হামাগুড়ি

প্রতীকী ছবি। অলংকরণ: বাবুল হোসাইন সোহাগ

ডালিমগাছে সাতটা চড়ুই লাফাচ্ছে। সকাল সকালই এই লাফানো শুরু হয়। তাদের কিচিরমিচিরে ফুলজান বিবির ঘুম ভাঙে। দুধেল লাল গাইটাও দু–একবার হাম্বা হাম্বা করে ওঠে। ঘুম থেকে উঠেই ফুলজান বিবির প্রথম কাজ গরুর আথাল পরিষ্কার করা। গোবরগুলো একটি বাঁশের ওড়ায় জমিয়ে রাখা।

ফুলজান বিবির দুই বছরের নাতি উঠোনে হামাগুড়ি দিচ্ছে। দাদির দিকে এগোবার চেষ্টা করছে।

‘বউমা, পিতলের বালতিটা নিয়ে আসো তো। গাই দোয়াতে অইব।’ ছেলের বউ পিতলের বালতি নিয়ে এসে শাশুড়ির পাশে দাঁড়ায়।

ফুলজান গাই দোয়াতে শুরু করে। তার দুহাতের আঙুলের চাপে চিন চিন শব্দে গরুর ওলান থেকে দুধ বের হয়। দুধের ফেনায় বালতি ভরে ওঠে। মনে হয় চুলায় গরম দুধে বলক এসেছে।

ফুলজানের ছেলের বউ একটা গামছা গাইয়ের পিঠে আলতো করে নাড়াতে থাকে।

‘আম্মা, আর দোয়াইয়েন না। বাছুরে খাইব কী? বালতি তো ভইরা গেছে।’

ছেলের বউয়ের কথায় জবাব দেয়, ‘ঠিক আছে রে মা, আর দোয়ামু না।’

ওই সময়ই গরুর আথালের কাছে এসে দাঁড়ায় জাহানুর মিয়া। বলে, ‘সালামের মা, গাইয়ে দুধ দেয় কয় সের কইরা?’ বউ–শাশুড়ি ঘোমটা টেনে বলে, ‘চাইর সের কইরা চাচা মিয়া।’

‘তাই তো বলি, গরুর উলান এত ফুলা ক্যান? সালামের বউ, যাও দুধটা গরম কইরা আনো। দুই গ্লাস দুধ খাইয়া যাই।’

জাহানুর মিয়ার সঙ্গে আরেকজন আসছে। আমজাদ আলী। সারাক্ষণ তার সঙ্গে থাকে।

সালামের ছেলে এসেছে আথালের কাছে। সে জাহানুর মিয়ার লুঙ্গি ধরে টানাটানি করছে।

‘এ্যাই, এ্যাই। এই বজ্জাতটা আবার কে?’

ফুলজান বলল, ‘সালামের পোলা। আমার নাতি।’

‘হায়, হায়। কবে অইল তোমার নাতি। আমি তো টেরই পাইলাম না।’

ছেলের বউ দুলালী লজ্জা পায়। তবে কথা শুনে তার গা–টা যেন ফুলিয়ে ওঠে।

উঠোনে বেতের মোড়ায় বসেছে জাহানুর মিয়া আর তার সঙ্গী। সামনে একটা কাঠের টুল। দুলালী দুই গ্লাস দুধ নিয়ে টুলের ওপর রাখে।

জাহানুর মিয়া বলে, ‘সালামের মা, তোমার পুতের বউ বড়ই সৌন্দর্য।’

জাহানুর দুলালীর দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলে, ‘সোয়ামির কোনো খোঁজ পাইছ। কোথায় গেল তোমারে রাইখা। জানো কোথায় গেছে?’

‘জানি, মেলাঘর গেছে।’

‘মেলাঘর। হেইডা আবার কোথায়? তোমাগো বাড়িতে তো একটাই ঘর। লোকজন কম। মেলাঘর দিয়া কী অইব।’

ছেলেটা হামাগুড়ি দিচ্ছিল উঠোনজুড়ে। হঠাৎ এসে কাঠের টুলটা ধরতেই পিতলের গ্লাস দুটো কাত হয়ে পড়ে যায়। দুধ পড়ে যাওয়ার পর ছেলেটা খিলখিল করে হেসে ওঠে।

জাহানুর মিয়া মোড়া থেকে উঠে দাঁড়ায়। ‘কী বজ্জাত পোলা। বাপের মতো হারামজাদা হইব।’

ফুলজান বলে, ‘চাচা মিয়া, বসেন। আরও দুই গ্লাস দুধ নিয়া আসি।’

‘না, আমার দুধ খাইতে অইব না।’

জাহানুর দুলালীর দিকে তাকিয়ে বলে, ‘আমি আরেক দিন আইসা তোমার দুধ খাইয়া যামু।’

জাহানুর মিয়া চলে যাওয়ার পর ফুলজান বলেন, ‘জাউরা মেম্বর একটা।’

গভীর রাত। সালাম এসে দরোজায় ঠক ঠক করে। ফিস ফিস করে বলে, ‘দুলালী, দুলালী।’

দুলালী লাফিয়ে ওঠে ঘুম থেকে। ‘তুমি আইছো?’

আমারে শক্ত কইরা ধইরা দেহ আইছি কি না। দুলালী সালামকে জড়িয়ে ধরে ভ্যা ভ্যা করে কান্না শুরু করে দেয়। সালামের মা এসে পাশে দাঁড়ায়। সেও ছেলেকে জড়িয়ে ধরে।

‘মা খুব খিদা লাগছে। খাওয়ার কিছু আছে। এহনই চইলা যাইতে হইব।’

‘পান্তা ভাত আছে।’

‘পান্তা ভাতই দেও। তাড়াতাড়ি করো। জাহানুর মিয়ারা খবর পাইলে সর্বনাশ অইয়া যাইব।’

দুলালী জাহানুর মিয়ার আসার কথা গড়গড় করে বলে যায়।

‘আমারে কইলো, তুমি কোথায় গেছ? আমি কইলাম মেলাঘর। ঠিক কইছি না?’

সালাম সামান্য হেসে বলে, ‘তুমি একটা গাধা।’

দুলালীর মনটা খারাপ হয়ে যায়। সে বলে, ‘আমি গাধা। আর তুমি গরু।’

সালাম বউকে বলে, ‘গোপন কথা মানুষকে বলতে হয় না।’

মায়ের পাশে বসে পান্তা ভাত চাবাতে থাকে সালাম। পান্তা শেষ করেই সে দ্রুত ঘর থেকে বের হয়ে যায়।

ফুলজান আর দুলালী উঠোনের দিকে তাকিয়ে অঝোর ধারায় কাঁদতে থাকে।

ভোর হয়। চড়ুই পাখিরা ডালিমগাছে লাফালাফি শুরু করে। উঠোনে দাঁড়িয়ে জাহানুর মিয়া হাঁক দেয়। ‘এই সালামের মা, বাইরে আসো।’

ফুলজান ঘোমটা টেনে বাইরে এসে দাঁড়ায়।

‘এই, তোর পোলা কোথায়? কাইল রাইতে নাকি আসছিল। মেলাঘর কোথায় তাড়াতাড়ি ক।’

‘চাচা মিয়া, আমি জানি না।’

‘তোর বউকে ডাক।’

দুলালী এসে দাঁড়ায় দুয়ারে।

‘এই, তোর ভাতার মেলাঘর থাকে। মেলাঘর কোথায় তাড়াতাড়ি ক। না কইলে তোর ইজ্জত শ্যাষ কইরা দিমু।’

দুলালী বলে, ‘মেলাঘর বর্ডার পার হইয়া যাইতে অয়। ইন্ডিয়ায়।’

জাহানুর মিয়া হায়েনার মতো খেঁকিয়ে ওঠেন।

ফুলজানের দিকে এগিয়ে গিয়ে বলে, ‘সালামের বাবা কই? কই থাকে? মাস্টারি বাদ দিয়া আকাম কইরা বেড়াইতেছে। গেরামের সব জোয়ান পোলাগো ইন্ডিয়া পাঠাইতেছে। এই পোলাগো কি তুই জন্ম দিছস? আর ইন্ডিয়া কি তোর লাঙের বাড়ি?’

