ধানমন্ডি লেকের ধারে সকালবেলায় সিমেন্টের একটা বেঞ্চিতে জড়োসড়ো হয়ে বেগুনিপাড় সাদা শাড়িতে বসে আছে নওরীন। বেঞ্চিতে অগোছালোভাবে কিছু পলাশ ফুলও পড়ে আছে। নওরীনের খানিকটা শীত লাগছে। জ্বরও আসতে পারে। মাথার খোলা চুল এলোমেলো, শাড়িটাও যে আনাড়ি হাতে পরানো হয়েছে, বোঝা যাচ্ছে। মাথা এখনো ঝিমঝিম করছে। দু-একটা কাক কা কা শব্দ করে মাটি থেকে খাবার তুলে নিয়ে আবার উড়ে দূরে কোথাও গিয়ে বসেছে।
দুরু দুরু বুক কাঁপছে নওরীনের। খুব ভয় লাগছে। কেন এত ভয়, কারণও অজানা। সাত মাস আগে এক মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে জুনিয়র অফিসার হিসেবে কাজ শুরু করে সে। ভাইবা বোর্ডে আসিফ সাহেবের সঙ্গে পরিচয়। বয়সে নওরীনের চেয়ে কয়েক বছরের বড় হবে। তবে বেশ স্মার্ট আর অনর্গল ইংরেজিতে কথা বলতে পারেন। বিদেশ থেকে পড়ালেখা করে দেশে এসে পারিবারিক এই কোম্পানির সিইও হয়েছেন। নওরীনের ভালো সিজিপিএ, সঙ্গে এক বছরের ইন্টার্নশিপের অভিজ্ঞতা দেখে অনেক প্রশংসাও করেন আসিফ সাহেব। এ–ও বলেন যে এমন তরুণ, মেধাবী, সুন্দরী এমপ্লয়ি অফিসে দরকার।
গত মাসে নওরীনের প্রোমোশন হয়, স্যালারি বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ। এর মধ্যে আসিফ সাহেবের সঙ্গে নওরীনের বেশ হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। অফিস শেষে তাকে সুপার হোস্টেলে নামিয়ে দেওয়া, মাঝেমধ্যে কফি খেতে যাওয়া, আর অফিসের বিভিন্ন কাজ নিয়ে অনেক রাত অবধি ফোনে যোগাযোগ করা—এসবের মধ্য দিয়ে আসিফ সাহেবের প্রতি নওরীন ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে পড়ে। মনে মনে একধরনের ভালো লাগা তৈরি হয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ে নওরীনের জীবনে এসেছিল মুন নামের এক যুবক। একই ব্যাচ, তবে ভিন্ন ডিপার্টমেন্টে পড়ত তারা। বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে যাওয়া, নোট আদান–প্রদান করা থেকে দিন দিন বন্ধুত্ব এবং আরও গভীর সম্পর্কের দিকে জড়ানোর আগেই মুনের বাবা মারা যান। সংসারের সব দায়িত্ব এসে পড়ে ছেলেটির ওপর। যে মুন সারা দিন নওরীনকে সঙ্গ দিত, তাকেই এখন ক্লাস শেষে চারটা–পাঁচটা টিউশনি করিয়ে বাড়িতে টাকা পাঠাতে হয়। ধীরে ধীরে দুজনের যোগাযোগ কমতে থাকে। একসময় নওরীন মুনকে ফেসবুকে ব্লক করে দিলে যোগাযোগ একদমই শেষ হয়ে যায়।
তবু এই মাসের ৭ তারিখ তার জন্মদিনে মুন একটি শাড়ি পাঠিয়েছিল, সুপার হোস্টেলের ঠিকানায়। বেগুনিপাড় সাদা মণিপুরী শাড়িটা নওরীন ঠিক করেছিল কোনোদিনই পরবে না। কিন্তু যত্ন করে ট্রাংকে ন্যাপথলিন দিয়ে তুলে রেখেছিল ঠিকই। মুন জানত, মাস্টার্স পরীক্ষা দিয়ে হল ছেড়ে নওরীন এখন মিরপুর সুপার হোস্টেলে থাকে। তাই এই ঠিকানায়ই শাড়িটা পাঠিয়ে দেয়।
নওরীন শাড়িটা পেয়ে মুনকে ধন্যবাদ জানানোর প্রয়োজনও মনে করেনি। তার কাছে মুন এখন মৃত। তার জীবনজুড়ে এখন শুধু আসিফ সাহেবের মুগ্ধতা। হয়তো কিছুটা লোভও ছিল। এত বড় কোম্পানির সিইও, কত দামি গাড়ি। হয়তো বাড়িটাও মস্ত আলিশান হবে। অন্যদিকে তাকে থাকতে হয় হোস্টেলের কবুতরের খোপের মতো একটি ঘরে। স্বপ্নে বিভোর হয়ে কত রাত যে আসিফ সাহেবের সঙ্গে হোস্টেলের বারান্দায় বসে গল্প করে কাটিয়েছে, ইয়ত্তা নেই। অফিসের কাজের কথা দিয়ে কথোপকথন শুরু হলেও ঘণ্টা দুয়েক পরে তা শেষ হতো কী দিয়ে, তা ভাবলে নওরীন নিজেই লজ্জা পেয়ে যায়।
গতকাল আসিফ সাহেব তার কোম্পানির সাকসেস পার্টি দেবেন বলে নওরীনসহ সব স্টাফকে তার বাড়িতে দাওয়াত করেন। নওরীন কী মনে করে মুনের দেওয়া শাড়িটা পরেই উবার ভাড়া করে আসিফ সাহেবের বাসায় হাজির হয়। বনানীর কামাল আতাতুর্ক অ্যাভিনিউতে আসিফ সাহেবের বিশাল বাংলোবাড়ি। রাতের খাবার শেষ হতেই আসিফ সাহেব সবাইকে মদ অফার করেন। মদের সঙ্গে সিগারেট, ভেপ সমানতালে চলছিল। নওরীন এসবে অভ্যস্ত না হলেও আসিফ সাহেবেকে খুশি করতে বিয়ারের একটা গ্লাস হাতে নেয়। আসিফ সাহেব নিজে তাতে বরফের টুকরা মিশিয়ে দেন। চিয়ার্স বলে পান শুরু করতেই নওরীন অজ্ঞান হয়ে যায়। ভোরের আলো ফুটলে জ্ঞান ফিরলে নওরীন নিজেকে আবিষ্কার করে ধানমন্ডি লেকের ধারে এক বেঞ্চিতে শয়নমুদ্রায়।
বন্ধু, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধুসভা