বিদ্রোহীর জীবনে বিরহ

কাজী নজরুল ইসলামপ্রতিকৃতি: মাসুক হেলাল


‘তোমারে পড়িছে মনে’ পঙ্‌ক্তি শুনতেই এক আনন্দ হিল্লোল ওঠে হৃদয়ে। মনে পড়ে ফেলে আসা কারও ছবি, কত স্মৃতি। জীবন কত-না মধুর। নদীপ্রবাহের মতো মুহূর্তে মুহূর্তে বদলে যায়। কেউ এসেই হারায় আবার কেউ থেকে যায় আজীবন। মানুষে মানুষে হৃদ্যতা, বন্ধন ভালোবাসার ভারে আটকে থাকে। প্রেম-বিরহ জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ভালোবেসে কেউ কেবল হারায়, আবার কেউ ফুলে-ফলে সুশোভিত বৃক্ষ হয়ে ওঠে।

শিল্প-সাহিত্য জীবনের কথা বলে। শব্দের পর শব্দ কিংবা রঙের বর্ণচ্ছটায় জীবনের প্রতিচ্ছবি তুলে ধরে। শিল্প-সাহিত্যের একটি বড় অংশজুড়ে আছে প্রেম-বিরহ। মানুষ প্রেমে পড়ে, ভালোবাসে, দুঃখ পায়। প্রতিটি অধ্যায়ই নিরুপম সুন্দর। প্রতিটি মুহূর্ত হৃদয়কে আনন্দ-বেদনার অম্লমধুর যন্ত্রণায় মোথিত করে। কবি, লেখক, শিল্পীরাও প্রেমে পড়েন, ভালোবাসেন, বিরহ যাপন করেন। তাঁরা সৃষ্টিশীল কাজের মধ্য দিয়ে সময়কে বেঁধে রাখেন। প্রেম-বিরহের কথকতায় শিল্প-সাহিত্য সমৃদ্ধ হয়।

শুরুতে উল্লিখিত পঙ্‌ক্তিটি একটি কবিতার। কবিতাটি প্রেমের, কবিতার শিরোনামও এক। কবি কাজী নজরুল ইসলাম। বিদ্রোহী কবি হিসেবে পরিচিত কবির প্রেম-বিরহবিষয়ক লেখালেখির সংখ্যা নেহাতই কম নয়। ‘আমার আপনার চেয়ে আপন যে জন’ গানটির মতো বহু হৃদয়জয়ী গান লিখেছেন নজরুল।

স্বাধীনতা, অধিকার ইত্যাদি নিয়ে কণ্ঠ জাগানো নজরুল ‘বিদ্রোহী কবি’ পরিচয়েই সূর্যের মতো দীপ্তিমান। যে দীপ্তির আড়ালেই ঢাকা পড়ে আছে বিরহের কথকতা। অবাক হচ্ছেন? ‘… আমার অন্তর্যামী জানেন তোমার জন্য আমার হৃদয়ে কত ক্ষত, কী অসীম বেদনা। সেই বেদনার আগুনে আমি পুড়ছি। তা দিয়ে কোনো দিন তোমায় দগ্ধ করতে চাইনি। তুমি এই আগুনের পরশমণি না দিলে আমি ‘অগ্নিবীণা’ বাজাতে পারতাম না। তোমায় কিশোর বয়সে প্রথম দেখেছিলাম, যে রূপকে আমার জীবনে প্রথম ভালোবাসার অঞ্জলি দিয়েছিলাম, সে রূপ আজও স্বর্গের পারিজাত-মন্দারের মতো চির-অম্লান হয়েই আছে আমার বুকে…’ কুমিল্লা জেলার দৌলতপুরের সৈয়দা খাতুনকে কথাগুলো চিঠিতে লিখেছিলেন কবি।

‘হ্যাঁ’ দৌলতপুরের সৈয়দা খাতুনই নার্গিস। তাঁর সঙ্গে কবির দেখা হয়েছিল এক বিয়ের অনুষ্ঠানে। ১৯২১ সালের ঘটনা। বন্ধু আলী আকবর খানের নিমন্ত্রণে নজরুল কুমিল্লার দৌলতপুর গেলেন। সেখানেই এক বিয়ের অনুষ্ঠানে প্রথম দেখা হলো সৈয়দা খাতুনের সঙ্গে। বিয়ের অনুষ্ঠান, গান-বাজনা হইচই আনন্দ। কবি হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান গাইলেন। একে অপরের প্রতি মুগ্ধ হলেন দুজনে। কবির আহ্বানে সৈয়দাও এগিয়ে এলেন। ভালোবাসার মানুষকে নিজের দেওয়া নামে ডাকার আনন্দ অতুলনীয়। সৈয়দা খাতুনকেও নিজের দেওয়া নামে ডাকলেন কবি। ইরানি ফুলের নামে ‘নার্গিস’ নাম হলো সৈয়দা খাতুনের।

