বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল কালাম পটিয়া পৌরসভার ৪ নম্বর ওয়ার্ডের প্রয়াত কালা মিয়া সওদাগরের বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবার নাম আবদুস সালাম আর মা রাশেদা বেগম। খুব কাছের প্রতিবেশী হওয়ায় আবুল কালামকে ছোটবেলা থেকে চাচা বলে ডাকতাম। তিনি ছিলেন মা–বাবার প্রথম সন্তান। তাঁর বাবা ছিলেন কয়লা ব্যবসায়ী। তিনি ভারত থেকে কয়লা আমদানি করে দেশের বিভিন্ন জায়গায় সরবরাহ করতেন।
আবদুস সোবহান রাহাত আলী উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসি এবং পটিয়া সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে সেখানেই ডিগ্রিতে ভর্তি হন বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল কালাম। তাঁর দুরন্ত কৈশোর গ্রামেই কাটে। তিনি যেমন ছিলেন সাহসী, তেমনি মেধাবী ও মিষ্টভাষী। পটিয়া সদরে যে কজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, তাঁদের মধ্যে আবুল কালাম অন্যতম। ফুটবল আর ব্যাডমিন্টন ছিল তাঁর প্রিয় খেলা। তিনি ভোজনরসিকও ছিলেন। গরুর মাংসের ভুনা ও পরোটা দিয়ে গরম জিলাপি আর মাখন খেতে খুব পছন্দ করতেন। পটিয়া কলেজে ছাত্রলীগের দুটি গ্রুপ ছিল, কান্ডারি ও দিশারি। কালাম চাচা ছিলেন কান্ডারি গ্রুপের অন্যতম নেতা। সে সময় পটিয়া কলেজসংলগ্ন খোকা মহাজনের মিষ্টির দোকানে তাঁদের বেশ আড্ডা জমত। খোকা মহাজনের মিষ্টির দোকানটি মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত, যা আজ কালের সাক্ষী। এলাকার বিচার–আচারে ডাক পড়ত মুক্তিযোদ্ধা আবুল কালামের। তিনি ছিলেন ন্যায়বিচারের প্রতীক। পোশাক-আশাকেও সব সময় পরিপাটি থাকতেন।
১৯৯৭ সালের দিকে কালাম চাচা একদিন আমাকে ডেকে বললেন, ‘শহীদ ছবুরের মৃতুবার্ষিকীতে কেলিশহর যাব। তুই গেলে আমাদের সঙ্গে চল। রাজি হয়ে গেলাম।’ কালাম চাচাই প্রথম আমাকে শহীদ ছবুরকে নিয়ে লিখতে উৎসাহ দেন। কালাম চাচার কাছে যুদ্ধদিনের অনেক গল্প শুনতাম। যুদ্ধের সময় যেদিন তিনি বাড়ি থেকে রাতের অন্ধকারে বের হবেন, সেদিন পড়লেন মহাবিপদে। তাঁর দাদা কালা মিয়া সওদাগরকে সবাই ভয় পেতেন। তাঁর ভয়ে বাড়ি থেকে কেউ বের হতেন না। এদিকে শহীদ ছবুর শিস দিচ্ছেন বের হওয়ার জন্য। পোষা কুকুর টমি ঘেউ ঘেউ করছে। কালাম চাচার দাদা ঘুমাননি। হঠাৎ তিনি গলাখাঁকারি দিয়ে চিৎকার করে ডাক দিলেন, ‘কে কে?’ বাইরে এসে হারিকেন দিয়ে দেখছিলেন চোর-ডাকাত এল কি না। তারপর তিনি চিৎকার করে বললেন, ‘দেশের পরিস্থিতি ভালো না, খবরদার কেউ ঘর থেকে বের হবি না। এই কালাম ঘুমিয়ে পড়। তুই জেগে আছিস কেন?’
সেই রাতে শহীদ ছবুর বাড়ির কুকুর যাতে আর ঘেউ ঘেউ করতে না পারে, সে জন্য কুকুরের পায়ুপথে লাঠি দিয়ে গরম ডালডা লাগিয়ে দেন। এরপর কিছু পাউরুটি খেতে দেন। অন্ধকারে একটা কাপড়ের পোঁটলা নিয়ে কান্ডারি দলের সহযোদ্ধাদের সঙ্গে বের হয়ে যান কালাম চাচা। পরদিন তাঁকে সবাই খুঁজতে লাগলেন। পরে জানতে পারেন, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিয়েছেন তিনি। ২২ বছরের টগবগে তরুণ কালাম চাচা বেশ কয়েক মাস পর যুদ্ধ শেষে বাড়ি ফিরে আসেন।
একসময় দেশ স্বাধীন হয়। সহযোদ্ধা আহমেদ কবির, কবিয়াল এস এম নুরুল আলম, চৌধুরী মাহাবুবুর রহমান, সুনীল জলদাস, আবুল বাশারসহ আরও অনেকে বাড়ির সামনে এসে আনন্দ করতে থাকেন, ফাঁকা গুলি করেন। বাড়ির সবাই ভয় পেয়ে যান। কালাম চাচার মুখভর্তি দাড়ি, মাথাভর্তি বাবরি চুল দেখে কেউ চিনতে পারছিলেন না। তিনি তাঁর দাদাকে জড়িয়ে ধরেন। দাদা ধমক দেন, ‘কে আপনি?’ কালাম চাচা বলেন, ‘দাদা, আমি আপনার নাতি।’ তখন তাঁর দাদা তাঁকে বুকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠেন। তিনি বলেন, ‘কোথায় ছিলি এত দিন ভাই আমার? তোর জন্য বাড়ির সবাই চিন্তায় অস্থির।’
কালাম চাচা যুবক বয়সে বেশ রোমান্টিক ছিলেন। ছোটবেলার খেলার সাথি চাচাতো বোন জোহরা বেগমের সঙ্গে প্রথমে বন্ধুত্ব, এরপর প্রণয়। দীর্ঘদিনের প্রণয়ের পর পরিবারের সম্মতিতে জোহরা বেগম তাঁর জীবনসঙ্গী হন। এই দম্পতির দুই ছেলে ও দুই মেয়ে। দুই মেয়েকে নিজে বিয়ে দিয়েছেন, তাঁরা বেশ সুখে আছেন। ছোট ছেলে মামুন মুক্তিযোদ্ধা কোটায় পুলিশ বিভাগে চাকরি পেয়েছেন। সহকারী সাবইন্সপেক্টর মামুন বলেন, ‘বাবাকে খুব মনে পড়ে। তিনি খুব বিনয়ী ও নীতিমান ছিলেন। অন্যায়ের কাছে কখনো মাথানত করতেন না। অন্যায় দেখলে হুংকার দিতেন।’
২০০৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর, বিজয়ের মাসে, কালাম চাচা না–ফেরার দেশে পাড়ি জমান। স্বাধীনতার ৫২ বছর পেরিয়ে গেলেও তাঁর কবরটি অবহেলিত অবস্থায় পড়ে আছে। পরিবারের লোকজন টিনের এপিটাফ ও প্লাস্টিকের তার দিয়ে চিহ্নিত করে রেখেছেন। তাঁর ২০তম মৃত্যুবার্ষিকীতে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা।
বন্ধু, চট্টগ্রাম বন্ধুসভা