পরীমনি যখন ‘মহুয়া সুন্দরী’

পরীমনিছবি: কবির হোসেন

রওশন আরা নীপার ‘মহুয়া সুন্দরী’ একটি গবেষণাধর্মী পরীক্ষামূলক কাজ। মৈয়মনসিংহ গীতিকায় দ্বিজ কানাই রচিত সবচেয়ে জনপ্রিয় উপাখ্যান ‘মহুয়া পালা’র ভাবাদর্শ অবলম্বনে নীপা চলচ্চিত্রের কাহিনি, চিত্রনাট্য সাজিয়েছেন। আবহমানকালের বাংলা সংস্কৃতির চিরন্তন প্রণয়গাথার ভিতের ওপর আধুনিক সমসাময়িক দৃষ্টিভঙ্গিতে এ এক নতুন নির্মাণ। ভালো হোক, মন্দ হোক এ ধরনের মৌলিক গবেষণামূলক কাজ যত হবে, লোকসংস্কৃতির মাটির কাছাকাছি শিকড়ের সন্ধানে আমরা বারবার ফিরে যেতে পারব।

নীপার কাজে বেশ কিছুটা ত্রুটি আছে। চিত্রনাট্য, পরিচালনায় দুর্বলতা আছে। যাত্রাপালা, লোকসংস্কৃতি আমাদের গ্রামবাংলার প্রাণ। দেশে-বিদেশে যে যেখানেই থাকুক, শহুরে বাঙালির মধ্যেও আবেগের সঞ্চার করে। নীপার কাজে সেই খাঁটি বিশুদ্ধ আবেগ সঞ্চারের জায়গাগুলো সেভাবে পেলাম না। সুযোগ কিন্তু ছিল। তবে কাহিনির বুনন, কিছু কিছু দৃশ্যকল্প নির্মাণ, চলচ্চিত্রায়ণ বেশ ভালো লেগেছে। বিশেষ করে যাত্রাদলের মহুয়া সুন্দরী ছবিরানী মানে পরীমনিকে যত সুন্দর করে ব্যবহার করা যায়, আখ্যানের মহুয়ার সঙ্গে বাস্তবের মহুয়ার মিল, খোঁপায় গোঁজা লাল হলুদ গোলাপের সৌন্দর্য, আলতারাঙা চরণ, বাংলার নদী, মাঠ-ঘাটের কোমল বরণ, কমলালেবুর মতো তুলিতে আঁকা ঠোঁট, পায়ে নূপুর ঝন ঝন, নিপুণ মুদ্রায় শরীর দোলানো যাত্রা সুন্দরীর গড়ন, সর্বোপরি রোদের রেণুর মতো মধুর হাসি, চাপা মেঘের মতো অন্তর্জ্বালা, নিঠুর বিরহ বেদনার দহন, বড় শিল্পীর আঁকা ছবির মতো ছবিরানীর মধ্যে দিয়ে নীপা বের করে আনার চেষ্টা করে গেছেন।

শিল্পীর কাজই হলো পাথরের মতো বারবার নিজেকে ভেঙে নতুন ভাবমূর্তি তৈরি করা।

পরীমনিও নিজের শতভাগ উজাড় করে দিয়েছেন। এককথায় বলা যেতে পারে, এই চলচ্চিত্রটি পরীমনির চলচ্চিত্র। পরীমনির জীবনের একটা মাইলফলক। পরীমনিকে দিয়ে বাংলাদেশের ভিন্নধারার গবেষক–পরিচালকেরা যদি এ ধরনের কাজ আরও একটু বেশি করিয়ে নিতে পারতেন, শিল্পীসত্তা দিনে দিনে প্রকাশিত, বিকশিত হতো। একধরনের বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রে দর্শকমনে পরীমনির যে ধরনের ইমেজ তৈরি হয়ে গেছে, তা ভেঙে যেত। শিল্পীর কাজই হলো পাথরের মতো বারবার নিজেকে ভেঙে নতুন ভাবমূর্তি তৈরি করা।

নীলা চৌধুরী, তীর্থ ভট্টাচার্যের কণ্ঠে দ্বিজ কানাই রচিত ‘জল ভরো সুধরি কইন্যা গো...’ এবং লালন ফকিরের ‘আমারে ফিরাবে গুরু...’ এই দুটি গানের চিত্রায়ণেও পরীমনিকে অসাধারণ লেগেছে। যাত্রাদলের নায়িকা ছবিরানীর প্রেমে মজেছিল গ্রামের প্রভাবশালী মিয়ার ব্যাটা, বিদেশফেরত সুশিক্ষিত লোকসংস্কৃতি গবেষক জীবন। সমাজের প্রভাবশালী মানুষের কাছে যাত্রা দু–চার পয়সার বিষয় এবং যাত্রাদলের নাচনেওয়ালি সহজ ভোগ্য-উপভোগ্য নারী শরীর হলেও সুন্দরের প্রকৃত পূজারি গবেষক জীবনের কাছে যাত্রা শক্তিশালী একটি মাধ্যম। ছবিরানীর মধ্যে অনেক বড়মাপের একজন শিল্পীকে খুঁজে পেয়েছে জীবন। বিদেশে এ ধরনের শিল্পীর অনেক কদর। একজন সুশিক্ষিত লোকসংস্কৃতি গবেষক এবং স্বশিক্ষিত যাত্রাদলের শিল্পী দুজনের পারস্পরিক শ্রদ্ধা আর হৃদয়ের গভীরে মর্যাদাপূর্ণ প্রেম, এমন মিলন আমাদের ঐতিহ্য সংস্কৃতির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সামাজিক কূটরাজনীতি এবং প্রভাবশালীর মিয়ার বিত্ত অহংকার তা ঘটতে দিল না। যাত্রাদলের কান্ডারি হারেস মিয়াকে রাতের অন্ধকারে দলবল নিয়ে তাঁবু গুটিয়ে গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে হলো। চলে যাওয়ার সময় সুবীর নন্দীর দরদি কণ্ঠে তাপস চৌধুরীর লেখা ‘তোমারে ছাড়িতে বন্ধু’ গানটি, প্রাণপ্রিয়াকে ছেড়ে যাওয়া ছবিরানীর বেদনাবিধুর যন্ত্রণাজাত অশ্রুর অনবদ্য ভাষ্য রূপায়ণে ব্যবহার করা হয়েছে।

মহুয়া সুন্দরী ছবিতে পরীমনি

মহুয়া পালায় অভিনয় করতে করতে ছবিরানী মহুয়ার যন্ত্রণার সঙ্গে নিজের যন্ত্রণার মিল খুঁজে পায়। মহুয়া যার প্রেমে পড়ে ঘর ছাড়তে চায়, আজকের সেই নদের চাঁদ হলো জীবন। আর এই প্রেমের পথের কাঁটা হুমরা বেদে অনেক। যাত্রাদলের প্রধান হারেস মিয়াও হুমরা, জীবনের বাবাও হুমরা। ছবির শরীর ভোগ করতে চায় যারা, ছবির মনের কথা বোঝে না, সবাই প্রেমের পথে কাঁটা। এসব কিছু থেকে মুক্তির উপায় মহুয়া পালার শেষ দৃশ্যের সঙ্গে যাত্রার ছবিরানীর অন্তিম পরিণতি। সত্যিকারের বিষলক্ষা ছুরি দিয়ে নিজেকে বিদীর্ণ করে, নিজেকে হত্যা করে মুক্তি। এই ঘাতক সমাজের সবার চোখের সামনে একজন শিল্পীর আত্মহনন।

যাত্রাদলে শিল্পীদের ঘরে সাধক রামকৃষ্ণের একটা ছবি ছিল। রামকৃষ্ণ বলতেন, থ্যাটার লোকশিক্ষা দেয়। গিরিশ ঘোষের নাটক দেখতে যেতেন রামকৃষ্ণ। বিনোদিনী দাসী সমাজের সবার চোখে ছিল শুধু একজন নগরনটী। রামকৃষ্ণ সেই নটীর মধ্যেও প্রকৃত মানুষের সন্ধান পেয়েছিলেন। সাধকের সংস্পর্শে শিল্পীর মুক্তি ঘটেছে। যাত্রাদলের প্রধান হারেস মিয়া নাম শুনলে হয়তো মনে হতে পারে তিনি মুসলিম। কিন্তু শিল্পীর কোনো ধর্ম হয় না। ঘরে রামকৃষ্ণের ছবি বাংলাদেশের গ্রামগঞ্জের শিল্পীদের সেই অসাম্প্রদায়িক মনোভাবের বার্তা দেয়।

হারেস মিয়া চরিত্রে মামুনুর রশীদ সুন্দর অভিনয় করেছেন। জ্যোৎস্না মাসি চরিত্রে সুচরিতা, জীবন চরিত্রে সুমিত সেনগুপ্ত বেশ ভালো। যাত্রাদলের মঞ্চাভিনয়, যাত্রাদলের আবহ সুর ছবির ভেতর ছবি হয়ে প্রাণের আরাম এনে দেয়। নীপার মতো পরিচালকদের এ ধরনের গবেষণাধারা নিরন্তর প্রবাহিত হোক। বাঙালিকে আরও আবেগতাড়িত করার মতো ক্ষমতা নিশ্চয়ই ধীরে ধীরে অর্জিত হবে। পরীমনির মতো শিল্পীদের যাত্রাপথও শিল্পোত্তীর্ণ হবে।

হাওড়া, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত