পানির বোতলটা নিয়ে প্রথমেই গাছটা দেখতে যায়। ফ্লোরে পড়ে আছে গাছটা। টব ভাঙা। চারদিকে মাটি ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।
সুখ নিবাসের চার তলার পশ্চিম ফ্ল্যাটের দখিনমুখী বেলকনিটা বেশ চওড়া। দুইজন মানুষের শুয়ে ঘুমানোর মতো জায়গা। নিধি সাবলেট থাকে, একা। বেলকনিতে প্রায় চব্বিশ ঘণ্টা বাতাস বইতে থাকে। কখনো আবার নীরব–নিথর। বেলকনিতে রাখা বেতের চেয়ারটায় বসে মানুষ দেখতে ভালো লাগে নিধির। সন্ধ্যার পর মানুষের আনাগোনা বাড়ে। অফিস থেকে ফিরে চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে সেখানে বসেই বিশ্রাম নেয়। অনেকবার ঘুমিয়েছেও সেখানে বসে। কিন্তু প্রায়শই জায়গাটা তার কাছে মরা মরা লাগে। কিছু যেন নেই একটা। দূরের বারান্দায় দেখা যায় কত লতানো গাছ ঝুলে আছে। ফুল ফুটছে, বাতাসে দুলছে।
বাসাটায় ওঠেছে বেশি দিন হয়নি। এখনো পুরোপুরি গুছিয়ে তুলতে পারেনি। রুমে রাখা পানির বোতলে বেশ কয়েকটা সবুজ গাছ আছে। সেগুলো প্রতিনিয়ত ডালপালা মেলে বড় হচ্ছে। এগুলোর জন্য তেমন বাড়তি খাটনি হয় না। মাস দুয়েক পরপর একবার পানি পাল্টালেই হয়। আর একটু যত্ন। গাছের যত্নে কোনো কার্পণ্য করে না সে। একবার সপ্তাহ দুয়েক বাড়িতে ছিল অসুস্থ হয়ে। দুইটা গাছ পানিশূন্য হয়ে মরে গেছে। সেই কষ্ট সে এখনো বয়ে বেড়ায়। এর পর থেকে আর নতুন কোনো গাছ আনেনি বাসায়। একটা ভয় কাজ করে। আবার যদি অসুস্থ হয়ে পড়ে। যদি কোন গাছ মরে যায়!
নিহালের সঙ্গে দেখা হয়েছে গত শুক্রবার, জন্মদিনে। উপহার হিসেবে তাকে একটা হাসনাহেনা গাছ ধরিয়ে দিয়েছে। ধরিয়ে দিয়েছে বললে ভুল হবে। বেচারা সেই মিরপুর থেকে বয়ে নিয়ে এসেছে গাছটা। তারপর একেবারে বাসা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে গেছে। মাঝারি আকারের একটা গাছ। সদ্য প্রস্ফুটিত কয়েকটা কলিও উঁকি দিচ্ছে একটা ডালে। দুয়েক দিনের মধ্যে ফুটবে। হাসনাহেনার ঠাঁই হয়েছে নিধির বারান্দায়। বেতের চেয়ারটার পাশেই। ফুলগুলো ফুটলেই ঘ্রাণে ম ম করবে চারপাশ। নিহাল ছেলেটাকে সে যেমন ভালোবাসে, তেমনি তার কাজকর্মও সে ভালোবাসে। গত জন্মদিনে তার জন্য ছাব্বিশটা চিঠি লিখেছে। নিজ হাতে খাম বানিয়েছে প্রত্যেকটার জন্য। বেলির সুঘ্রাণ ঢেলে দিয়েছিল প্রতিটা চিঠিতেই। সব করেছে নিজ হাতে।
