দুটো ঘটনা যেখানে একই সূত্রে গাঁথা

অনুশীলনে কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহের সঙ্গে পরামর্শ করছেন সাকিবছবি: শামসুল হক

ফিরে যাই ২০১৪ সালে। একের পর এক পরাজয়ে জর্জরিত বাংলাদেশ ক্রিকেট দল। অভিজ্ঞ মাশরাফি বিন মুর্তজার কাঁধে অধিনায়কের দায়িত্ব তুলে দেয় বিসিবি। ধীরে ধীরে দলটাকে তিনি ঘুচিয়ে আনেন। পরের বছর অস্ট্রেলিয়ায় অনুষ্ঠেয় ওয়ানডে বিশ্বকাপে শক্তিশালী ইংল্যান্ডকে হারিয়ে প্রথমবারের মতো কোয়ার্টার ফাইনালে জায়গা করে নেওয়া। সেখান থেকে দেশে ফিরে ঘরের মাঠে একে একে পাকিস্তান, ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে প্রথমবারের মতো ওয়ানডে সিরিজ জয়। এর মধ্যে পাকিস্তান হয় ধবলধোলাইয়ের শিকার!

যখন মাশরাফি ছিলেন অধিনায়ক, হাথুরুসিংহে কোচ
ফাইল ছবি

এর পর থেকে ৫০ ওভারের ক্রিকেটে বাংলাদেশকে সমীহ করতে শুরু করে ক্রিকেট বিশ্ব। নড়াইল এক্সপ্রেসের নেতৃত্বে দলটি সেরাদের সেরা হয়ে উঠতে না পারলেও ভালো খেলার ধারাবাহিকতা বজায় রাখে। ২০১৭ আইসিসি চ্যাম্পিয়নস ট্রফির সেমিফাইনাল এবং ২০১৯ বিশ্বকাপে দক্ষিণ আফ্রিকা ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের মতো দলকে হারানো যার বড় উদাহরণ। পরবর্তী সময়ে মাশরাফি সরে গেলে নেতৃত্ব যায় তামিম ইকবালের কাঁধে। তবে দলের পারফরম্যান্সে এর কোনো প্রভাব পড়েনি। ২০২২ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে তাদেরই মাটিতে সিরিজ জয়, ওয়ানডে ফরম্যাটে বাংলাদেশকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছে।

এবার ফিরে আসি বর্তমানে। গতকাল টি-টোয়েন্টি সিরিজে বেশ দাপটের সঙ্গে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ডকে ৩-০ ব্যবধানে হোয়াইটওয়াশ করেছে বাংলাদেশ। যারা ক্রিকেটের নিয়মিত খোঁজখবর রাখেন, তাঁরা কেউই এমন ফল আশা করেননি। কেউ কেউ হয়তো সর্বোচ্চ আশা করেছিল, একটি ম্যাচ জিততে পারে টাইগাররা। সাধারণের কথা বাদ দিলাম। দলের অধিনায়ক সাকিব আল হাসানও সিরিজ শুরুর আগে ম্যাচ জয়ের আশা শতভাগ করেননি। এ নিয়ে আলাদা কোনো পরিকল্পনাও ছিল না। গতকাল ম্যাচ শেষে মিস্টার অলরাউন্ডার বলেন, ‘সিরিজ শুরুর আগে কেউ চিন্তাও করিনি, ম্যাচ জিততে হবে বা কিছু। ভালো ক্রিকেট খেলতে চেয়েছি। তিন ম্যাচেই চেষ্টা করেছি ব্যাটিং–বোলিংয়ে যার যার জায়গা থেকে যতটা সম্ভব অবদান রাখার।’

২০২২ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে বাংলাদেশের সাফল্যের অন্যতম নায়ক তাসকিন আহমেদ
ছবি: শামসুল হক

একটি বিষয় এখানে বলতে হবে। হঠাৎ করে এই ফরম্যাটে টাইগাররা ভালো খেলেছে, বিষয়টি এমন নয়। ২০ ওভারের ক্রিকেটে বাংলাদেশ কখনো ভালো দল ছিল না। বিগত বছরগুলোতে পারফরম্যান্সের ধাপ ক্রমশ নিম্নমুখী হচ্ছিল। সেটি থেকে দলকে উদ্ধারে ২০২২ সালের এশিয়া কাপের সপ্তাহ দুই আগে মাহমুদউল্লাহ রিয়াদকে সরিয়ে সাকিব আল হাসানের কাঁধে অধিনায়কের দায়িত্ব তুলে দেয় বিসিবি। সে সময় সাকিব বলেছিলেন, দলের ওপর বেশি আশা না করতে এবং সময় দিতে। তিনি সবকিছু শূন্য থেকে শুরু করতে চান।

