আজ দুঃখদের মুক্তি

ছবি: এআই/বন্ধুসভা

এক.
ক্লাসে বসার সিট না পেয়ে সুহিন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ক্লাস করছে। সংখ্যায় কম বলে ঠাসাঠাসি করে বসতে হয়নি মেয়েদের। সুহিন দাঁড়িয়ে আছে দেখে স্যার বাজখাঁই গলায় ধমক দিলেন। বান্ধবীদের পাশে না বসার কারণে নারীবিদ্বেষী বলে ছেলেদের বিরুদ্ধে যা তা বকলেন। অবশেষে সুহিন জুত করে বসতে চাইল নিরার পাশের সিটে। স্যার দ্বিতীয় সারির তৃতীয় নম্বর বেঞ্চে বসিয়ে দিলেন ওকে। পুরো ক্লাস তার কাণ্ড দেখে অট্টহাসির রোল তুলল, তবু নিরুপায় ভেজা বিড়াল হয়ে স্যারের কথামতো বসে আছে সে।

স্যার নুরুল মোমেনের ‘নেমেসিস’ নাটক পড়াচ্ছেন ক্লাসে। ‘স্কুলশিক্ষক সুরজিত নন্দী তার ভালোবাসার পাত্রী সুলতাকে বিয়ে করতে চায়। সুরজিতের ছাত্রী সুলতা নৃপেন বোসের একমাত্র মেয়ে। নৃপেন বোস সুরজিতকে বাধ্য করে দুর্ভিক্ষের সময় চোরাকারবারি করে অঢেল সম্পদ লাভের জন্য...’। এদিকে সুহিন নিরাকে নিয়ে ভাবছে। এত কাছে, তবু যেন যোজন যোজন দূরে। স্যারের দিকে চেয়ে আছে কান খাড়া করে, কিন্তু কিছুই শুনছে না সে। ক্লাস শেষে নাটকের চরিত্রের অসম প্রেমের জটিল জাল সম্পর্কে বুঝেছে কি না, জানতে চাইলে সবার সঙ্গে সুহিনও সমস্বরে বলে ‘জি, বুঝেছি স্যার।’ ক্লাস শেষে ডিপার্টমেন্টে আর দাঁড়ায়নি সে। জানে তাকে নিয়ে সবাই মজা করবে।

দুই.
ডিপার্টমেন্ট থেকে বটপাতায় লেখা নিমন্ত্রণপত্র পেয়ে সবাই অভিন্ন নীলাভ রঙের পাঞ্জাবি আর গলায় একটা করে গামছা ঝুলিয়ে হল থেকে বের হয়েছে সাজগোজ করে। সুহিনরা শহীদ মিনার চত্বরের দিকে আসতে না আসতেই সদলবল মেয়েরা আসছে হতাশার মোড় থেকে। ওরা তিনজন পায়ে পা মিলিয়ে হাঁটছে। সুহিনরা সংখ্যায় তিন। একটু কাছে আসতেই সুহিন লক্ষ করল মাঝখানের মেয়েটি গায়ের বধূর সাজে সেজেছে। অন্যদের চেয়ে লাবণ্যময়ও দেখাচ্ছে তাকে। হাঁটতে থাকা মাঝখানের মেয়েটি নিরা; ওর বিশেষ সাজগোজের কারণ হিম উৎসবে দেশি ঢঙি পর্বে গ্রামের বধূ বেশে নাচবে।

সময়মতো সবাই উপস্থিত হয়ে গেল অনুষ্ঠানে। শুরু হলো দেশীয় ঢঙি পর্ব। সদলবল গ্যালারিতে বসে সুহিন মন্ত্রমুগ্ধের মতো চেয়ে থাকে মঞ্চের দিকে। মঞ্চের কালো পর্দার ভেতর থেকে গান বাজতে শুরু করলে ঘুঙুর পায়ে সশব্দে নিরা তার পরিবেশনা শুরু করল। দাপিয়ে বেড়ানো স্বভাবের মতো আঁতিপাঁতি করে এদিক-ওদিক তাকিয়ে মাটির কলস জলে ডোবানোর ভঙ্গি করে। জল নিয়ে চলে যাওয়ার পথে রাখাল বাঁশি বাজিয়ে ওর পথ রুদ্ধ করে। রঙিন ফিতায় বাঁধা চুলের মুঠি পেছনে ছুড়ে ভেংচি কেটে মুখ আর ঘাড় বেঁকিয়ে চলে যায়। কী অভিনয় মেয়েটির!