ভালোবাসা পূর্ণতা পায়, পায় না। নজরুল লিখেছেন, ‘দুনিয়ায় যত রকম আনন্দ আছে, তার মধ্যে এই বিচ্ছেদের ব্যথাটাই সব থেকে আনন্দের।’ ভালোবাসার সঙ্গে বিচ্ছেদের যন্ত্রণাও উপভোগ্য। এ কারণেই কি সব ভালোবাসা পূর্ণতা পায় না? পূর্ণতা মানে একে অপরের সঙ্গে জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত থাকতে পারা। হয়তো ‘হ্যাঁ’ অথবা ‘না’। ‘লায়লী-মজনু’, রজকিনী-চন্ডীদাসের মতো অনেক উদাহরণ আছে। কিন্তু বিদ্রোহীর জীবনের ঘটনাটা আলাদা। নজরুলের সঙ্গে নার্গিসের বিবাহ হয়েছিল। কিন্তু কোনো এক অভিমানে বিবাহের দিনই কবি দৌলতপুর ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। কিন্তু আশা নিয়ে বসে রইলেন নার্গিস। যদি ফিরে আসে ভালোবাসা, ভালোবাসার মানুষ। তিনি দীর্ঘ ১৭ বছর অপেক্ষা করেছেন। শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা পূর্ণতা পায়নি। কবি আর ফিরে যাননি। তবে বিরহের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি মেলেনি তাঁর। নার্গিসের বিরহে কবিও পুড়েছেন। নার্গিসকে নিয়ে লেখা কবির কথামালা পড়লে এমনই অনুভূতি হয়।
বিরহ এক মধুর যন্ত্রণা। সয়ে নিতে নিতে আনন্দের হয়ে যায়। কিন্তু উপেক্ষা, প্রত্যাখ্যান বিষ যন্ত্রণার মতো পীড়া দেয়। আশ্চর্য মনে হলেও সত্যি যে আমাদের প্রিয় কবিকেও উপেক্ষা তথা প্রত্যাখ্যানের যন্ত্রণা সইতে হয়েছে। তা-ও কি না সেই সময়ে যখন চারদিকে তাঁর জয়জয়কার। প্রত্যাখ্যানের মতো দৃঢ়তম বেদনা কবি পেয়েছিলেন ফজিলাতুন্নেসার থেকে।

১৯২৮ সাল। মুসলিম সাহিত্য সমাজের দ্বিতীয় বার্ষিক সম্মেলনে অতিথির আসন অলংকিত করলেন নজরুল। কাজী মোতাহার হোসেন অনুষ্ঠানটির আয়োজকদের মধ্যে অন্যতম। তাঁর বর্ধমান হাউসের বাড়িতে আপ্যায়িত হলেন কবি। এখানেই ফজিলাতুন্নেসার সঙ্গে পরিচয়। ফজিলাতুন্নেসা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিষয়ের শিক্ষার্থী। শুধু শিক্ষার্থী না বলে বরং মেধাবী শিক্ষার্থী বলাই শ্রেয়। ফজিলাতুন্নেসা গণিত বিষয়ে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়েছিলেন। বিভিন্ন চিঠিপত্র ও কাজী মোতাহার হোসেনের স্মৃতিচারণা অনুযায়ী, কবি ফজিলাতুন্নেসাকে প্রেম নিবেদন করেছিলেন। কিন্তু গণিতশাস্ত্রের মেধাবী শিক্ষার্থী ফজিলাতুন্নেসা আগ্রহ দেখানো তো দূরে থাক, উপেক্ষা-ব্যঙ্গ-অবহেলা ও প্রত্যাখ্যানে কবিকে আহত করেন। মোতাহার হোসেনকে এক চিঠিতে কবি লিখেছেন, ‘… কয় মুহূর্তের দেখা, তারি মাঝে তাঁর কত বিরক্তিভাজন হয়েছি, হয়ত বা কত অপরাধও করে ফেলেছি। পাওয়ার বেভুল আনন্দে কী করেছি না করেছি, কী লিখেছি না লিখেছি তা আমার মনে নেই কোনো দিন মনে পড়বেও না। …তাঁর আঘাত বেদনা অশ্রু আমার শাশ্বতলোকের শূন্য ভান্ডার পূর্ণ করে দিয়েছে।’

জীবনপথের বেদনাবিধুর বিরহ কবিকে কেবল ক্ষতবিক্ষত করেই থামেনি। তাঁর সাহিত্যসাধনাতেও সমানভাবে প্রভাব ফেলেছে। বিরহের অতলস্পর্শী স্পর্শে প্রতিনিয়ত আন্দোলিত হয়েছেন কবি। সৃষ্টিসুখের উল্লাসে লিখেছেন কালজয়ী সব কবিতা, গান ও কথামালা। ফলত সমৃদ্ধ হয়েছে বাংলা সাহিত্য। বিদ্রোহের পাশাপাশি নজরুল কাব্যে স্থান পেয়েছে প্রেম। যার প্রস্থে প্রস্থে বাঁশি বাজিয়েছে বিরহ।

সাংগঠনিক সম্পাদক, যশোর বন্ধুসভা