অসময়ী বন্ধুর লুকোচুরি

ঔপন্যাসিক সেলিনা হোসেনের (মাঝে) বাঁ পাশে আলাউদ্দিন খোকন, ডানে লেখক
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

মাঝেমধ্যে মনে হয় জীবন প্রজাপতির মতো, আবার মনে হয় সমুদ্রের পানে উড়ে যাওয়া পরিযায়ী পাখির মতো—এই এল বুঝি, এই গেল। এ জন্যই বোধ হয় শেক্‌সপিয়ার বলেছিলেন, ‘কাউকে সারা জীবন কাছে পেতে চাও? তাহলে প্রেম দিয়ে নয়, বন্ধুত্ব দিয়ে আগলে রাখো। প্রেম একদিন হারিয়ে যাবে, কিন্তু বন্ধুত্ব কোনো দিন হারায় না।’

আমাদের বন্ধুত্বের বয়স দুই যুগ। ১৯৯৯ সালের দিকে লুসাই ভবনে আলাউদ্দিন খোকনের সঙ্গে পরিচয়। সে ছোট একটি কক্ষে থাকত শহীদ জননী রমা চৌধুরীর সঙ্গে। তাঁদের দুজনের সঙ্গী ছিল বই আর পোষা শুভ্র বিড়াল। রমাদির কাছে বন্ধু খোকন ছিলেন কলিজার টুকরা সন্তানের মতো। ৭১-এ সন্তানহারা টুনুকে খুঁজে পেয়েছিলেন খোকনের মধ্যে। সে রমা চৌধুরীকে দিদি বলে ডাকত। রমাদিকে স্নান করানো থেকে শুরু করে রান্না করে খাওয়ানো, কাপড়চোপড় কাচা, পরিধান করানো, বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নিয়ে যাওয়া—সবকিছুই সে করত। খোকন ছিল অনেকটা রমাদির জীবন্ত লাঠির মতো। যার ওপর ভর করে শহীদ জননী জীবনের ২৪টি বছর হেঁটে গেছেন। দুজনের মধ্যে বেশ মিল ছিল। দুজনই প্রিয়জন হারিয়েছেন। জীবন থলেতে দুঃখভর্তি ছিল। বই পঠন-পাঠন করতেন। খোকনের মাধুকরী নামের একটি প্রকাশনাও ছিল।

আলাউদ্দিন খোকনের জন্মস্থান বরিশাল জেলায় কীর্তনখোলা নদীর পাড়ে। ছোটবেলায় সে চট্টগ্রামে চলে আসে। তার হাত ধরে আমি প্রথম আলো বন্ধুসভায় যোগ দিই। বন্ধুসভা আমার কাছে ভালোবাসার সাম্পানের মতো। যার মাঝি ছিল খোকন। সে চট্টগ্রাম বন্ধুসভার সভাপতি থাকাকালে বেশ ভালো কিছু কাজ হয়েছিল। সে সময় সারা বাংলাদেশে চট্টগ্রাম বন্ধুসভা ছিল অন্যদের জন্য আদর্শ।

ভালো কাজ, লেখালেখি, নিষ্পেষিত মানুষের প্রতি ভালোবাসার হাত বাড়িয়ে দেওয়াসহ মহৎ কাজ করার জন্য পরামর্শ দিত খোকন। তাঁর সঙ্গে সুখ-দুঃখ শেয়ার করতাম। আমাদের আড্ডা ছিল বিপ্লবী উদ্যান, জাতিসংঘ পার্ক, চেরাগী পাহাড় মোড়, বাতিঘর, প্রথম আলো অফিস, লুসাই ভবনসহ নানা জায়গায়। এ ছাড়া বন্ধুসভার সাহিত্য আড্ডা, মুক্তিযুদ্ধের গল্পশুনি, চড়ুইভাতি, নৌবিহার, অরণ্যবিহারসহ প্রথম আলোর নানা অনুষ্ঠানগুলোতে যাওয়া হতো নিয়মিত।

চট্টগ্রাম বন্ধুসভার নৌবিহারে আলাউদ্দিন খোকন (সাদা টি-শার্ট পরিহিত)
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

একদিন খোকনকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম তার মায়ের কথা। সে চোখের পানি মুছতে মুছতে বলল, রশীদ, আমার মা নেই। তাকে আমি জড়িয়ে ধরলাম। সে অঝোরে কাঁদতে লাগল।
খোকন নিজের কষ্ট কখনো শেয়ার করতে চাইত না। রমা চৌধুরীকে মায়ের মতো ভালোবাসত ও সম্মান করত। কখনো সন্তানের অভাব বোধ করতে দেয়নি। বইপোকা সংস্কৃতিকর্মী খোকনের মাথাভর্তি ঝাঁকড়ানো চুল ছিল। কিছুটা বাদামি, চোখ দুটো ছিল সরলতা, মায়ায় ভরা, গায়ের রং সদ্য শস্যখেত থেকে তুলে আনা কাঁচা হলুদের মতো। রহস্যময় নীল রঙের একটা লাল আভা লেগে থাকত চেহারায়। মন ছিল কীর্তনখোলা নদীর মতো দুর্বার গতিতে ছুটে চলা, কিছুটা বাউন্ডুলে স্বভাবের। ফতুয়া, পাঞ্জাবি অথবা টি–শার্ট ও জিনস পরিধান করে কাঁধে বইয়ের থলে ঝুলিয়ে ছুটে চলাই ছিল তাঁর জীবন। মাঝেমধ্যে দেখতাম রমাদিকে নিয়ে হেঁটে যাচ্ছে এই অফিস থেকে ওই অফিসে। বই ফেরি করে বেড়াত।

২০১৫ সালে আমার মেয়ে বর্ণের আকিকা অনুষ্ঠানে সবাইকে নিয়ে নেচেগেয়ে মাতিয়েছিল বন্ধু খোকন। চাকরি নিয়ে ঢাকায় চলে আসার পরও মাঝেমধ্যে মুঠোফোনে কথা হতো। তাঁর জীবনসঙ্গিনীসহ ২০২০ সালে অমর একুশের বইমেলায় গিয়েছিলাম। আমার বাসায় আড্ডা ও খাওয়াদাওয়া হয়েছিল। চলে যাওয়ার খুব তাড়া ছিল খোকনের। আমাকে বই উপহার দিল। অভিমান করে বলল, ‘কত বলেছি বাসায় আসতে, একদিনও এলে না রশীদ’। জবাবে জানালাম, ‘আসব বন্ধু’।

লেখকের মেয়ের আকিকা অনুষ্ঠানে আলাউদ্দিন খোকন (মাইক হাতে)
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

বেশ কিছুদিন পর হঠাৎ একদিন শুনি সে অসুস্থ। চিকিৎসার জন্য কবি রিমঝিম আহমেদ তাকে ভারতে নিয়ে গেল। ফিরে সুস্থ হয়ে। চট্টগ্রাম একাডেমিতে সর্বশেষ দেখা হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে কথা হলো গত ৩১ আগস্ট, আমার লেখা একটি বইয়ের নামকরণ নিয়ে। সে জানাল, রশীদ, আমি মেয়েকে নিতে ফুলকী স্কুলে এসেছি। বাসায় গিয়ে ফোন দেব।’ বিকেলে কথা হলো বই নিয়ে। চট্টগ্রাম বন্ধুসভার পুরোনো বন্ধুদের একত্রিত করে একটা পুনর্মিলন করার পরিকল্পনাও করেছিলাম। সর্বশেষ ১ সেপ্টেম্বর রাতে খুদে বার্তা দিয়ে বলল, ‘তোমার পোস্ট দেখেছি, তুমি আমাকে তোমার বই সম্পর্কে একটু আইডিয়া দাও।’

৩ সেপ্টেম্বর দিবাগত রাত ১২টায় জানতে পারি বন্ধু খোকন না ফেরার দেশে পাড়ি জমিয়েছে। কিছুক্ষণের জন্য বিশ্বাস হচ্ছিল না। রাহাতকে ফোন দিয়ে নিশ্চিত হলাম। গভীর রাতে বালিশে মুখ লুকিয়ে অঝোরে কান্না করলাম। শহীদ জননী রমাদির প্রয়াণদিবসে তাঁর চলে যাওয়া প্রকৃতির নিয়তি হয়তো। সৃষ্টিকর্তার প্রতি খুব অভিমান হলো। কেন এত তাড়াতাড়ি প্রিয় বন্ধুকে নিয়ে গেল! ছোট্ট শিশু তিতলি তার বাবা হারানোর শোক কীভাবে মেনে নেবে? যে বাবার বুকে সে ঘুমিয়েছে দিনের পর দিন। যে বাবার হাত ধরে স্কুলে আসা-যাওয়া করেছে। মেয়েরা হচ্ছে বাবাদের প্রাণ। খোকনের মেয়ে তিতলি তার বাবাকে হারিয়ে বাক্‌রুদ্ধ। রিমঝিম ভাবিকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা নেই। মানুষের জীবনটা বোধ হয় সমুদ্রের ঢেউয়ের জলরাশির মতো, শরতের ঝরে পড়া শিউলি ফুলের মতো।

বন্ধু, চট্টগ্রাম বন্ধুসভা