মঞ্চ থেকে তার প্রস্থান ঘটলেও সুহিনের অনিমেষ চেয়ে থাকার রেশ কাটেনি তখনো। প্রভাত পিঠে আলতো চড় বসিয়ে ঘোর ভাঙায়।

এভাবে দেখতে দেখতে তার প্রতি সুহিনের ব্যাকুলতা বাড়তে থাকে। আস্তে আস্তে বুকের মধ্যে প্রসারিত হতে থাকে ভালোবাসা নামক এক অদৃশ্য বস্তু। অনেকবার নিরার সঙ্গে কথা বলতে গিয়েও ফিরে এসেছে। সবার সামনে যদি বাজে কিছু বকে! বখাটে ভাববে না তো! লজ্জা আর সন্দেহের জালে আটকে থাকে সুহিন। এভাবে দ্বিধাদ্বন্দ্বে কেটে গেল দুটি বছর।

একদিন লাজলজ্জা একপেশে করে মনিকাকে একটা মেসেজ লেখে, লেখে আবার কাটে আবারও লেখে। শেষে চোখমুখ বন্ধ করে মেসেজটা পাঠিয়ে দেয় সুহিন। নিরাকে সুহিনের পছন্দের কথা জানিয়ে দিয়েছে মনিকা। মেয়েটি কী না কী মনে করে। সুহিন পরপর কয়েক দিন ক্লাসে যায়নি সংকোচে। মনিকার কথা শুনে নিরা রীতিমতো ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল। সুহিনের মতো লাজুক, মুখচোরা ছেলের মতলব সে আগেই আঁচ করতে পেরেছে। অথচ কত শত রাত, কত সহস্র প্রহর নিরার অপেক্ষার থেকেছে সুহিন।

মেয়েমানুষের সঙ্গে কথার রাজ্যে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে যাওয়া সুহিনের ধাতে নেই। কিন্তু নিরার সঙ্গে কথা হয় হুলুস্থুল; কথার কুশিকাটায় বুনতে থাকে বড় বড় অবান্তর স্বপ্ন।

তিন.
শেষ বর্ষের পরীক্ষার শেষে গ্রামে গেল নিরা। সে গ্রামের বাড়ি গেলে সুহিন কালেভদ্রে যায় ক্লাসে; কেমন যেন ক্যাম্পাস পুরাই খালি খালি। ভালো লাগে না তার। নিরা গ্রামের বাড়ি গেছে মাস দেড়েক হলো, ফেরার কোনো চিহ্ন নেই। সুহিন জানতে চাইলে বিশেষ কিছুই বলে না। তার আচরণ আগের চেয়ে ভারী হয়ে আসছে। সপ্তাহ আগে বলেছিল মায়ের অসুস্থতার কথা। ডায়াবেটিস, হাঁপানির টানটাও বেড়েছে। বয়সও কম হয়নি। দীর্ঘদিন কলেজের শিক্ষকতা করেছেন। সংসার গুছিয়েছেন বয়স হওয়ার পর।

সপ্তাহ দুয়েক পরে এক নিরাক পড়া বিকেলের শেষে প্রিয় নম্বর থেকে ফোন আসে অকস্মাৎ। ফোন তুলতেই কোনো রকম ভূমিকা ছাড়াই কান্নার রোল শুনেই থ মেরে যায় সুহিন। শোরগোল ও কান্নার আওয়াজে তেমন কিছুই শোনা যায়নি। ভাঙা ভাঙা কথা তালি জোড়া দিয়ে বোঝার চেষ্টা করে সে। কান্নার দমকে কথা অস্পষ্ট, বিস্ময়ে বিমূঢ়ের মতো দাঁড়িয়ে থাকে।

