চার বন্ধুর বিপ্লবের রোমাঞ্চকর আখ্যান ‘গর্ভধারিণী’

সমরেশ মজুমদারের উপন্যাস ‘গর্ভধারিণী’

কথাসাহিত্যিক সমরেশ মজুমদারের এক দুঃসাহসিক ও অভিনব বিষয়বস্তুর সমন্বয়ে সামাজিক ও মানবিক মূল্যবোধ নিয়ে উপন্যাস ‘গর্ভধারিণী’। অসম অর্থনৈতিক কাঠামোয় বড় হয়ে ওঠা চার বন্ধু, তাদের মধ্যে একজন নারী। একসময় উপলব্ধি করল, অদ্ভুত এক আঁধার নেমে এসেছে এ দেশে। কারও যেন নিজস্ব কোনো দায় নেই। দেশটার ভালো-মন্দের ইজারা রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর ছেড়ে দিয়ে অধিকাংশ মানুষ ঘরের নিরাপদ কোণ খুঁজছে। এই ক্লৈব্যের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে চেয়েছে ওই চারজন যুবক-যুবতী। ২০২৪ সালের জুলাইয়ে ইন্টারনেট সংযোগ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার সময়গুলোতে ওদের বিপ্লবের কল্পকাহিনি যখন পড়েছি, তখন এ দেশেও বিপ্লব চলছে। উপন্যাসটিতে সে সময়কার ভারতে নকশালপন্থীদের বিপ্লব, কর্মকাণ্ড ও ফলাফল, অর্থাৎ সার্বিক অবস্থা সম্পর্কে গল্পাকারে পরোক্ষভাবে হলেও কিছুটা ধারণা পাওয়া যায়।

প্রথমে প্যারাডাইস নামে এক প্রমোদখানায় অভিযান দিয়ে শুরু হয় তাদের বৈপ্লবিক তাণ্ডব, যেখানে উচ্চবিত্ত সমাজের মানুষ আনন্দ উপভোগের নামে অসামাজিক কার্যকলাপ করত। প্রথম অভিযান সফল হওয়ায় তাদের আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায়। দ্বিতীয় অভিযান ছিল একটি ভেজাল ওষুধের কারখানায়। তারা সেই কারখানা বোমা মেরে উড়িয়ে দেয়। তৃতীয় এবং সর্বশেষ যে অভিযান ছিল, একজন মন্ত্রী ও ক্ষমতাভিত্তিক শীর্ষ এক অপরাধীকে গুলি করে হত্যা করা। তারা মূলত চেয়েছিল সমাজের ভিত নাড়া দিতে। তৃণমূল পর্যায়ে মানুষের মধ্যে গণজাগরণ সৃষ্টি করতে।

যাহোক, এই বিপ্লবের পরিণামে তাদের আত্মগোপন করতে হয়েছে হিমালয়ের কোণে ভারত-নেপাল সীমান্তের এক পাহাড়ি গ্রামে, যেখানে সভ্যতার আলো এখনো পৌঁছায়নি।

পদে পদে নানা প্রতিকূলতায় যখন তারা জর্জরিত, ঠিক তখনই মাথায় একটা আইডিয়া আসে। তারা সাম্যবাদী যে সমাজের স্বপ্ন দেখছে, তা হিমালয়ের পাদদেশে সভ্যতা থেকে দূরে থাকা এই গ্রামে প্রতিষ্ঠা করলে কেমন হয়? শুরু হয় নতুন পরিকল্পনা, নতুন উদ্যম। ঝুঁকি যে ছিল না তা নয়, সমূহ বিপদের আশঙ্কা নিয়েই তাদের অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকে। এরই মধ্যে ওষুধ আনতে শিলিগুড়ি গিয়ে পুলিশের গুলিতে প্রাণ দিতে হয় তাদের একজনকে। তবে মৃত্যুর আগমুহূর্তে সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করে সে।

একের পর এক রোমাঞ্চকর ঘটনাবলির মধ্য দিয়ে পাঠ এগিয়ে গেলেও বইটির নামকরণের হেতু খুঁজে ফিরছিলাম বারবার, যা উপন্যাসটির একেবারে শেষ মুহূর্তে গিয়ে মূর্ত হয়ে ধরা দিয়েছে। এই দলের একমাত্র নারী সদস্যের বিচিত্র আত্মত্যাগ ও সাধনাই যেন নামকরণের সার্থকতা এনে দিয়েছে।

ভালো লেগেছে এমন উল্লেখযোগ্য কিছু লাইন—
একজন মনের মতো স্বামী পাওয়ার জন্য মেয়েদের কেন বড় হতে হবে?
উত্তরপুরুষের কাছে যদি পূর্বপুরুষ কৈফিয়ত চাইতে পারে, তাহলে উত্তরপুরুষেরও অধিকার আছে পূর্বপুরুষকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর।
নোন ডেভিল ইজ বেটার দ্যান আননোন।
কখন যে ভালোবাসা বোঝা হয়ে দাঁড়ায়, তা–ই বোঝা যায় না বলেই গ্লানিবোধ বড় অনুভূত হয় না।
আমরা যেসব মানুষকে বাইরের জীবনে নিয়মিত দেখে থাকি, যাদের সঙ্গে বন্ধু হয়ে অথবা কর্মসূত্রে মিশি, তাদের একটাই চেহারা আমাদের কাছে ধরা পড়ে। তারা যখন নিজের শোবার ঘরে ফিরে যায়, তখন তাদের আচরণ সম্পর্কে আমাদের কোনো ধারণাই থাকে না।
একটা যন্ত্রণা, সেটা ঠিক কী কারণে তা সে জানে না, নিশ্বাস ভারী করে তুলেছিল। কোনো নির্দিষ্ট মানুষের জন্য নয়, এমনকি নিজের জন্যও নয়, অদ্ভুত শূন্যতা যে কতখানি ভারী হয়ে যন্ত্রণা ছড়ায়, তা এর আগে সে কখনোই টের পায়নি।
অতি কুখ্যাত খুনি যখন নিজে খুন হয়ে যায়, তখন মানুষ তার প্রতি সহানুভূতি দেখায়। মৃতরা চিরকালই নিরীহ।
আমাদের অধিক সমস্যা বলতে না পারার জন্য তা বেড়ে তীব্র ও ক্ষতির কারণ হয়ে থাকে। কিন্তু একবার বলতে পারলে সেটার আর কোনো ওজন থাকে না।
একজন মানুষ জীবনে সবকিছু পেতে পারে তার ক্ষমতা দিয়ে, চেষ্টা দিয়ে; কিন্তু একটু স্নেহ না পেলে তার বড় জিনিস হারিয়ে যায়।
একজন মানুষ পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলে কোনো কিছুই আটকে থাকে না। কেউ একুশ বছর বয়সে পুলিশের গুলিতে মারা যায়, কেউ সত্তরে রোগে মারা পড়ে। যদ্দিন প্রাণ তদ্দিন সব চোখের সামনে, যেই শরীরটা গেল অমনি অস্তিত্বের বিলোপ। কারও কারও স্মৃতি কিছু বছর, কয়েক বছর অথবা শতাব্দীকাল মনে রাখে মানুষ। কিন্তু বেশির ভাগ মানুষকে তিন মাসেই বিস্মৃত হয় মানুষ, যারা থেকে গেল।
যেকোনো কাজ শুরু হয় কারও উদ্যম থেকেই। সেই উদ্যম যদি সে অন্যের মনে সঞ্চারিত করতে পারে জীবিত কিংবা মৃত অবস্থায়, তাহলেই সে সফল।

বন্ধু, কুড়িগ্রাম বন্ধুসভা