অধরা মাধুর্য
লেখাটি ২০২৪ সালের জুনে প্রকাশিত বন্ধুসভা জাতীয় পরিচালনা পর্ষদের ‘তারুণ্য’ ম্যাগাজিনের দশম সংখ্যা থেকে নেওয়া।
তোমাকে দেখতে আমার ভীষণ ইচ্ছে করে। জানি না কোনো দিন দেখা হবে কি না। অনেক চেষ্টা করেছি দেখতে তোমায়। দেখা পাইনি কোনো দিন। তুমি সব সময় ছিলে আমার থেকে দূরে। যোজন যোজন মাইল দূরে। তোমাকে না পাওয়ার বেদনা কখনো ছিল না। এখনো নেই। তবুও ভেতর দেয়ালে কষ্টের আঁকিবুঁকিগুলো মাঝেমধ্যে উঁকি মারে। কেমন যেন একটা কষ্ট কষ্ট অনুভূতি হয়। আমি জানি এর কোন অর্থ নেই। তারপরও অর্থ খুঁজতে থাকি। বারংবার আবেগ আপ্লুত হই। চিন্তা করি। দৃশ্যকল্পে দেখি তোমার ছবি। সাদা ক্যানভাসে রংতুলি নিয়ে আঁচড় কাটি। মনের অজান্তে মূর্ত হয়ে ওঠো তুমি। জানি তুমি আমার হবে না কখনো। তুমি ছিলে ঊর্ধালোকে। তোমাকে ছোঁয়ার স্পর্ধা কোনো দিন করিনি। হৃদয়ের গহিনে অনুভূতিতে অনুভবে পরাবাস্তব স্বপ্ন এঁকেছে। ছুঁয়ে দেখার স্বপ্ন দেখেছে। তা পূরণ হয়নি কোনো কালে।
মানুষ উন্নত হলো। প্রযুক্তি এগিয়ে গেল। তৈরি হলো ফেসবুক, মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ, ইনস্টাগ্রাম—কত্ত কী! প্রযুক্তির বদৌলতে অন্তর্জালের মাধ্যমে পৃথিবীর মানুষ একে অন্যের কাছে আসতে শিখল। সেই সুবাদে আমিও খুঁজতে লাগলাম তোমাকে। অনেক খুঁজতে খুঁজতে হঠাৎ পেলাম। তোমার বন্ধু হতে চাইলাম। ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠালাম। তুমি এক্সেপ্ট করনি। তাই বন্ধু হতে পারিনি। এখন আমার সময় কেটে যায় তোমার ছবি দেখে দেখে। তোমার ছবি ডাউনলোড হতে হতে পূর্ণ হয়ে গেছে আমার অ্যালবাম।
আমি এক কবি। শুধু ভাবি আর ভাবি। তোমায় নিয়ে ভাবি। জানি না এই ভাবনা কোনো দিন সত্য হবে কি না।
প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে তোমার আইডিতে চোখ বুলাই। দেখি নতুন কোনো ছবি পোস্ট করেছ কি না। মাঝেমধ্যে কমেন্ট করি। সেই কমেন্টগুলোতে লাইক, কমেন্ট কিছুই দাও না তুমি। দীর্ঘদিন প্রতীক্ষায় থাকি। হঠাৎ একদিন আমার এক কমেন্টে লাইক রিঅ্যাকশন দিয়েছিলে। আমার বিশ্বাস হচ্ছিল না। অদ্ভুত এক ভালো লাগা কাজ করছিল। বোঝাতে পারব না তোমায়, হৃদয়ের নিভৃত ভালোবাসা। সে ভালোবাসার মহাসাগরে তুমি সাড়ে পাঁচশ কোটি বছর সাঁতার কাটলেও কূলকিনারা কিছুই খুঁজে পাবে না। পাবে শুধু ভালোবাসার সাত রং; যা তোমায় গোধূলি আবিরে রাঙাবে। তুমি হয়ে উঠবে কোনো উর্বশী রমণী।
এই ঘটনার ঠিক ছয় মাস তিন দিন পর তোমার পোস্ট করা একটি ছবিতে ছোট্ট কমেন্ট করেছিলাম। কমেন্ট করার ছাপ্পান্ন মিনিট এগারো সেকেন্ড পর তুমি একটা লাভ কেয়ার রিঅ্যাকশন দিয়েছিলে। যা সঙ্গে সঙ্গে স্ক্রিনশট নিয়ে খুব গোপনে সোনালি রাংতা কাগজে মুড়ে যত্ন করে রেখে দিয়েছি বেলজিয়ামের কাচের বয়ামে। লাভ কেয়ার রিঅ্যাকশন দেখে আমার হৃদয়ের অন্তঃপুরে শীতল কী যেন একটা চিনচিন করে নেমে যায়। মোচড় দিয়ে ওঠে নদীর মতো প্রবাহিত হওয়া হৃদ্বাঁক। অন্যরকম এক আবেশ আচ্ছন্ন করে আমায়। স্বপ্নাবিষ্ট মোহে চুয়াল্লিশ আলোকবর্ষ সময় ধরে সাঁতার কাটি আমি। যার রেশ এখনো থেকে থেকে টের পাই।