চার.
বেশ কিছুদিন পর নিরা ক্যাম্পাসে ফেরে। কেমন যেন মনমরা অবস্থা। আগের মতো ঠোঁটের কোণায় সিগনেচার হাসি নেই, সখীদের সঙ্গে চষে বেড়ানোর ইচ্ছা নেই। সবকিছুই যেন মা নামক বিশেষ এক ব্যক্তির সঙ্গে সমাহিত হয়ে গেছে। তবে স্বভাবে বিস্তর পরিবর্তন এসেছে। নিরা এখন সুহিনের সঙ্গে ঘুরতে চায়, সঙ্গ দিতে চায়; বিকেলের মোলায়েম রোদ গায়ে মাখতে চায়। মনটাকে ফুরফুরে বাতাসে সুতো ছেঁড়া ঘুড়ির মতো ওড়িয়ে হালকা করে নিতে চায়। কত বিষণ্ণতা বুকে ভর করে আছে, তার কোনো ইয়ত্তা নেই। সে মোলায়েম ঘাসের গালিচায় স্নিগ্ধ পা জোড়া চালান করে মৃদুভাবে। সম্মোহনমাখা চাহনিতে দূর আকাশে উড়ে যাওয়া পাখির ঝাঁকের দিকে তাকিয়ে থাকে স্তম্ভিত হয়ে। সুহিনও নিরাকে যথাসাধ্য সময় দেওয়ার চেষ্টা করে। শহরের বেশ কিছু দর্শনীয় স্থানও তাদের দেখা হয়ে গেছে ইতিমধ্যে।

ভার্সিটির হলে কেমন করে দিন যাচ্ছে, এ নিয়ে নিরার বাবা অতিশয় উদ্বিগ্ন। বাবার যত্তসব চিন্তা মা মরা মেয়ে আদুরীকে নিয়ে। এলাকায় পাঁচকান রটাচ্ছে বিয়ে দেওয়ার কথা। মায়ের ভালোবাসার, স্নেহ-মমতার দায়ভার বাবা মেটাতে পারবে না, তাই অবিলম্বে একমাত্র মেয়েকে থিতু হওয়ার ব্যবস্থা করে দেওয়ার তোড়জোড় করতে লাগলেন তিনি। নিরাও এদিকে সুহিনকে বিয়ের তাগাদা দিতে থাকে। দুজনই কেবল অনার্স পাস করেছে। চাকরিবাকরি নেই কারোরই। সুহিন বাড়িতে মা–বাবাকে জানিয়েছে। তার কথাতে সায় দেননি কেউই। করজোড় করে বলাতেও রাজি হননি। সুহিন এ-ও প্রস্তাব করে বাবাকে, মেয়েটি আরও দুই বছর নিজের মতো করে থাকবে; সে চাকরির প্রস্তুতি নেবে। মা তো অগ্রপশ্চাৎ বুঝবার মানুষ নন, বিলাপ করে পাড়াসুদ্ধ মাথায় তুলে বসে। বাবা স্পষ্টত বলে দিয়েছে, যত দিন ভালো একটা চাকরি জুটবে না, তত দিন ভুলেও যেন বিয়ের কথা মুখে না আনে আর। এরপর সুহিন নিরাকে কিছুই বলতে পারেনি। সে নিজেই বুঝে গেছে সব।

