দিনটি ছিল বৃহস্পতিবার। কলেজ থেকে এসে গোসলে যাব, ঠিক তখনই ফোনটা হাতে নিয়ে দেখি আম্মুর নাম্বার থেকে অনেকগুলো কল। ফোন হাতে ধরে বসে অপেক্ষা করছি পরবর্তী কলের, এর মধ্যেই আবারও কল। কল ধরতেই ফোনের ওপাশ থেকে আম্মু বললেন, ‘আগামীকাল তোমার আব্বু যাবে তোমার হোস্টেলে। তোমার কী কী লাগবে?’ আব্বু আসবে শুনে আনন্দে মনটা নেচে উঠল। বললাম, ‘আম্মু, আমার কিছু লাগবে না৷ কাল কখন আসবে? আমার হোস্টেল চিনবে তো! আচ্ছা ঠিক আছে, আমি কিশোরগঞ্জ সিএনজি স্টেশনে গিয়ে রিসিভ করে নিয়ে আসব।’
‘তোমার আসতে হবে না। তোমার আব্বু চিনবে। আর তোমার জন্য তোমার পছন্দের ভরা পিঠা, পাটিসাপটা, গরুর মাংস আর মাছ রান্না করে দিয়ে দিব। নষ্ট যেন না হয়। রুমমেটদের নিয়ে মিলেমিশে খেয়ে নিয়ো।’
আমার বাঁধভাঙা আনন্দ দেখে কে! অতি উৎসাহিত হলে কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলি। আম্মুর সঙ্গে আর বেশিক্ষণ কথা বলতে পারলাম না। কল রেখে দিলাম।
তখন এইচএসসি দ্বিতীয় বর্ষে পড়ি। আম্মু-আব্বুকে ছাড়া প্রথম অনেক দিন বাড়ি থেকে দূরে থাকা। সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষা, ক্লাস টেস্ট, প্রাইভেট—সব মিলিয়ে অনেকদিন যাবৎ বাড়িতে যাওয়া হচ্ছে না। এরইমধ্যে হঠাৎ করে আব্বু হোস্টেলে আসবে আমাকে দেখতে। উনি আসবে শুনে রুমমেটদেরও সীমাহীন আনন্দ। সবাই রুম গোছানোর কাছে ব্যস্ত হয়ে গেলাম। রুম ধুয়ে-মুছে, ঝাড়ু দিয়ে একদম পরিষ্কার করলাম। এটা মেস এবং হোস্টেলের স্বাভাবিক নিয়ম। রুমমেটের বাড়ি থেকে কেউ আসবে শুনলে সবাই মিলে মহা আনন্দ-উল্লাসে রুম পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজগুলো দায়িত্ব সহকারে করে।
অজপাড়া গাঁয়ে বেড়ে ওঠা আমাদের কখনো বাবাদের জন্য অপেক্ষার কথা বলা যায় না, ভালোবাসি বলা হয়ে ওঠে না।
চোখে সারারাত ঘুম নেই, কখন ফজরের আজান দেবে! কখন সূর্য উঠবে! এভাবে রাত কেটে গেল আব্বু আসার অপেক্ষায়। দীর্ঘ অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে সকাল হলো। মনে হলো বছরের সবচেয়ে দীর্ঘতম রাতের শেষে সকাল দেখলাম। সকাল হতেই তৈরি হয়ে বেরিয়ে পড়লাম আব্বুকে রিসিভ করে আনতে। স্টেশনে বসে আছি। একটু পরপর গাড়ি আসে আর তাকিয়ে থাকি। দৌড়ে যাই গাড়ির কাছে। কিন্তু আব্বু একটাতেও নেই। হঠাৎ দেখি আব্বু সিএনজি থেকে নেমে দাঁড়িয়ে রিকশা খুঁজছেন। আমাকে দেখেই একটা হাসি দিলেন। দৌড়ে কাছে গেলাম, কিন্তু কিছু বলতে পারলাম না। সারা রাত অপেক্ষায় ছিলাম, অথচ অপেক্ষায় যে ছিলাম এইটুকুও বলতে পারছি না। অজপাড়া গাঁয়ে বেড়ে ওঠা আমাদের কখনো বাবাদের জন্য অপেক্ষার কথা বলা যায় না, ভালোবাসি বলা হয়ে ওঠে না। সারা জীবন বাবাদের কাঁধে ভর করে চলি; অথচ কখনো বাবাদের কাঁধে হাত রেখে বলতে পারি না, ‘অনেক তো হয়েছে বাবা, এবার থামো! আমি আছি তো, তুমি এবার বিশ্রাম করো।’
রাতে সবাই একসঙ্গে খেতে বসছি। আম্মুর রান্না করে দেওয়া খাবার খাচ্ছি। কিন্তু আব্বু খাচ্ছে না, সে হোস্টেলের মিলের খাবার খাচ্ছে। জোড়াজুড়ি করেও এক টুকরো মাংস পাতে তুলে দিতে পারিনি। আব্বু হয়তো অনুধাবন করতে চায়, হোস্টেলে পানির মতো ডাল আর মোটা চালের ভাত খেয়ে কীভাবে আমরা বেঁচে থাকি।
ভোরে আব্বু চলে যাবে। ছুটি নেই, তাই যেতে হবে। আব্বুকে বিদায় দেওয়ার জন্য একসঙ্গে বের হয়ে হোস্টেলের সামনে আসলাম। গাড়ির জন্য দাঁড়িয়ে আছি। আব্বুকে বলতে চেয়েও বলতে পারছি না, ‘আব্বু আর কিছুক্ষণ থেকে যাও।’
বন্ধু, কিশোরগঞ্জ বন্ধুসভা