সংগীত দিয়ে মন ভরে, কিন্তু পেট তো ভরে না। তখন সবে বিয়ে করেছি। কিছুদিন পর বাবা মারা গেলেন। শেষ পর্যন্ত পেটের দায়ে কাজে নামতে হয়েছে।
সাড়ে পাঁচ ফুট মানুষের ছায়া তখন এক ফুট। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মেইন গেট থেকে সাহেব বাজার যাব। সাধারণত অটোরিকশার সামনের সিটে বসি। আজও ব্যতিক্রম হলো না। চালকের পাশে বসে তাঁর সঙ্গে টুকটাক কথাবার্তা বলতে ভালো লাগে। কোনো এক কারণবশত আজ চুপচাপ বসে আছি। কোনো কথা বলছি না।
ভদ্রলোকের বয়স ৪৫ থেকে ৫০ বছরের মধ্যে হবে। গায়ে আকাশি রঙের হাফহাতা শার্ট, গায়ের রং শ্যামলা। কাজলা পর্যন্ত আসার পর চালকের ফোনে একটা কল এল। কল রিসিভ করে কথা বলছেন। কথা শুনে মনে হচ্ছে, জমিসংক্রান্ত কোনো ঝামেলা চলছে। ফোন রাখতেই জিজ্ঞাসা করলাম, ‘মামা, গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করেছেন কোথা থেকে?’ তিনি অবাক হয়ে আমার দিকে একপলক তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনি কি আমার পরিচিত কেউ? আমি পড়াশোনা করেছি, আপনাকে কে বলেছে?’
—কেউ বলেনি। যখন ফোনে কথা বলছিলেন, আপনার শব্দচয়ন, উচ্চারণ ও কথা বলার ধরন শুনে মনে হয়েছে।
—ওহ্ আচ্ছা, আপনার অনুমান সত্য। পড়াশোনা করেছি অনেক টানাপোড়েনের মধ্যে। বাবা পড়াশোনার খরচ দিতে পারতেন না। তারপরও কষ্ট করে রাজশাহী কলেজ থেকে অনার্স শেষ করেছি। কষ্ট করলে নাকি কেষ্ট মেলে। আমার ক্ষেত্রে সেটাও মিথ্যা হয়েছে। চাকরির জন্যও চেষ্টা করেছি। কোথাও হলো না। অবশেষে হাল ছেড়ে পেশার বিবর্তনে আজ অটোরিকশায়।
—আচ্ছা, সংগীতচর্চাও করতেন বোধ হয়?
আবারও অবাক হয়ে একটু জিজ্ঞাসু দৃষ্টি দিতেই আমি বললাম,
—আসার পথে সৈয়দ আবদুল হাদীর ‘কেউ কোনো দিন আমারে তো কথা দিল না’ গানের সুর গুনগুনিয়ে গাচ্ছিলেন। তাই জিজ্ঞাসা করা।
—গানের প্রতি প্যাশন ছিল। একটা সময় সংগীতচর্চা করতাম। রাজশাহী বেতারেও গান করেছি। সংগীত দিয়ে মন ভরে, কিন্তু পেট তো ভরে না। তখন সবে বিয়ে করেছি। কিছুদিন পর বাবা মারা গেলেন। শেষ পর্যন্ত পেটের দায়ে কাজে নামতে হয়েছে। সমাজে টাকাওয়ালা মূর্খ মানুষের সামনে টাকা ছাড়া শিক্ষিত মানুষকে কেউ দাম দেয় না।
পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে অর্থের সমস্যা। মামার বাসায় কে কে আছেন?
—বাড়িতে সবাই আছে। আপনার মামি আর ছেলেমেয়ে। কিন্তু আমার কেউ নেই। কারণ, আমি সংসার চালাতে পারলেও স্ত্রী-সন্তানদের শখ-আহ্লাদ পূরণ করতে পারি না। এখন আমার বাড়ি বলতে গেলে এই অটোরিকশা, শহরের রাস্তা আর আমার যাত্রীরা। সুখ-শান্তিও এখানেই। ছেলেটাকে অ্যাডমিশন কোচিং করালাম, চান্স হলো না কোথাও। পরে বললাম সরকারি কোনো কলেজে পড়াশোনা করতে। তারা মা-ছেলে কেউ রাজি হলো না। আপনার মামি ছেলেকে ভর্তি করাল প্রাইভেট ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটিতে। এত টাকা আমি কোথা থেকে দেব! তার ভাইদের সাপোর্ট নিয়ে ছেলের পড়ার খরচ চালাচ্ছে।
এতটুকু বলতে বলতে তালাইমারি পর্যন্ত এসে ব্রেক করলেন। আরেকজন যাত্রী উঠল। আমি চুপচাপ বসে আছি। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আবার বলা শুরু করলেন।
—এগুলা কষ্টের কথা, কাউকে বলা যায় না। আপনি শুনলে আপনারও মন খারাপ হয়ে যাবে।
—মামা, আপনার ব্যক্তিগত সীমাবদ্ধতা না থাকলে বলতে পারেন, শুনি...
—শোনেন, গত শুক্রবার নামাজ পড়ে মসজিদ থেকে বাড়িতে ফিরেছি। এসে দেখি আপনার মামি টিভি দেখছে আর ছেলেটা পাশে বসে ফোন চাপছে। বেশ ক্ষুধা লেগেছিল। একবারের জায়গায় দুবার খাবার দিতে বললাম দেখে আপনার মামি চেঁচিয়ে বলে, ‘তোমার একটু নিস্তার নাই, আমাকে আর শান্তি দিলে না।’ পাশ থেকে ছেলেটাও বলছে, ‘আম্মু, তুমিও না! এই লোকটার সঙ্গে কেন যে কথা বলো! দেখছই তো এমন।’ ছেলের মুখে এমন কথা শুনে আমার কেমন কষ্ট লেগেছে, এটা আপনি বাবা হয়ে ছেলের মুখে না শুনলে বুঝতে পারবেন না। আজকে যদি আমার অগাধ টাকাপয়সা থাকত, তাহলে সংসারে কেউ এমন ফালায়া-চড়ায়া কথা বলতে পারত না। জীবনে অর্থসংকট হচ্ছে সমস্যার গাছ, অন্য যত সমস্যা, সেগুলো ওই গাছেরই ডালপালা। এত এত কষ্টের মধ্যে নিজেকে খুব একলা লাগে। কার জন্য বেঁচে আছি, কিসের আশায়, মনকে জিজ্ঞাসা করলে প্রত্যুত্তরে কিছু আসে না।
শুনতে শুনতে কখন যে জিরো পয়েন্ট চলে এসেছি, খেয়ালই ছিল না। মামা বললেন, ‘এখানেই নামবেন, নাকি আরেকটু সামনে?’ আমি বললাম, ‘এখানেই রেখে যান।’
মানিব্যাগ থেকে ১০০ টাকার একটা নোট বের করে দিলাম। টাকা রাখতে রাখতে বললেন, ‘মামা, জীবনে ভালো কিছু করিয়েন, যাতে টাকার কষ্টে ভোগা না লাগে। আরেকটা কথা, মা-বাবাকে কখনো কষ্ট দিয়েন না।’ আমি বললাম, ‘অবশ্যই, দোয়া করবেন।’
কথাগুলো শুনে গভীর বিষণ্ণতা পেয়ে বসে আমাকে। চোখের সামনে অনেক ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার ভেতর সেই অটোরিকশা হারিয়ে গেল ব্যর্থ জীবনের গল্পের মতো। তখন মধ্যদুপুর, ফোনের নোটপ্যাড বের করে লিখে ফেললাম—
‘হেমন্তের পাতাঝরা মধ্যদুপুরে—
নিজের ছায়াকেও খুঁজে পাই না পাশে
তখন নিজের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে,
নিজেকে প্রশ্ন করি, আমি কী—
দেহহীন আত্মা, নাকি আত্মাহীন দেহ?’
শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়