‘বস্তুত বাঙালি জাতির সর্বশ্রেষ্ঠ কাব্য গীতাঞ্জলি নয়, বলাকা নয়, সোনার তরী নয়। আর দাবায়ে রাখবার পারবা না (শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্য প্রবন্ধ) কিংবা মাঝে মাঝে ভাবি চাষারা লাঙলের মুঠি ধরে দেশটা টিকিয়ে রেখেছে, নয়তো অসাধু আমলা, দুর্নীতিবাজ, রাজনীতিক এবং ফটকা ব্যবসায়ীরা দেশের সমস্ত মাটি মণ মেপে বিদেশে চালান দিত।’ (গাভী বৃত্তান্ত)—কথাসাহিত্যিক আহমদ ছফার উক্তিগুলো হৃদয় স্পর্শ করে। বর্তমান সময়ে আহমদ ছফাদের মতো স্পষ্টবাদী, চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়ার মতো ভালো ও দরদি মানুষের বড় অভাব। তিনি ছিলেন একজন সত্যিকারের দেশপ্রেমিক, লেখক, বুদ্ধিজীবী ও আপাদমস্তক একজন মানবিক মানুষ।
মানুষের জীবনে সবার আগে শেখা উচিত গুণীজনকে সম্মান করা, তাঁদের স্মৃতি, কীর্তি হৃদয়ে লালন করা। নিজ সন্তানকেও শেখানো উচিত মানুষকে সম্মান করা; না হয় পরবর্তী প্রজন্ম সম্মান শব্দটাকে চিরতরে কবর দিয়ে দেবে। সৃষ্টিশীল গুণীজনকে সম্মান করাটাও কিন্তু পবিত্র কাজ। বিবেকের আদালতে নিজেকে প্রশ্ন করি, আসলে আমরা কি তা করতে পারছি? গুণীদের সম্মান না করলে পৃথিবীতে গুণীজনের জন্ম কী করে হবে?
পল্লিবাংলার সৃজনশীল মানুষেরা সব সময় অবহেলা, উৎসাহ ও অনুপ্রেরণাবিহীন পরিবেশে বেড়ে উঠেছে, মুখ তুলেও তাকায়নি। না-ফেরার দেশে যাওয়ার পর অনেকে গুণীজনকে সম্মান দেখাতে যায়। কেন জীবদ্দশায় নয়? অনেক সময় দেখা যায়, সৃষ্টিশীল মানুষগুলো একসময় তাঁর জিয়নকাঠির আলো ছড়িয়ে বিখ্যাত হয়ে ওঠেন। সাহিত্য-সংস্কৃতিকে অমরত্ব দান করতে হলে তাঁদের ভালোবাসতে হবে। হাত বাড়িয়ে বিনম্র চিত্তের সঙ্গে সম্মান করতে হয়। অজানা বিস্মৃত অধ্যায় স্বজাতির সাহিত্য-সংস্কৃতির অতীত ইতিহাস উপলব্ধি করতে হয়।
ছাত্রজীবন থেকে লেখক আহমদ ছফার নাম শুনেছি। দুর্ভাগ্য, সাক্ষাৎ হয়নি। তাঁকে কখনো দেখিনি। দীপ্তিমান লেখক ছফার বই পড়ে জানলাম, তিনি উঁচু কাতারের একজন দেশবরেণ্য কথাসাহিত্যিক। অজানা কৌতূহল থেকে লেখককে জানার পিপাসা পেয়ে বসে।
একদিন গুণী মানুষটার স্মৃতিবিজড়িত চট্টগ্রামের চন্দনাইশ উপজেলার গাছবাড়িয়া গ্রামের সাহিত্যপাড়ায় পরিদর্শনে গিয়েছিলাম। আঁকাবাঁকা রাস্তা। সবুজ-শ্যামল পাখিডাকা ছায়াঘেরা ছবির মতো সুনিবিড় গ্রাম। রাস্তার দুপাশে সবজিখেত, মরিচ, বেগুন, শিমের লতায় থোকা থোকা শিমের নাচন। বাগানের মাঝখানে কাকতাড়ুয়া। পাকুড়গাছে দোয়েল শিস তুলছে। একটু সামনে গিয়ে দক্ষিণ গাছবাড়িয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এই স্কুলে জীবনের প্রথম পাঠ নিয়েছিলেন লেখক আহমদ ছফা। পরবর্তী সময় গাছবাড়িয়া নিত্যানন্দ গৌরচন্দ্র উচ্চবিদ্যালয়ে ভর্তি হন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দুটি লেখক আহমদ ছফা স্মৃতিবিজড়িত। পরিতাপের বিষয় দুটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই লেখকের কোনো স্মৃতিচিহ্ন নেই। তাঁর পরিবার কিংবা বন্ধুবান্ধবেরাও কেউ এগিয়ে আসেনি।
সাহিত্যপাড়ায় বাপ-দাদার ভিটে ও লেখকের ভাইপোদের জরাজীর্ণ বাড়িটি আছে। একসময় আহমদ ছফার মাটির ঘর ছিল; সেটিও বিলুপ্ত। লেখকের খুব কাছের প্রতিবেশী নাতি-সম্পর্কীয় তারেক বলল, ছফা দাদুর একটা মাটির ঘর ছিল, বর্তমানে নেই। লেখকের বাড়ি ঘেঁষে ধীরগতিতে এঁকেবেঁকে বয়ে গেছে ‘বরুমতি খাল’ আঞ্চলিক ভাষায় বলে ‘বৈরগনি খাল’ দেখতে ছোট নদীর মতো। এই খাল নিয়ে লেখকের একটা বইও আছে ‘বরুমতির আঁকেবাঁকে’।
কথাশিল্পী আহমদ ছফা ১৯৪৩ সালের ৩০ জুন চট্টগ্রাম জেলার চন্দনাইশ উপজেলার গাছবাড়িয়া গ্রামের এক মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর অনবদ্য রচনাবলি অনন্তকাল বেঁচে থাকবে। মৃত্যুর আগপর্যন্ত বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় নিয়মিত লিখে গেছেন। মৃত্যু নিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘মৃত্যু হলো শোকের চেয়েও প্রয়োজনীয়। মৃত্যু জীবিতদের জন্য জায়গা সৃষ্টি করে। মৃত্যু সৃষ্ট জীবের কলুষ কালিমা হরণ করে, মৃত্যু জীবনকে শুদ্ধ এবং পবিত্র করে।’
জীবনের প্রতি তাঁর কোনো মায়া ছিল না। নিয়মকানুন মানতেন না, খাওয়াদাওয়া ঠিকমতো করতেন না। গানের কথায়ও লিখেছেন, ‘ঘর করলাম নারে আমি সংসার করলাম/ আউল বাউল ফকির সেজে আমি কোনো ভেক নিলাম না।’ ২০০১ সালের ২৮ জুলাই কথাসাহিত্যিক আহমদ ছফা সবাইকে কাঁদিয়ে চিরতরে প্রস্থান নেন। সাহিত্য জগতের সবচেয়ে উজ্জ্বলতম নক্ষত্র বিচিত্র দার্শনিকের শেষের ঠিকানা হলো মিরপুর কবরস্থানের ব্লক ক, ২৮ লাইন ১০৮৫ নম্বর, সাড়ে তিন হাত মাটির কুটিরে। তাঁর কবরের নকশা করেছিলেন শিল্পী রশীদ তালুকদার এবং সমাধির ইট ক্রয়ের টাকা দিয়েছিলেন ওবেইদ জয়গির। প্রিয় লেখকের শেষের ঠিকানা দেখতে গিয়েছিলাম। মসজিদের ঠিক পেছনে শুয়ে আছেন। কবরটি এত সুন্দর লাল টালি ইটের ঘেরা; মাঝখানে সবুজ দূর্বাঘাসের চাদর, পাশে কামিনী ফুলের গাছ। দেশের মানুষ প্রকৃতিপ্রেমী, স্পষ্টবাদী লেখক ও বুদ্ধিজীবীকে চিনতে না পারলেও প্রকৃতি ঠিকই চিনেছে। প্রকৃতি তার নিজস্ব তুলি দিয়ে সমাধিটি যেন সাজিয়েছে। লেখকের এপিটাপে ঝাপসা চোখে পড়ছিলাম—
‘আমার কথা কইবে পাখি করুণ করুণ ভাষে
আমার দুঃখ রইবে লেখা শিশিরভেজা ঘাসে
আমার গান গাইবে দুঃখে পথ হারানো হাওয়া
আমার নাম বলবে মুখে মেঘের আসা যাওয়া
ইন্দ্রধনু লিখবে লিখন কেমন ভালোবাসে
দীঘল নদী করবে রোদন সমাধিটির পাশে’—আহমদ ছফা।
বন্ধু, চট্টগ্রাম বন্ধুসভা