সেদিন ভালোবাসার খেতে এক লাখ লাল গোলাপ ফুটেছিল। এক অদ্ভুত অনুভূতি শিহরিত করেছিল আমাকে। আমি জানি না এর আগে এমনটি হয়েছে কি না কোনো দিন। প্রতিদিন একাধিকবার তোমায় দেখি। তোমার ছবিকে মডেল করে কবিতা লিখি। কবিতাগুলো তোমার মেসেঞ্জার নামক ডাকঘরে পোস্ট করি। একটি দুইটি তিনটি চারটি পাঁচটি ছয়টি নয়, অনেক কবিতা পোস্ট করি। একটিও তোমার হাতে গিয়ে পৌঁছে না। তুমি সিন করো না কোনো দিন। আমি প্রতিদিন মেসেঞ্জার চেক করি। মনটা কষ্টে ভরে যায়। তারপরেই আবার সান্ত্বনা দেই। কষ্টের কি আছে। তুমি কেন দেখবে? তুমি তো আমার বন্ধু না। তুমিতো আমাকে চেনো না। তুমি আমাকে জানো না। এখানে কষ্ট পাবার কিছু নেই। এই সব ভেবে ভেবে এক একটা দিন কেটে যায়। তুমি অধরা থেকে যাও। তুমি আমার অধরা মাধুর্য। সেই ছোট্টবেলা থেকে আমার বাম পকেটের নিচে হৃৎপিণ্ড নামক কৌটোয় খুব গোপনে, নিতান্ত যত্নে রেখে দিয়েছিলাম তোমাকে।
আমি তোমার অবয়বকে ভালোবাসিনি। ভালোবেসেছি তোমার প্রতিভাকে। তুমি ভালো গাইতে, নাচতে, আবৃত্তি করতে আর অভিনয় করতে। এসবই আমার খুব প্রিয় ছিল। এমন অনন্য প্রতিভা যখন তোমার ভেতর দেখেছি। দূর হতে দেখেছি। ইথারে ভেসে ভেসে দেখেছি। আর ভেবেছি কোনো দিন যদি তোমার দেখা পেতাম। তাহলে এই জীবনটা ধন্য মনে হতো। আর কোনো কিছুই আমার জানা নেই। আমি শুধু জানি ভালোবেসেছিলাম তোমাকে। বুদ্ধি হওয়ার পর থেকে। এখনো বাসি। তবে তা তুমি জানবে না কোনো কালে।
জানানোর মতো একটা লিংকআপ খুঁজে পেয়েছিলাম। তবে তাতে সাড়া দাওনি তুমি। এটাই স্বাভাবিক। একটি তৃণলতা কীভাবে বটবৃক্ষে স্থান পাবে? বলে সম্ভব? চুয়াল্লিশ বসন্ত কাটিয়ে দিয়েছি। এখনো কখনো কখনো মনের আবডালে, গাছের মগডালে, পাখির ডানা ঝাপটানোর মতো করে তুমি ঝাপটা মারো। আমি রক্তাক্ত হই। ডাক্তার দেখাতে পারি না। এ যে কোনো দিন ডাক্তার দেখাবার নয়। এ রোগ পৃথিবীর কোনো ওষুধে ভালো হওয়ার নয়।
আমার আজীবন ভালবাসা তোমার তরে। আমি জানি তোমার ঘর আছে। সংসার আছে। আছে সন্তান। তুমি শিক্ষকতা কর। কী পড়াও ছাত্রদের? আমি তোমার ছাত্র হতে চাই। তোমাকে পড়তে চাই। তুমি কি পড়তে দেবে? সেই আশা নিয়ে বেঁচে থাকব আজীবন। মৃত্যু হয়তো আমাকে কেড়ে নেবে। কিন্তু অন্তঃহৃদে তোমার জন্য মন তো নৌকা হয়ে ঘাটে বাঁধা থাকবে সারা জীবন।
সোনালি স্বপ্নটুকু জরিতে মুড়িয়ে রুপার কৌটায় আটকা থাক। ভেতর থেকে একটি কালো ভ্রমরও বের হতে পারবে না। কোনো কালে কোনো দিন। আমি ডালিম কুমার সেজে অনন্তকাল পাহারা দেব। তুমি ভালো থেকো অজানা বন্ধু আমার। তুমি ভালো থেকো না–জানা বন্ধু আমার। আমি তোমাকে চিনি। আমি তোমাকে জানি। আমি তোমাকে অনুসরণ করি। সেসবের কিছুই জানো না তুমি। জাননি কোনো কালে। জানবে না কোনো দিন। মহাকাশময় তারা ফুটবে। তারা ফুল হয়ে ছুটবে। লুটবে তোমার পায়ে। সেই একটা তারার কণা পরিমাণ আলো, যদি আমার হৃদয়ে জ্বলত, তাহলে আমি আমৃত্যু মৃত ফসিল হয়ে পড়ে থাকতাম তোমার জানালার কার্নিশে।
আমি এক কবি। শুধু ভাবি আর ভাবি। তোমায় নিয়ে ভাবি। জানি না এই ভাবনা কোনো দিন সত্য হবে কি না। প্রযুক্তির উত্তর-আধুনিক উন্নতির ছোঁয়ায় আমি কি পাব না তোমায়?