মেসের পেছনের পতিত জমিতে একটু পানি জমে ভোরবেলার বৃষ্টিতে। সারা দিন এলোমেলো ছন্নছাড়া মেঘে ঢাকা আকাশ। সূর্যের দেখা মেলে না। দুটো কোলা ব্যাঙ সেই জমিতে থেকে থেকে ডাকে। সে কী কানফাটা ফরিয়াদ! আরও বৃষ্টি চাই তাদের।
সত্যি সত্যিই বৃষ্টি দরকার তাদের। ১০-১৫ বছর আগেও দেখা যেত, বৈশাখ মাস শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ঝড়বৃষ্টি নামত। প্রচুর বৃষ্টি হতো। প্রচুর পানি জমত খানাখন্দ আর পতিত জমিতে। দীর্ঘদিনের শীতনিদ্রা ছেড়ে জেগে উঠত ব্যাঙেরা। জেগে উঠত তাদের দমিত যৌবন। দেখা দিত যথাসময়ে প্রজনন। এখন জলবায়ু বদলে গেছে। আগের মতো দিন আর নেই। গত কয়েক বছরে বিশেষ করে এই বছরে বৈশাখ যায়; জ্যেষ্ঠ যায় যায়। বৃষ্টি তবু আসে না। ঘুম না হয় একটু বেশিই পাড়া যায়, কিন্তু যৌবনজ্বালা কি ঠেকিয়ে রাখা যায়? আর প্রজননেরই–বা কী হবে?
হ্যাঁ, ভাইয়ের জন্য বিশেষ কবুতর বটে। এটা পাশের বাড়ির মাসুদার কবুতর। শফিকুর মেস থেকে শুধু দেখেই যায় মাসুদাকে। দুপুরে, বিকেলে, গোধূলিতে দেখে। তাদের বাসার ছাদে। সেখানে সে কবুতরকে খাবার দেয়; ওড়াউড়ি দেখে। কখনো ফুলের টবে পানি দেয়। সময়ের পরিক্রমায় গাছে ফুল ফুটলেও কারোরই মুখ ফোটেনি কোনো দিন।
গত মাস দেড়েক কাঠফাটা রোদের পর আজ ভোরবেলায় যখন হঠাৎ বৃষ্টি হচ্ছিল, তখন একটা কাণ্ড ঘটে গেল মেসে। টিনের চালে হঠাৎ বৃষ্টির প্রচণ্ড শব্দে ঘুম ভাঙে শফিকুরের। দরজা খুলেই একটা কবুতর চোখে পড়ে। মাথায় কালো কালো ছোপবিশিষ্ট কবুতরটা ভেজা। মানুষ দেখে ভয় পেলেও উড়তে পারে না। জড়সড় হয়ে দেয়াল ভেঙে লুকাতে চাচ্ছে। কিন্তু পারছে না। আশ্চর্য শফিকুর পাশের রুমের সদস্যদের ডাকতে ডাকতে খপ করে ধরে ফেলে কবুতরটা।
শফিকুর রহমান মেসের সবচেয়ে সিনিয়র সদস্য। তার মুখের ওপর কথা বলা বেয়াদবি। দু-একজন অস্বস্তি বোধ করে। একজন তবু হাসতে হাসতে বলেই ফেলে, ‘ছেড়ে দেন ভাই, যার বাড়ির কবুতর তার বাড়িতে চলে যাক।’
শফিক মুচকি হাসে। আরেকজন বলে ওঠে, ‘তুই বেশি বুঝিস? চুপ থাক ব্যাটা! এটা স্পেশাল কবুতর। ...ভাই জানে...।’
হ্যাঁ, ভাইয়ের জন্য বিশেষ কবুতর বটে। এটা পাশের বাড়ির মাসুদার কবুতর। শফিকুর মেস থেকে শুধু দেখেই যায় মাসুদাকে। দুপুরে, বিকেলে, গোধূলিতে দেখে। তাদের বাসার ছাদে। সেখানে সে কবুতরকে খাবার দেয়; ওড়াউড়ি দেখে। কখনো ফুলের টবে পানি দেয়। সময়ের পরিক্রমায় গাছে ফুল ফুটলেও কারোরই মুখ ফোটেনি কোনো দিন। মাসুদার ভাই এলাকার উঠতি নেতা হওয়ায় তাকে মনের কথা বলার সাহস কোনো দিন করেনি শফিক। ওই দূর থেকেই যতটুকু ‘টোন্ট’ এবং আফসোস করা। তাই আজ যেহেতু মাসুদার একটা কবুতরকে অন্তত পেয়েছে, সেটাকে কালাভুনা করে খেয়ে মনের ঝাল তো কিছুটা মেটানোই যায়!
বেচারা কবুতরটার আর ফিরে যাওয়া হয়নি বাসায়! এ খবর পৌঁছে যায় মাসুদার কাছে। যেকোনো মারফত কিংবা স্রেফ হাওয়ায়। পরের দিন শফিকের সঙ্গে মাসুদার বিশাল ঝামেলা বাধার উপক্রম!
মেসে যে বুয়া রান্না করে সে মাসুদাদের বাসার নিচতলার ভাড়াটেরও টুকিটাকি কাজ করে দেয়। সেখানে এবং মাসুদাদের বাসার ছাদে মাঝেমধ্যেই আড্ডা বসে মহিলাদের। ইদানীং বিদ্যুতের ঘন ঘন মূর্ছা যাওয়ার ঘটনায় আড্ডা আরও বেশি জমে। হাজারো গল্পের খই ফোটে তাদের মুখে মুখে। ৪২ ডিগ্রি তাপমাত্রা। একটু বাতাসের লোভে ছাদে আসে সবাই। সেখানেও কোনো বাতাস নেই। ভ্যাপসা গরমে বাচ্চাদের থেকে থেকে কান্না। তবু কিছুতেই ছেদ পড়ে না গল্প-গুজবে!
শফিকুরের সন্দেহ, সেসব কোনো আড্ডায় এই বুয়ার মাধ্যমেই হয়তো ফাঁস হয়েছে খবরটা। বুয়ার দেখা পাওয়ার অপেক্ষায় থাকে সে। মেসের সবাই বুয়াকে ‘খালা’ সম্বোধন করলেও ‘ভাবি’ সম্বোধন করে শফিকুর। কেন করে, সে-ই শুধু জানে! আর কেউ জানে না। শফিক ভাইয়ের সঙ্গে খালার দহরম-মহরম অবস্থা। সন্দেহ করার মতো আরও কারণ থাকলেও সিনিয়র ভাই হওয়ায় সবাই জেনেও না জানার ভান করে। চেপে যায়।
বিকেলে ভাবিকে পেয়ে আচ্ছা করে বকাঝকা করে শফিকুর। ভাবি আকাশ থেকে পড়ে। আসলে সেদিন সকালে সে কবুতরটা ভুনা করলেও কোনো খবরই কারও কাছে ফাঁস করেনি। কিন্তু কে বোঝায় সেটা শফিককে? তাই ‘আল্লাহর কিরা, মুই কং নাই!’ বলে কসম কাটা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না ভাবির। তা ছাড়া বেশি তর্ক করা যাবে না শফিকুরের সঙ্গে। সময়ে-অসময়ে তার কাছ থেকে ধারদেনা নিয়ে সংসার চালাতে হয় খালাকে।
খবরটা হাওয়ার মাধ্যমেই ফাঁস হয়। বুয়ার ইন্টারমিডিয়েট পড়ুয়া ছেলে রয়েছে একটা। নাম সাগর। নানা সময়ই সে মেসে আসা-যাওয়া করে মায়ের কাছে। বিশেষ করে রাত আটটায় যখন লোডশেডিং শুরু হতো তখন নিয়ম করে আসত সে। মাকে কারেন্ট নেই অজুহাত দিয়ে ঘণ্টাখানেকের জন্য মেসে ঘুরতে এসে রাত ১০টা বাজাত দিব্যি। আর ইদানীং তো লোডশেডিংয়ের কোনো ঘড়ি-ঘণ্টা নেই। মা–ও কিছু বলে না। কারণ, মেসের অনার্সপড়ুয়া ছাত্রদের কাছে গিয়ে দুই হরফ পড়া দেখিয়ে নেওয়ার আশা পোষে সে। কিন্তু সাগর মেসে এসে কোন সাগরে মিলিয়ে যায়, অশিক্ষিত মায়ের কাছে সেটা কল্পনার অতীত বিষয়।
‘দে দে পাল তুলে দে/ ও মাঝি হ্যালা করিস না/ ছেড়ে দে নৌকা/ আমি যাব মদিনা...’ গানের সুরে প্রকম্পিত হয় মেস। এ যেন অসহনীয় দাবদাহে সিদ্ধ হওয়া অন্ধকারের টগবগ শব্দ। আসলে এটা লোডশেডিংয়ের সিগন্যাল। অন্ধকার মেসের বারান্দায় একটা পরিত্যক্ত চকিতে বসে আরও নানা ধরনের গান গায় ছেলেরা, যতক্ষণ না বিদ্যুৎ আসে।
শফিকের এসবে মনোযোগ নেই। সে তার ‘শাগরেদ’ সাগর এবং দু-চারজন বন্ধুকে নিয়ে মেতে ওঠে নেশায়! প্রথম প্রথম শুধু সিগারেট আনাত সাগরকে দিয়ে। সেই থেকে সাগরের সিগারেট টানা শুরু। পরে শফিক মামার উৎসাহে সেও প্রেমে পড়ে নেশার। মাঝেমধ্যে আসর শেষে বাইরে যায় মামার সঙ্গে। ভরপেট খেয়ে এসে কোনো দিন বাড়ি ফেরে, কোনো দিন থেকে যায় মেসেই। মা সকালে কাজ করতে এসে ছেলের পাশে বই দেখে ভাবে রাতভর পড়াশোনা করেছে ছেলে! আর ঘুম ভাঙায় না।
এত ঘন ঘন বিদ্যুৎ মূর্ছা যায় যে সাগর মা-বাবার সঙ্গে বাড়িতে থাকার চেয়ে মেসেই শফিক মামার রুমে থাকতে বেশি পছন্দ করে। মামার রুমে আইপিএস আছে। তাই মা-ও তার আদরের ছেলেকে মানা করে না। অভাবের সংসারে নিত্যপ্রয়োজনীয় বাজার খরচ করতেই নাভিশ্বাস; সেখানে আইপিএস কেনা গরিবের ঘোড়া রোগের মতো দুঃস্বপ্ন ছাড়া কিছু নয়। মাত্র দুইটা হাতে দুইটা মেস ও একটা বাসায় কাজ করে সাত-আট হাজার, আর স্বামীর রিকশা চালিয়ে ইনকাম, ধরা যাক, আরও হাজার আট-দশ! এতে করে কী আর সংসার চলে? চারজনের সংসারে ছোট মেয়েটার আবার হাইস্কুলের খরচাপাতিও জোগাতে হয়। মাঝেমধ্যে বিদ্যুতের এ রকম মূর্ছা যাওয়ায় কেরোসিনের কুপি জ্বলে তাদের ঘরে।
সাগরই কবুতরটার গুম ও নিহত হওয়ার খবর বলেছিল তার এক বন্ধুকে। মাসুদার চাচাতো ভাই সে। হয়তো তার কাছ থেকেই মাসুদার কানে পৌঁছে যায় সে খবর!
গ্রীষ্মের তীব্র দাবদাহ ছুটি নিয়েছে। কয়েক দিন ধরে রাত-দিন ভালোই বৃষ্টি হচ্ছে। রাতের আকাশের মতোই দিনের আকাশও অনেক সময় অন্ধকার দেখায়। পরিবেশটাও একদম ঠান্ডা। বিদ্যুৎও মূর্ছা যায় না হঠাৎ হঠাৎ। গানের আওয়াজেও প্রকম্পিত হয় না শফিকদের মেস। একধরনের সুনসান নীরবতা মেসে। বাইরেও একই হাল। ব্যাঙ কিংবা ঝিঁঝিদেরও কোনো চিৎকার-চেঁচামেচি নেই। মনে হয় বিশ্রাম নিচ্ছে ওরা। এমনই এক ঝিমধরা সন্ধ্যায় হঠাৎ মাসুদার ভাই ফরিদুল মেসে আসে।
‘কী রে, কাঁই আছিস?’
এক জুনিয়র সদস্য বের হয়। তাকে দেখে চটে যায় ফরিদুল।
‘তোরা ক্যান জানি গান-টান ধরিস না এলা? একেকটা তো বিশাল শিল্পী হইছিস!’
‘এমনিতেই ভাই...’
‘গেরাম থাকি আচ্চিস। মেস বানাইয়া থাকিস, থাক। কিন্তু এত ডিস্টার্ব করিস ক্যা? তোমারগুল্যার জন্নে আশপাশের বাড়ির মানুষ কান থুব্যার পায় না! এত জ্বালাইস ন্যা। রাইত নাই, দিন নাই, কী যে প্যারা দ্যান তোমরাগুল্যা!’
হঠাৎ মাসুদার ভাইয়ের এত উত্তেজনাপূর্ণ কথাবার্তা শুনে রুম থেকে বের হয় শফিকুর। তাকে দেখে আরও উত্তেজিত হয় ফরিদুল।
‘কী হইছে, ফরিদ ভাই? আইসেন, বসেন...’
‘কী হইছে মানে? তোকে তো খুঁজব্যাচ্ছি! বেশি বাড়ি গেইস বলে?’
‘ভাই...’
‘চুপ! বেশি বাড়িস ন্যা, কয়াদিলাম!’
ফরিদুলের হঠাৎ এত রাগের কারণ বুঝতে বাকি থাকে না শফিকের। সে আমতা-আমতা করে। কিন্তু লাভ হয় না তাতে। আরও রেগে যায় ফরিদুল।
‘তোর ব্যাটা, এত বুকের পাটা হলো কোনো দিন? তুই মোর বইনের কবুতর ধরি খাইস!’
‘ভাই, শোনো আমার কথা...’
‘চুপ! আর একটা আও করবি ন্যা। দুই-চারকোনা পাতি নেতার সঙ্গে মিশি এত বুকের পাটা হইছে, না? এলাকায় থাকতে চাইস, ভালো হয়া থাকবি। নাইলে, সব ফাঁস করি দেইম কিন্তু!...’
গালির পর গালি ছোড়ে ফরিদুল। হঠাৎ শফিক হাত ধরে ফেলে তার। শান্ত করার চেষ্টা করে। মেসের জুনিয়ররাও জমেছে। তাদের সামনে আর অপমান হওয়াটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। কিন্তু লাভ হয় না তাতে। ফরিদুল প্রচণ্ড শাসিয়ে যায়। ভাগ্যিস, মাসুদাকে টোন্ট করার খবরটা এখনো অজানা তার।
জুনিয়রদের মধ্যে কানাঘুষা চলতে থাকে ‘তাদের ভাইয়ের’ সব গোপন বিষয় নিয়ে; যা তারা জানে না। ভাইয়ের অনেক কিছুই জানে না তারা। শুধু বাইরের সহজ-সরল শফিকুর রহমান ভাইকে চেনে। শুধু জানে ভাইয়ের পড়াশোনা বছর তিন-চারেক আগে শেষ। বর্তমানে একজন টিউশন ব্যবসায়ী ও চাকরিপ্রত্যাশী। দানশীল, সবার বিপদে-আপদে ঝাঁপিয়ে পড়েন। এতটুকুই। কিন্তু ভাই যে বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষায় প্রশ্ন সমাধান করে দেন, ছেলেপুলেদের কাছে নকল সরবরাহ করেন, সুযোগ বুঝে প্রক্সি মারেন, এসবের কিছুই জানে না তারা।
খালার ছেলে সাগর কিছু কিছু জানলেও ছোট হিসেবে পাত্তা দেয় না তাকে ভাই। কবুতর মেরে দেওয়ার খবর ফাঁসের ব্যাপারটাতেও ওকে পাত্তা দেয়নি শফিক।
বর্ষার কারণে আবহাওয়া ঠান্ডা। বিদ্যুৎ–সংযোগও নিরবচ্ছিন্ন। তবু রাতের নির্বাক আঁধার নেমে নেমে বরফের মতো জমাট বাঁধে মেসে। মিটিং ডাকে শফিক। কবুতরের খবর ফাঁসের অভিযোগে একতরফা অভিযুক্ত খালাকে কাজ থেকে ছাঁটাই করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। আগামীকাল সকালেই জানিয়ে দেওয়া হবে তাকে। এই মাস শেষে তার আর কাজে আসতে হবে না।
তবু মেসে আসা বন্ধ হয় না সাগরের। সে যে দূষিত সাগরে মিলিয়ে যাচ্ছে দিন দিন!
উপদেষ্টা, কুড়িগ্রাম বন্ধুসভা