ঘটকালি

প্রতীকী

‘হ্যালো হ্যালো, ভাই কে বলছেন? কাজি অফিস?’
‘জি না ভাই, আমার নাম কাজি অফিস না, কাজী আসিফ।’
‘আচ্ছা ভাই, কাজী আসিফ। এখন মনে পড়েছে। আপনিই তো স্বামী মরা নিপার বিষয়ে আলাপ করেছিলেন।’
‘ভাই, আপনি আবার ভুল করছেন। ওর নাম স্বামী মরা নিপা নয়, শামীম আরা নিপা।’
নিশাদ ক্লান্ত গলায় বলল, ‘ভাই রে, রোজায় ধরেছে, সবকিছু তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। কী বলতে কী বলি! মাথা আউলে গেছে।’
‘কেন ভাই? ইফতার করেননি?’
‘করেছি তো। মাথা আউলে যাচ্ছে কেন, বুঝলাম না। আমাদের পাড়ায় এক নেশাখোর আছে, ফেনসিডিল দিয়ে ইফতার করে। আমিও মনে হচ্ছে ফেনসিডিল দিয়ে ইফতার করেছি। কেউ বোধ হয় শরবতের সঙ্গে এই জিনিস মিশিয়ে দিয়েছে। ফোন করেছেন কেন, সেইটা বলেন।’
‘আমার বিষয়টা কী করলেন ভাই?’
‘কোন বিষয়ে যেন? স্বামী মরা নিপার বিষয়ে?’
‘ভাই, শামীম আরা নীপা…।’
‘আচ্ছা। শোনেন ভাই, জীবনে আমি সবকিছুই করব, শুধু ঘটকালি করব না। চুরি–ডাকাতি করতে বলেন, অনায়াস করব। কাউকে খুন করতে বলেন, তা–ও সমস্যা নাই। ঘটকালি কাভি নেহি। নেভার এভার!’

কাজী আসিফ একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। এই লোক এক সপ্তাহ আগে নিজে থেকে প্রস্তাব দিয়ে এখন কেন পিছিয়ে যাচ্ছে, বোঝা গেল না। সে নিজে থেকেই বলেছে, শামীম আরা নীপা তার আত্মীয় এবং ভালো মেয়ে। মেয়ের ছবিও সংগ্রহ করে দিয়েছে। বাসার সবাই মেয়েকে পছন্দও করেছে। হঠাৎ কী হলো?
‘হ্যালো নিশাদ ভাই, আপনিই কিন্তু আমাকে প্রস্তাব দিয়েছিলেন। হঠাৎ পিছিয়ে যাচ্ছেন কেন? এই মেয়ের কি অন্য জায়গায় সম্পর্ক আছে?’
‘ভাই রে, কার সঙ্গে কার সম্পর্ক আছে, এটা আমার জানার কথা না। এই কাজে আর জড়াব না। ঘটকালি করলে আজকাল লোকজন গায়ের কোট খুলে নেয়। আমি এর মধ্যে নেই। প্রয়োজনে ভিক্ষুক হব, তবু ঘটক হব না।’
আসিফ করুণ গলায় বলল, ‘কী হয়েছে, আমাকে একটু খুলে বলবেন ভাই?’
নিশাদ ক্লান্ত গলায় বলল, ‘ভাই রে, আমি সবকিছু খুলেই বলছি। আমি এখন বাথরুমে। একেবারে নেংটা বাবা!’
আসিফ দুঃখের মধ্যেও হেসে ফেলল, ‘কী হয়েছে, সেটা আমাকে একটু খুলে বলেন তো ভাই।’
‘আজ আমার মামা এসেছিলেন। আমি…’
আসিফ বিরক্ত গলায় বলল, ‘আপনার মামার সঙ্গে আমার বিয়ের ঘটকালির সম্পর্ক কী ভাই?’
‘আছে রে ভাই, আছে।’
‘কী সম্পর্ক?’

কাজী নিশাদ একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, ‘তাহলে শোনেন ভাই। একবার মামা এসেছেন আমাদের বাড়িতে বেড়াতে। সেদিন এলাকার একটা ছেলে কী কারণে যেন আমাদের বাসায় এসেছে। ছেলেটা দেখতে–শুনতে ভালো। ব্যবহার অমায়িক। সেই ছেলের প্রশংসা মামার কাছে করলাম।’
আসিফ অধৈর্য হয়ে গেল, ‘প্রশংসা করেছেন ভালো কথা, এর সঙ্গে আমার সম্পর্ক কী? কারও প্রশংসা করা কি খারাপ?’
‘অবশ্যই খারাপ। বিবাহযোগ্য মেয়ে আছে, এমন বাপের কাছে কোনো ছেলের প্রশংসা করলেই ফেঁসে যাবেন। আমি সেই ছেলের প্রশংসা করে পড়েছি কঠিন বিপদে।’
‘বলেন কী! কীভাবে?’
‘আমার প্রশংসা শুনে মামা তলে তলে কীভাবে যেন খোঁজখবর নিয়ে সেই ছেলের সঙ্গে তার মেয়ের বিয়ে ঠিক করে ফেললেন। খুশি হয়ে আমাকে দামি কোট–প্যান্ট বানিয়ে দিলেন। ইতালির ব্র্যান্ডের জুতা কিনে দিলেন। এখন কোথাও গেলে সেই কোট–প্যান্ট, জুতা পরে যাই।’
‘আলহামদুলিল্লাহ, এটা তো ভালো খবর। দামি কোট–প্যান্ট–জুতা কোথাও পরে যাওয়ার জন্যই তো বানানো।’
‘মোটেই ভালো খবর না রে ভাই। মামা এখন লাঠি নিয়ে আমাকে খুঁজছেন কেলানোর জন্য। আমাকে মামার ভয়ে পালিয়ে থাকতে হচ্ছে। শুনেছি মামলাও করেছেন।’
আসিফ অবাক হয়ে গেল, ‘বলেন কী ভাই? মামা লাঠি নিয়ে আপনাকে খুঁজছেন কেন? মামলাই বা কেন করবেন? আপনি তাঁর মেয়েকে নিয়ে পালিয়ে গেছেন নাকি? কাজটা ঠিক করেননি।’
‘দূর ভাই, কী বলেন! সেই মেয়ের বিয়ে হয়েছে ছয় মাস। এই কয় মাসেই মামা বুঝে গেছেন যে তাঁর মেয়ের জামাই আস্ত একটা হারামজাদা! সে বদের বদ।’
‘বলেন কী ভাই!’
‘তবে আর বলছি কী! আমি বিয়ের বিষয়ে আগামাথা কিছুই জানি না। তারপরও মামা আমাকে লাঠি নিয়ে তাড়া করছেন। আমি সেই ছেলের প্রশংসা করেছি; তাঁরা আমার কথায় উৎসাহ পেয়ে এখানে মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। এটাই হচ্ছে আমার অপরাধ!’
‘ও আল্লাহ! বলে কী!’
‘খুবই সমস্যায় আছি রে ভাই। মামা আজকে বাসায় এসে আমাকে না পেয়ে কোট, প্যান্ট, জুতা সব ফেরত নিয়ে গেছেন। ঘটকালি না করেই এই অবস্থা। ঘটকালি করলে কী অবস্থা হতো, বুঝতে পারছেন তো? এরপরও আপনার বিয়ের ঘটকালি করতে বলবেন?’

আসিফ ক্লান্ত হয়ে মাথা চুলকাতে লাগল। কী বলবে বুঝতে পারছে না।

জাজিরা, কোন্ডা, কেরানীগঞ্জ, ঢাকা