ফুটবলে জার্সি নম্বরের ইতিহাস

বাঁ থেকে ডিয়েগো ম্যারাডোনা, ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো, পেলে, লিওনেল মেসি ও অলিভার কানছবি: সংগৃহীত

দেড় বছর আগে লিওনেল মেসি বার্সেলোনা ছেড়ে পিএসজিতে এলে দলটির ব্রাজিলিয়ান সুপারস্টার নেইমার চেয়েছিলেন তাঁর ১০ নম্বর জার্সিটি আর্জেন্টাইন অধিনায়ককে দিতে। তবে বন্ধুর প্রতি সম্মান জানিয়ে জার্সিটি নেননি মেসি। তিনি ক্যারিয়ারের শুরুতে বার্সেলোনায় ৩০ নম্বর জার্সি পরে খেলতেন। পিএসজিতেও সংখ্যাটি বেছে নেন। নেইমার যে প্রিয় জার্সিটি বন্ধুকে দিতে চেয়েছেন, সেটার অন্যতম কারণ, সে মনে করে ১০ নম্বর সংখ্যাটি তাঁর চেয়েও মেসিকে বেশি মানায়! দুই বন্ধুর একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধার এই উদাহরণ থেকেই বোঝা যায়, ১০ নম্বর জার্সির গুরুত্ব।

অবশ্য জার্সির এ নম্বরকে প্রথম আইকনিক করে তুলেছেন ব্রাজিলিয়ান কিংবদন্তি ও ফুটবলের রাজাখ্যাত পেলে। তিনি দেশটির হয়ে ১০ নম্বর জার্সি পরে তিনটি বিশ্বকাপ জয় করেন। পরবর্তীকালে আর্জেন্টাইন কিংবদন্তি ডিয়েগো ম্যারাডোনা এটির শোভা আরও বাড়িয়েছেন। এতটাই শোভা বাড়ান যে ইতালিয়ান ক্লাব নাপোলি তাদের ইতিহাসের সেরা ফুটবলার ম্যারাডোনার সম্মানে ১০ নম্বর জার্সিটি আজীবনের জন্য অবসরে পাঠিয়েছে। তবে জার্সি নম্বরের গুরুত্ব বোঝাতে আমাদের ফিরে যেতে হবে ইতিহাসের পাতায়।

পেলে
ছবি: সংগৃহীত

জার্সি নম্বরের ইতিহাস

১৯১১ সালে অস্ট্রেলিয়ার সিডনি লেইছার্ড ও এইচএমএস পাওয়ারফুলের মধ্যকার ফুটবল ম্যাচে প্রথম জার্সির পেছনে নম্বর যুক্ত করা হয়। পরবর্তীকালে ১৯২৩ সালে আর্জেন্টিনা তাদের খেলোয়াড়দের জার্সির পেছনে নম্বর লাগায়। যুক্তরাষ্ট্রে ১৯২৪ সালে ফল রিভার মার্কসম্যান ও সেন্ট লুই ভেসপার বুইকের মধ্যকার ম্যাচেও একই রীতির সূচনা হয়। আধুনিক ফুটবলের জনক ইংল্যান্ডে এ প্রচলন শুরু হয় তারও চার বছর পর ১৯২৮ সালে।

সে সময় জার্সির পেছনে নম্বর দেওয়ার প্রচলন শুরু হয় মূলত খেলোয়াড়দের চিহিৃত করার জন্য। কোচ যেন বুঝতে পারে কে কোন পজিশনে খেলবেন। পাশাপাশি দর্শকদেরও বুঝতে সুবিধা হতো।

১৯৮৬ বিশ্বকাপ হাতে ডিয়েগো ম্যারাডোনা। তাঁর ক্যারিয়ারের সেরা মুহূর্ত
ছবি: এএফপি

কে কোন নম্বরের জার্সি পরবেন

শুরুতে একটি দলের একাদশের জন্য ১-১১ নম্বর জার্সি বরাদ্দ ছিল। ১ থেকে ৬ নম্বর জার্সি পরতেন গোলকিপার, ডিফেন্ডার ও মিডফিল্ডাররা। ৭ থেকে ১১ নম্বর পরতেন আক্রমণভাগের ফুটবলাররা। কেউ বদলি নামলে তাঁর নম্বর ১১–এর বেশি হবে। এতে দেখা যেত, সেরা একাদশ সাজাতে গিয়ে বারবার জার্সি বদলাতে হতো। প্রথম নিয়মটির পরিবর্তন আনা হয় ১৯৯৩-৯৪ মৌসুমে। সেবার ইংল্যান্ড ফুটবল নিয়ন্ত্রকেরা ১ থেকে ১১ নম্বর জার্সিতে ম্যাচের মূল একাদশ সাজানোর বাধ্যবাধকতা তুলে নেন এবং প্রিমিয়ার লিগে এ নিয়মের প্রথম ব্যবহার শুরু হয়। ধীরে ধীরে বিশ্বের অন্যান্য লিগেও নিয়মটির প্রচলন হয়।

আর্জেন্টাইন গোলরক্ষক এমিলিয়ানো মার্তিনেজ। দলের সেরা গোলকিপার হয়েও তিনি ২৩ নম্বর জার্সি পরেন।
ছবি: রয়টার্স

শুরুতে ১ নম্বর জার্সি বরাদ্দ ছিল দলের সেরা গোলকিপারের জন্য। এখনো এর প্রচলন কিছুটা রয়েছে। যেমন স্পেন ও রিয়াল মাদ্রিদের সাবেক গোলকিপার ইকার ক্যাসিয়াস, জার্মানি ও বায়ার্ন মিউনিখ কিংবদন্তি অলিভার কান এ জার্সি পরে খেলতেন। তবে সেরা গোলকিপার ভিন্ন নম্বরের জার্সিও পরেন। যেমন বর্তমানে আর্জেন্টিনার সেরা গোলকিপার এমিলিয়ানো মার্টিনেজ ২৩ নম্বর পরেন।

২ নম্বর জার্সিটি বরাদ্দ থাকে রাইট ফুল ব্যাক ডিফেন্ডারের জন্য। এটিকে আরও বিখ্যাত করেছেন ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড কিংবদন্তি গ্যারি নেভিল ও ব্রাজিলিয়ান গ্রেট কাফু। ৩ নম্বর সংখ্যাটি পরে থাকেন লেফট ফুল ব্যাকরা। ইতালির পাওলো মালদিনি ও ব্রাজিলের রবার্তো কার্লোস জার্সিটির শোভা আরও বাড়িয়েছেন। ৪ নম্বর জার্সি রাইট সেন্টারব্যাক বা ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডারের জন্য। ৫ নম্বর লেফট সেন্টারব্যাক বা সেন্টার মিডফিল্ডারদের। স্পেন ও বার্সেলোনার কার্লোস পুয়েওল, ইতালির ফাবিও ক্যানাভারো, জার্মানির ফ্রেঞ্জ ব্যাকেনবাওয়ার এবং ফরাসি কিংবদন্তি জিনেদিন জিদান এ জার্সি পরে খেলেছেন। ৬ নম্বর পরে থাকেন সেন্টারব্যাক বা ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডাররা।

ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো
ছবিঃ সংগৃহীত

৭ নম্বর জার্সিটি উইঙ্গার এবং দ্বিতীয় স্ট্রাইকারের জন্য বরাদ্দ থাকে। তবে এটিকে ঐতিহাসিক করেছেন পর্তুগিজ কিংবদন্তি ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো। এমনকি ফুটবলে জার্সির এ সংখ্যা বলতে রোনালদোকেই বোঝায়। তাঁর ডাকনামও ‘সিআরসেভেন’। একটা সময় সমর্থকদের কাছে এ সংখ্যার জার্সির তেমন মূল্য ছিল না। কিন্তু পাঁচবারের ব্যালন ডি’অরজয়ী এটিকে এমন উচ্চতায় নিয়ে গেছেন যে ১০ নম্বরের পাশাপাশি এখন ৭ নম্বরও দলের সেরা তারকারা পরে থাকেন।

৮ নম্বর জার্সিটি ৭, ৯ কিংবা ১০-এর মতো অতটা আইকনিক না হলেও এর ওজন অনেক। এটি সাধারণত গোল করতে জানে এবং মিডফিল্ডাররা পরে থাকেন। তাঁরা বক্স টু বক্স খেলেন, ডিফেন্স ও অ্যাটাকিং পজিশনের মধ্যে সংযোগ সেতুর ভূমিকা পালন করেন। মোটকথা, এ পজিশনের খেলোয়াড়েরা মধ্যমাঠ থেকে খেলাটাকে পরিচালনা করেন। ৯ নম্বর জার্সিটি দেওয়া হয় দলের মূল স্ট্রাইকারকে, যাঁর কাজই হচ্ছে কেবল গোল করা। সবচেয়ে বড় উদাহরণ ব্রাজিলের কিংবদন্তি রোনালদো নাজারিও। বর্তমানে রিয়াল মাদ্রিদের করিম বেনজেমা, বার্সেলোনার রবার্ট লেভানডফস্কি অন্যতম। তবে করিম বেনজেমা অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার বা প্লেমেকারের ভূমিকাও পালন করে। ১১ নম্বর জার্সি মূলত লেফট উইঙ্গারকে দেওয়া হয়। সান্তোস ও বার্সেলোনায় নেইমার এই পজিশনে খেলতেন।

আর্জেন্টিনা অধিনায়ক লিওনেল মেসি
ছবি: এএফপি

কেন ১০ নম্বর জার্সি সবচেয়ে মূল্যবান

জার্সির পেছনে নম্বর প্রচলনের শুরু থেকেই ১০ নম্বর জার্সিটি বরাদ্দ থাকত অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার বা প্লেমেকারের ভূমিকায় থাকা খেলোয়াড়ের জন্য, যাঁর কাজ হচ্ছে আক্রমণ তৈরি করা, সতীর্থদের দিয়ে গোল করানো এবং নিজে গোল করা। দলের সবচেয়ে বিচক্ষণ ফুটবলারই এ পজিশনে খেলে থাকেন। তবে প্রথম দিকে এ জার্সি পরে অন্য পজিশনে খেলা যেত না। যদি কেউ খেলতেন, তাহলে তাঁকে জার্সি নম্বর বদলে নির্দিষ্ট ওই পজিশনের জন্য বরাদ্দ নম্বরটি পরতে হতো। কোচের সুবিধার্থে এমন নিয়ম ছিল বলে ধারণা।

জার্সিটিকে প্রথম সবচেয়ে মূল্যবান করে তোলেন পেলে। তিনি ১৯৫৮ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত ব্রাজিলের হয়ে তিনটি বিশ্বকাপ জয় করেন। তখন থেকেই মূলত বিশ্বব্যাপী ১০ নম্বর জার্সির জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে। তাঁকে কেউ কেউ সর্বকালের সেরা ফুটবলারও বলে থাকেন। আরও একজনকে পেলের পাশাপাশি সর্বকালের সেরা ফুটবলার বলা হয়। তিনি ডিয়েগো ম্যারাডোনা। আর্জেন্টাইন কিংবদন্তি পায়ের জাদুতে পুরো বিশ্বকে মুগ্ধ করেন। দেশটির ফুটবলকে তিনি অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যান এবং একটি বিশ্বকাপও জয় করেন। ১০ নম্বর জার্সিটি তাঁর কারণে আরও দামি হয়ে ওঠে। পরবর্তীকালে রিভালদো, জোহান ক্রইফ, মিশেল প্লাতিনি, ওয়েইন রুনি, লিওনেল মেসি, রোনালদিনহো, কাকা, নেইমাররা জার্সিটির মর্যাদা ধরে রেখেছেন।

গোলের পর নেইমার
রয়টার্স

অবশ্য বর্তমানে কেবল প্লেমেকাররা ১০ নম্বর জার্সি পরেন না। যেমন নেইমার ব্রাজিলের হয়ে প্লেমেকারের ভূমিকা পালন করলেও পিএসজিতে এ পজিশনে খেলেন মেসি। আবার আর্জেন্টিনায় মেসি একই পজিশনে খেলে ১০ নম্বর জার্সি পরলেও পিএসজিতে পরেন ৩০ নম্বর। রিয়াল মাদ্রিদ ও ক্রোয়েশিয়ার লুকা মদরিচের কথা বলা যায়। তিনি মিডফিল্ডার হলেও ১০ নম্বর জার্সি পরেন। আবার ১০ নম্বর জার্সি পরলেও সেরা খেলোয়াড় নন, এমন ব্যতিক্রম উদাহরণও আছে। স্পেনের মার্কো আসেনসিও, বার্সেলোনার আনসু ফাতি, রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে খেলেছেন হামেস রদ্রিগেজ, রবিনহো ও ব্রাজিলের কৌতিনহো অন্যতম।