটাই–বা কিসের? ভাবতে ভাবতে কাগজের টুকরো হাতে নিয়েই ছাদে গেল সমরজিৎ বাবু।

বাড়ির সামনের দিকটা ফাঁকা। পেছনের দিকে পাশাপাশি দুটো বাড়ি। ছাদের ওপর বড় বড় টবে ফুল গাছ লাগিয়েছে সুনন্দা। কাঠগোলাপ সমরজিৎ বাবুর পছন্দের ফুল। একটা ফুল ছিঁড়ে ডান কানের ফাঁকে গুঁজে বাড়ির পেছনের দিকে ছাদের প্রাচীরে হেলান দিয়ে দাঁড়াল। ‘পাণ্ডুলিপি হারায়নি, গত রাতেও একটা কবিতা কেটে ঠিক করেছি। আর লোকটা যে কবিতাটা বলছিল ওটাও তো “চৈতি ফুলের গল্প” পাণ্ডুলিপিভুক্ত। এসব সে জানল কী করে? কাগজে লেখা ঠিকানায় গেলে কি উত্তর মিলবে!’ মনে মনে আওড়ে ঘাড় ঘোরাতেই পাশের বাড়ির দোতলার জানালা দিয়ে দৃষ্টি গেল ঘরের ভেতরে। প্রাপ্তবয়স্ক তরুণ-তরুণী আদর খেলায় মত্ত। সমরজিৎ বাবু চোখ ফিরিয়ে নিল। সূর্য মধ্যগগনে, কয়েক মুহূর্ত সূর্যের দিকে তাকিয়ে থাকার বৃথা চেষ্টা করে নিচে নেমে এল সে।

গুগল করলে ভুল হোক ঠিক হোক কমবেশি তথ্য পাওয়া যায়। সমরজিৎ বাবু ‘১৯ আনন্দ নিকেতন, সেন্ট্রাল রোড, যশোর।’ লিখে সার্চ করল। অর্থবহ কিছু না পেয়ে ফেসবুক খুলতেই মেসেঞ্জারের মেসেজের আওয়াজ হলো। সুনন্দার মেসেজ। ‘সরি...সরি...এক হাজারবার সরি। আর এমন কখনো হবে না। তোমার পছন্দের পাস্যে মাছ ফ্রিজে রান্না করা আছে। গরম করে সময়মতো খেয়ে নিয়ো। আমি আজ কিছুটা আগে ফেরার চেষ্টা করব।’ সমরজিৎ বাবু উত্তরে একটা লাভ সাইন দিল। সুনন্দার নামের পাশে সবুজ চিহ্ন নেই। অ্যাকটিভ তেত্রিশ মিনিটস এগো লেখা। সমরজিৎ বাবু সেলফোনটা টেবিলের ওপর রেখে ড্রয়ার থেকে ‘চৈতি ফুলের গল্প’ পাণ্ডুলিপিটা নিয়ে বালিশ হাতের তলে রেখে ডান হাতের ভরে মাথা রেখে পৃষ্ঠা উল্টাতে শুরু করল। একটা কবিতায় কয়েকটা শব্দ সংশোধন করে পাণ্ডুলিপি মাথার শিয়রে রেখে বালিশে মাথা দিতে চোখের ওপর সুনন্দার মুখ ভেসে উঠল। বাচ্চা নাও না কেন, বাচ্চা নাও—প্রতিদিন ফোন দিয়ে এই এক কথা বলতে হবে? আর কোনো কথা নেই! ভেবে বোনের ওপর কিছুটা রাগ হলো তার। ফুল স্পিডে ফ্যান চলছে। দুর্বিষহ গরম। ফ্যানের বাতাস গায়ে লাগছে না। সমরজিৎ বাবু এসি চালিয়ে ফ্যানটা বন্ধ করে সব রাগ-অভিমান, দুশ্চিন্তা, চিন্তাভাবনা পেছনে ফেলে দুই চোখ বন্ধ করে ঘুমাতে চেষ্টা করল।

চলবে…
কেশবপুর, যশোর