শনিবার অফিস থেকে ফিরে বেলকনিতে বসতেই মনটা খারাপ হয়ে গেল নিধির। হাসনাহেনাগাছটা পুরোপুরি নেতিয়ে পড়েছে। মরমর অবস্থা। বাঁচার কোনো আশাই নেই। একটা ছবি তুলে ফেসবুকে কয়েকটা প্ল্যান্ট গ্রুপে দিয়ে গাছটাকে বাঁচানো যাবে কীভাবে তার জন্য পরামর্শ চেয়েছে। ‘গাছ ছায়ায় রাখুন, সারা গাছে পানি ছিটিয়ে দিন, রোদে রাখুন, আমাদের এখানে নিয়ে আসুন...’ এমন অনেক পরামর্শে কমেন্ট বক্স ভর্তি। কিন্তু সেগুলো কোনোটাই আশার আলো দেখাচ্ছে না। পরদিন আরও অবনতি হলো গাছটার। এবার আর বাঁচার আশা দেখা যাচ্ছে না। পাতাগুলো হলুদ হয়ে যাচ্ছে। গাছটাকে সে কোনোভাবেই মরতে দেবে না।
অফিস থেকে ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা। দেশের অবস্থা ভালো না। শিক্ষার্থীরা দাবি নিয়ে রাস্তায় নেমে এসেছে। তাদের ওপর সমানে লাঠিচার্জ করছে পুলিশ। এসব দেখে নিজেকে অসহায় লাগে খুব। আজ আকাশে আবার মেঘ করেছে। বাতাসে যেন উড়িয়ে নিয়ে যাবে। কোনোমতে বাসায় এসে পৌঁছাতে পেরেছে। বাসার ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে ঝুম বৃষ্টি। হাতমুখ ধুয়ে বেলকনিতে এসে দাঁড়ায়। তখনো বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টিতে হাসনাহেনা গাছটা গা ছাড়া দিয়ে আরও যেন বেশি নেতিয়ে পড়েছে। বৃষ্টির ফোঁটার ভার নিতে পারছে না পাতাগুলো। এ যে আর বাঁচার নয় সেটা বুঝে গেছে সে। রাস্তার যেসব দৃশ্য দেখে এসেছে তা মনে করে কান্না করতে ইচ্ছে করছে। অনেক দিন পর মনে পড়ছে মায়ের কথা। বছর তিনেক আগে হারিয়েছে তাকে। যদিও বাবা সে অভাব বুঝতে দেয়নি কখনো।
বিছানায় শুয়ে কখন যে ঘুমালো টের পায়নি। ঘুম ভেঙেছে একটা স্বপ্ন দেখে। ‘বেলকনি পুরোটা ছেয়ে গেছে হাসনাহেনা। শত শত লাল ফুল ফুটেছে। তীব্র ঘ্রাণে ভরে উঠেছে পুরো রুম। বাসার নিচেও অনেকে দাঁড়িয়ে সে ঘ্রাণ নিচ্ছে। নিধি বেলকনিতে দাঁড়িয়ে সেই দৃশ্য দেখছে।’ প্রথমে ভালো লাগলেও যখন লাল ফুলের কথাটা মাথায় এসেছে তখনই একটা হাঁসফাঁস শুরু হয়ে গেছে মনের ভেতর। এপাশ-ওপাশ করে আবার ঘুমিয়েছে অনেক কষ্টে। পরদিন সকালে অফিস যাওয়ার আগেও দেখে যে সূর্যের আলোয় পাতাগুলো যেন প্রাণ ফিরে পেয়েছে। বাতাসের সঙ্গে দোল খাচ্ছে। রাতে দেখা স্বপ্নটার কথা মনে পড়তেই মনের ভেতর মোচড় দিয়ে ওঠে।
চলমান আন্দোলন তখন আরও বেড়েছে। শিক্ষার্থীদের ওপর গুলি চলছে। আসার সময় রক্তে রাস্তা ভেসে যেতে দেখেছে। জুতা, টুপি, ইটপাটকেল ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে রাস্তায়। চোখ ভিজে এসেছে। সেদিন আর বাসায় ফেরার সাহস করেনি। অফিসের কাছেই এক বান্ধবীর বাসায় থেকে যায়। দুইদিন পর বাসায় ফিরে। পানির বোতলটা নিয়ে প্রথমেই গাছটা দেখতে যায়। ফ্লোরে পড়ে আছে গাছটা। টব ভাঙা। চারদিকে মাটি ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। একটা বুলেট দেয়ালে গাঁথা। গাছটা তখনো বেঁচে আছে।
মিরপুর ১০, ঢাকা