পাঁচ.
শেষবারের মতো নিরাকে ক্যাম্পাস থেকে রেলস্টেশনে এগিয়ে দিতে আসে সুহিন। তার সঙ্গে নিরা বেশ কয়েকবার শহরে ঘুরতে এসেছিল, তখন শাটল ট্রেনে তার কী দাপাদাপি! বিচলিত নয়নের আলাভোলা চাহনি। বগির দরজায় হাত রেখে শরীরটা ঈষৎ হেলিয়ে দিয়ে মিশে যেত শাটলের ঝনঝনানি আর প্রকৃতির মধ্যে। গতির চোটে কার্পাস তুলার মতো চুল উড়ে এলোমেলো করে ঢেকে দিত নিরার মুখ, চোখ আর বুক। সুহিন মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখত, তার খুব করে ইচ্ছা করত নিরাকে জড়িয়ে ধরার। কিন্তু পারেনি কখনোই, সে কী লাজ! নিরার মোলায়েম চেহারার মুগ্ধতায় মুগ্ধ হয় সুহিন। সে ভাবে সংস্পশে না এসেও তো ভালোবাসা যায়, সে-তো কেবল মনের মিলন।

আজ নিরার হৃদাকাশে মেঘ জমেছে। বেদনারা অকস্মাৎ বৃষ্টিরূপে ঝরে পড়ার অপেক্ষায়। সুহিন জানতে চাচ্ছে এত দূরের পথ যেতে কোনো সমস্যা হবে না তো! এত বছর নিরা একাই যাতায়াত করেছে; কিন্তু সুহিন কথা বলার ছল করে কথার ফাঁদ ফেঁদে বসেছে। কথার উত্তর দেওয়ার মতো নিরার জোর নেই। কথা বলতে গিয়ে আটকে যায়, গলা ভারী হয়ে আসে। নিরার চোখ জোড়ায় আর্দ্রতার রেখা স্পষ্ট।

স্টেশনে এসে প্ল্যাটফর্মে সুহিন তাকে বিদায় জানাল। শেষমেশ নিরা আর সহ্য করতে পারেনি, সুহিনকে জড়িয়ে ধরে সে কী কান্না! চোখের বান ডাকা জলে সুহিনের কাঁধ ভিজে গেছে। নিরা সুহিনকে শক্ত করে চেপে ধরেছে; সুহিন আড়ষ্টের মতো দাঁড়িয়ে আছে। প্ল্যাটফর্মে উপচে পড়া ভিড়ের সহস্র জোড়া চোখ প্যাটপ্যাট করে তাকিয়ে আছে তাদের দিকে। তখন তাদের এটুকুই কাণ্ডজ্ঞান ছিল না। কান্নার দমকে সারা শরীর কাঁপছে নিরার। সুহিন ছাড়িয়ে নিয়ে চোখ মুছে দিতে চাইলে সে হাত সরিয়ে দেয়।

পৌরষত্ব রক্ষার্থে সুহিন কান্না লুকিয়ে রাখে। ‘আবার দেখা হবে কোনো এক পুষ্পে ভরা বসন্তের পলাশতলিতে...।’ বিড়বিড় করে বলতে গিয়েও চোখ ঝাপসা হয়ে আসে সুহিনের। ততক্ষণে ট্রেনের হুইসেল বেজে উঠলে নিরা তড়িঘড়ি করে উঠে পড়ে। সর্পিল গতিতে ট্রেন চলা শুরু করে, নিরার মনোবেদনার বরফ গলে পড়ে অশ্রুবেশে সে সিক্ত নয়নে ঝুঁকে আছে জানালায়। অবশেষে ঈষৎ হাত নাড়াতে নাড়াতে অদৃশ্য হয়ে গেল। লৌহদণ্ডের মতো দাঁড়িয়ে অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে রইল সুহিন। সে জানে তার কখনোই রংপুরের রাণীশংকৈল যাওয়া হবে না, তবু মিথ্যা আশ্বাস দিয়েছে মনকে।

আজ দুঃখদের মুক্তি দিয়ে নিরা হাউমাউ করে কান্না করতে পারলেও সুহিন পারেনি। পুরুষের কষ্ট পাওয়ার অধিকার নেই, তবু হৃদয়টা ক্ষতবিক্ষত হয়। উচাটন মনে বিড়বিড় করে বলে, ‘অনেক কিছুই বলার ছিল, কিন্তু পারলাম না। নিয়তি চাইলেই এতটা বিভেদন করতে পারে না। কখনোই না।’

বন্ধু, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধুসভা