আর একটু সময় থাকো!

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

বসন্তের প্রচণ্ড গরম ভুলতে বারান্দায় এসে বসলাম। আমাদের বারান্দাটা ভীষণ সুন্দর। একদম উপন্যাসে বর্ণিত বারান্দাগুলোর মতো। চারদিকে রজনীগন্ধা, গাঁদা, ছোট্ট কাঠগোলাপ, নানা রঙের পর্তলিকা, বাগানবিলাস আর নয়নতারার ছড়াছড়ি। বিরল কালো গোলাপও আছে। সব কটি গাছই বাবার হাতে লাগানো। এ বাসায় মা ছাড়া সবাই বড় শৌখিন মানুষ। শৌখিনতার সবটুকুই এসেছে বাবার হাত ধরে। ভাইয়েরা আরও এক ধাপ এগিয়ে। ওদের শৌখিনতার চূড়ান্ত পর্যায়ের মানুষ বলা যেতে পারে।

গরমে ক্লান্ত হয়ে যখন ফুলেদের কাছে এসে খানিক প্রশান্তি খুঁজে নিচ্ছি, ঠিক তখন গেট পেরিয়ে বাবা বাসায় ঢুকলেন। এত গরম! অথচ বাবাকে দেখে ক্লান্ত মনে হয় না কখনো। সব সময় কেমন যেন স্থিরতায় মুড়িয়ে রাখেন নিজেকে, যা চারপাশেও প্রশান্তি ছড়াতে বাধ্য।

বাবা ধীরে ধীরে আমার পাশে এলেন। বললেন, ‘গোসল করব, তার আগে চট করে এক কাপ লাল চা বানিয়ে দাও তো বাবাকে।’ বাবার কথা শুনে নড়লাম না। তাকিয়েই থাকলাম। কেন জানি হুট করেই মন খারাপের অসুখ হতে লাগল। পৃথিবীর আকাশে রোদ আর নীলের ছড়াছড়ি, অথচ আমার আকাশে কালো মেঘের আনাগোনা। এক অযাচিত অস্থিরতায় মত্ত হতে লাগল চারপাশ।

একপর্যায়ে চাচা এলেন। বাবার হাত ছাড়িয়ে নিয়ে গেলেন। মাটিতে লুটিয়ে আমার কান্নার তীব্রতায় বাবা একটু সময়ের জন্যও দাঁড়ালেন না। কোথায় যাচ্ছেন, জানি না!

বাবা স্নিগ্ধ হাসিতে আমার মাথায় হাত ছোঁয়ালেন। মনে হলো কত হাজার বছর পর এমন স্পর্শ পেলাম। বিষণ্ণ মনে চা বানাতে গেলাম। আজ দিনটা একটু অদ্ভুত, কেমন যেন স্বপ্নের মতো। স্বপ্নটা আদৌ সত্যি নাকি মিথ্যা বোঝা যাচ্ছে না। দারুণ অস্থিরতা মনে বসতি গড়েছে। কী যেন নেই, নাকি আছে, নাকি হারাতে যাচ্ছি, ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না। মনের গহিন কোণজুড়ে ধোঁয়াশা।

চুলায় চা বসিয়ে বাইরে এসে দেখি বাবা প্রস্তুতি নিচ্ছেন চলে যাওয়ার। আমি ঠায় দাঁড়িয়ে আছি। এবারে আমার অশ্রুরা ঝরঝর করে ঝরতে শুরু করেছে। নিজেকে সামলানো বড় দায়। ইচ্ছা হচ্ছে ঝাপটে ধরে বলি, ‘আর না–ই বা গেলে, থেকে যাও, আর পারি না যে এভাবে থাকতে।’

বলতে গিয়েও বলতে পারি না। বাবা–মেয়েতে যে জড়তা আর দূরত্ব অতীতে ছিল, তা যেন আজও আছে একই রকম। অতীত আর বর্তমানে তফাত শুধু এতটুকুই—আগে লুকিয়ে কাঁদতাম, আর আজ কাঁদছি সামনে দাঁড়িয়ে, অথচ বাবা টেরও পাচ্ছেন না। ধীরে ধীরে আমার সমস্ত আকাশজুড়ে কালো মেঘ এত বেশি ছেয়ে গেল যে কোথাও কিছুই দেখতে পাওয়া যায় না, এমন ধরনের অন্ধকার। বাবা প্রায় প্রস্তুত। জানি আজকে যেতে দিলে আর কবে আসবেন, কোনো ঠিক নেই। তাই দেরি না করে সবটুকু দ্বিধা আর লজ্জা ডিঙিয়ে বাবার হাত টেনে ধরলাম। বললাম, ‘বাবা! আজ আর না–ই বা গেলে, থেকে যাও।’

তিনি সব সময়ের মতো স্নিগ্ধ হাসলেন, কিন্তু কথা বললেন না। বাবার নীরবতায় আমার কষ্ট যেন বেড়েই চলল। আর্তচিৎকারে অস্থির হয়ে গেলাম। ওনার দুহাত ধরে বসে কাঁদতে থাকলাম, এবার আর ছাড়ব না। দুবছর ধরে বাবাকে আমি চা বানিয়ে দিই না, বই পড়তে দিই না, গল্প শুনি না। দুবছর হয় স্বপ্নে বাবা আসেন, চলেও যান। এবার আর যেতে দেওয়া যাবে না। এই চলমান ঘটনা স্বপ্ন নাকি বাস্তব, জানি না। যদি স্বপ্নই হয়, তবে এই স্বপ্নের সমাপ্তি না ঘটুক, এটাই চাইছি প্রাণপণ।

একপর্যায়ে চাচা এলেন। বাবার হাত ছাড়িয়ে নিয়ে গেলেন। মাটিতে লুটিয়ে আমার কান্নার তীব্রতায় বাবা একটু সময়ের জন্যও দাঁড়ালেন না। কোথায় যাচ্ছেন, জানি না! আসবেন কি না, তা–ও বুঝতে পারছি না। কিন্তু আমার ভাবনায় দুই বছরের কষ্ট জমা। কিসের কষ্ট, সেটাও ঠিক বুঝতে পারছি না।

সকাল ছয়টা। কাঁদতে কাঁদতে ঘুম ভেঙে গেল। চেয়ে দেখি বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। ঘরে আলো এসে পড়েছে এক–আধটু, আর আমি একা শুয়ে আছি। কান্নার রেশ এখনো রয়ে গেছে। বুক ভারী, বুঝতে পারলাম কান্নার বাকি আরও অনেক। বাবা স্বপ্নে এসেছেন, বাস্তবে আসা বন্ধ হয়েছে বছর দুই আগে।

বন্ধু, সিলেট বন্ধুসভা