বাবাকে লেখা খোলাচিঠি

চিঠির বাক্স। ছবিটি প্রতীকীছবি: রবিউন নাহার তমা

প্রিয় বাবা,

গোধূলির অপস্রিয়মাণ লাল আলোর শুভেচ্ছা তোমায়। জানো বাবা, অনেক দিন গোধূলি দেখিনি। তোমার ঠিকানা তো এখন আকাশ। ছোট ঠিকানার গণ্ডিতে তোমাকে আর ধরে রাখা গেল না। আকাশে তো নির্দিষ্ট কোনো পোস্ট কোড নেই। তুমি পাবে তো এই চিঠি!

চারপাশের সবকিছু হুট করে বদলে গেল। আগে তোমাকে চাইলেই হোয়াটসঅ্যাপে টেক্সট করতে পারতাম কিংবা মেসেঞ্জারে অথবা একটা কল দিতে পারতাম। তুমি এখন দূর আকাশের তারা। চাইলেই তোমাকে ছোঁয়া যায় না, তোমার সঙ্গে মনের কথা বলা যায় না। তুমি হঠাৎই সহস্রযোজন দূরে চলে গেলে, বাবা। খুব কি তাড়া ছিল যাওয়ার!

তুমি আর আমি প্রায়ই দাদুর চলে যাওয়া নিয়ে কথা বলতাম। তুমি বলতে, মৃত্যু মানুষকে হঠাৎ বড় করে দেয়। আমি এ রকম কিছুর সাক্ষী আগে কখনো হইনি। আর যেন কখনো না হই। তুমি আমার হাতে হাত ধরা অবস্থায় চলে গেলে। শক্ত করে ধরা হাতের মুঠোটা ধীরে ধীরে আলগা হয়ে গেল। সঙ্গে আমার মাথার ওপরের ছাতাও চিরদিনের মতো ওড়ে গেল। হাতে পড়ে রইল ছাতার শূন্য কাঠামোমাত্র।

আমি কান্না করতে পারিনি, বাবা। পাছে আইসিইউতে থাকা অন্য রোগীর সমস্যা হয়। কান্না করতে পারিনি, কারণ মাকে যদি না সামলানো যায়। কাঁদিনি, কারণ তোমার মা, দিদিভাই আর সোনাকে কে সান্ত্বনা দেবে! আমি কান্না করতে পারিনি যেন কাকু তাঁর ভাইয়ের মৃত্যুশোকে মূর্ছা না যান।

কিন্তু আমিও রক্তমাংসের মানুষ, বাবা। সবাই কাঁদল আর আমি শূন্যদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলাম। তোমাকে তোমার প্রিয় কর্মস্থলে নেওয়া হলো, হাজারো মানুষ কাঁদল, কাঁদতে পারলাম না আমি। তোমার শূন্য চেয়ারটা ধরে অদৃশ্য তোমার পায়ের কাছে বসে ছিলাম অনেকটা সময়। পরে শুনেছি, তোমার চেয়ারটা ওরা আলাদা করে রেখে দিয়েছে। আর কাউকে নাকি ওই চেয়ারে বসতে দেওয়া হবে না। তোমার জলের মগ, চায়ের কাপ, ফাইল, কলম, পেপার ওয়েট—সবই আগের মতো আছে। শুধু তুমি নেই। তোমার ডেস্কের পেছনে, তোমার প্রিয় দক্ষিণের জানালা দিয়ে সেদিনও আগের মতোই হাওয়া দিচ্ছিল। শুধু সেই হাওয়া অনুভব করার জন্য তুমি ছিলে না।

তোমাকে নিজের হাতে চিতায় তুললাম। নিজের হাতে মুখাগ্নি করলাম। যে প্রিয় মুখের প্রতিটা কথা ছিল আমার কাছে বেদবাক্য, সেই মুখেই আগুন দিলাম। চোখের সামনে ভস্ম হয়ে গেল আমার এত দিনের আশ্রয়স্থল, সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু। দেখলাম, চিতার আগুন একটা গোটা মানুষকে কীভাবে গ্রাস করে নেয়।

সব কাজ শেষ করে কর্তব্যের খাতিরে ঢাকায় ফিরেছি এ মাসের ২২ তারিখ। ২৩ তারিখ থেকে অফিস করছি। অফিসে বসে চোখ ভিজে যাচ্ছে, কি-বোর্ডের ওপর জমে থাকা ধুলা কাদা হয়ে যাচ্ছে। তবু আমার শোক করার জন্য আলাদা করে সময় বা সুযোগ নেই। ঘরে মা আছে, তাই মায়ের সামনে চোখের জল লুকিয়ে রাখতেই হয়। কাঁদতে পারলে আমার হালকা লাগত। কিন্তু আমি পারছি না, বাবা। গলার কাছে দলা পাকিয়ে আছে। ভীষণ চিৎকার করে কাঁদতে পারলে বোধ হয় এই দলা পাকানো ভাবটা দূর হতো।

সবাই সান্ত্বনা দিচ্ছে, একদিন সবাইকে চলে যেতে হবে। কিন্তু যার যায়, সেই তো বোঝে, কী রত্ন হারাল। এই যে অফিস থেকে ফেরার পথে লম্বা রাস্তা, যেতে ঘণ্টাদেড়েক লাগে; পুরোটা সময় তোমার সঙ্গে ফোনে কথা বলতাম। আমাদের কথা বলার আলাদা কোনো টপিকের দরকার হয়নি কখনো। তুমি চলে যাওয়ার পর আমি প্রয়োজন ছাড়া কারও সঙ্গে একটা শব্দও উচ্চারণ করিনি। এমন না যে চাইছি না, কিন্তু আমি পারছি না। তাই আজ তোমাকে লিখতে বসেছি। যদি নিজেকে একটু হালকা করতে পারি।

ওপারে ভীষণ ভালো থেকো, বাবা। আর আমাদের জন্য প্রতীক্ষায় থেকো। আবার একদিন চাঁদের হাট বসবে সবাইকে নিয়ে।

ইতি,
তোমার সন্তান

২৮ মে, ২০২৪,
ঢাকা।