বিশ্বসেরা অলরাউন্ডারের প্রথম অ্যাসাইনমেন্ট ছিল সংযুক্ত আরব আমিরাতে অনুষ্ঠেয় এশিয়া কাপ। সেখানে একটি ম্যাচও জিততে পারেনি টাইগাররা। তবে লড়াই করেছে। এরপর নিউজিল্যান্ডে ত্রিদেশীয় সিরিজেও সব ম্যাচে পরাজয়। সেখান থেকে অস্ট্রেলিয়া বিশ্বকাপে অংশ নেওয়া। তবে সাকিব আশা হারাননি। নিজের ও দলের প্রস্তুতিতে বিশ্বাস রাখেন। ফলও মিলেছে হাতেনাতে। জিম্বাবুয়ে এবং নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে জয়। ভারতের বিপক্ষে জিততে জিততে হেরে যাওয়া। যেখানে ২০ ওভারের ফরম্যাটের বিশ্বকাপের মূল পর্বে আগের আসরগুলোতে বাংলাদেশের কোনো জয় নেই (২০০৭ সালে প্রথম আসরে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে জয় এত দিন একমাত্র ছিল), সেখানে এই ফল নিশ্চিতভাবে আশাজাগানিয়া। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ইতিহাসে নিজেদের সেরা আসর বলা যায়। তাই তো সেমিফাইনালে উঠতে না পারলেও হতাশ হননি অধিনায়ক সাকিব আল হাসান। বলেছিলেন বিশ্বাস রাখতে, দল সঠিক পথেই আছে।

বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান ও অন্যান্য অতিথিদের কাছ থেকে সিরিজ জয়ের ট্রফি বুঝে নিচ্ছেন বাংলাদেশ অধিনায়ক সাকিব আল হাসান
ছবি: শামসুল হক

ইংল্যান্ডকে হোয়াইটওয়াশ করা যেন সেই বিশ্বাসের বহিঃপ্রকাশ। দলকে নতুনভাবে সাজানো, সবার মধ্যে আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনা, নিজে ব্যাট-বল হাতে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেওয়া! সবকিছু যেন সাকিবের পরিকল্পনার অংশ। শূন্য থেকে শুরু করে ধাপে ধাপে ওপরে ওঠা। এমনি এমনি তো আর মাশরাফি বলেন না ‘ক্রিকেট মস্তিষ্কের দিক দিয়ে সাকিব অনন্য।’ সতীর্থ, বিসিবি কর্তাব্যক্তি থেকে শুরু করে সাবেক ক্রিকেটাররাও প্রায় সময় একই কথা বলে থাকেন।

দুটো ঘটনাকে এবার একই সূত্রে গাঁথার চেষ্টা করুন। দল পরাজয়ের বৃত্তে আবদ্ধ, পুরোনো নেতৃত্ব সরিয়ে সবচেয়ে অভিজ্ঞ ক্রিকেটারের হাতে দায়িত্বভার তুলে দেওয়া, বিশ্বকাপে নিজেদের জানান দেওয়া এবং পরবর্তী সময়ে শক্তিশালী দলকে দাপটের সঙ্গে হারানো। পরে মাশরাফির নেতৃত্বে টাইগাররা বিশ্বের অন্যতম সেরা ওয়ানডে দলে পরিণত হয়েছে। এখন সাকিবের নেতৃত্বে বাংলাদেশ টি-টোয়েন্টির অন্যতম সেরা দলে পরিণত হতে পারবে কি না, তা সময় বলে দেবে। তবে দলের প্রস্তুতি ও পরিকল্পনা যেভাবে আগাচ্ছে, তাতে আশাবাদী হওয়া যায়।

ট্রফি নিয়ে উদ্‌যাপনের সময় কোচ হাথুরুসিংহের সঙ্গে সাকিব। দুজনের জুটি জমলে বাংলাদেশের লাভ!
ছবি: শামসুল হক

আরও একটি মিল রয়েছে। মাশরাফির সময়ে কোচ ছিলেন চন্ডিকা হাথুরুসিংহে। লঙ্কান এই কোচ আবারও লিটন-মোস্তাফিজদের বস হয়ে এসেছেন। প্রথম সিরিজ শেষে মনে হচ্ছে, সাকিবের সঙ্গে তাঁর জুটি দারুণ জমবে। আর সেটা হলে যে বাংলাদেশেরই লাভ!