জাহানুর মিয়ার রাগ বাড়তে থাকে। তার সঙ্গী আমজাদকে বলে, ‘ওই গাই গরুর রশি খোল। নিয়া চল।’ আমজাদ আথাল থেকে দুধেল গাইয়ের রশি খুলে রাস্তার দিকে টানতে থাকে।

ফুলজান জাহানুরের পায়ে ধরে। বলে, ‘চাচা মিয়া, গাইটা নিয়েন না। এই গাইয়ের দুধ বেইচা আমাগো সংসার চলে। আমার নাতিটাও গাইয়ের দুধ খায়।’

জাহানুর মুখে বিশ্রী ভঙ্গি করে বলে, ‘ক্যান, দুলালীর বুকে দুধ নাই? গাইয়ের দুধ খাইতে অইব?’

গরুটা নিয়ে যায় মেম্বার।

পরের দিন শুক্রবার। দুপুর হয়েছে। আজান পড়ছে। বাড়ির পাশেই মসজিদ। মুয়াজ্জিনের ক্ষীণ কণ্ঠ ভেসে আসছে।

ওই সময়ই ১২ বছরের বোবা মেয়ে ফালানী দৌড়ে আসে। ফুলজানকে টানতে টানতে নিয়ে যায় গ্রামের পাশে। সেখানে আলেফ মাস্টারের নিথর দেহ পড়ে আছে। দুই হাত পিঠমোড়া করে বাঁধা। ফুলজান, দুলালী হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে। গ্রামের লোকজন ভয়ে দেখতেও আসছে না লাশ। সন্ধ্যার দিকে দুজন লোক এসে তার দাফন করে। আলেফ মাস্টার শিকারিপাড়া স্কুলের ধর্মের শিক্ষক ছিলেন।

রাজাকাররা সারা গ্রামে পাহারা বসিয়েছে, কোনো অপরিচিত লোকজন যাতে গ্রামে না ঢোকে। জাহানুর মেম্বারের নির্দেশ, সন্দেহ হলেই তাকে খুন করে ফেলতে হবে।

দুদিন বাদে আমজাদ মিয়া আসে সালামদের বাড়িতে। ফুলজানকে বলে, ‘চাচি, অসুবিধা হইছে না তো। অসুবিধা হইলে দুলালীরে মেম্বরের বাড়িতে পাঠাইয়া দেও। কামকাইজ করব। তাতে তোমাগো সংসার চইলা যাইব। মেম্বরই আমারে তোমার কাছে পাঠাইল।’

‘অমানুষ’ ফুলজান চিৎকার করেই বলে।

আমজাদ চলে যাচ্ছিল। আবার ফিরে আসে। ফোলা ব্যাগ থেকে একটি ছুরি বের করে। বলে, ‘চাচি শুনছি তোমার কাছে তিন ভরি স্বর্ণের গয়না আছে। তাড়াতাড়ি দেও। না অইলে তোমার বউমাকে আমি ক্যাম্পে পাঠাইয়া দিমু।’

ফুলজানের কথা বন্ধ হয়ে যায়। তাড়াতাড়ি ঘরের ভেতর থেকে স্বর্ণের গয়না নিয়ে আসে। আমজাদের হাতে তুলে দেয়। আমজাদ বলে, ‘মেম্বর জিগাইলে কইবা দুই ভরি সোনা দিছ, বুঝছো। এইডা নিয়া আবার আমাগো মইধ্যে লাগাইয়া দিয়ো না।’

দুলালীর ছেলেটা অকারণেই ছোট বারান্দায় বসে কাঁদছে। দুলালী সেদিকে বোবার মতো তাকিয়ে আছে। ফুলজানেরও কোনো দিকে ভ্রুক্ষেপ নাই।

রাত তখন ১১টা হবে। দরোজায় থাপড়াচ্ছে কেউ। দুলালী দরোজা খুলেই দেখে, সালাম দাঁড়িয়ে আছে। মুখে মিষ্টি হাসি। দুলালী ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে, ‘দোহাই লাগে তোমার, তুমি ঘরে ঢুকবা না।’ সালামের মা-ও এসে দাঁড়ায়। ‘বাবা, তুই তাড়াতাড়ি চইলা যা। দ্যাশের অবস্থা খারাপ। তোর বাবারে...।’

সালাম জোর করে ঘরে ঢুকে যায়। ঘুমের ছেলেটাকে কোলে তুলে নেয়। চাদরের ভেতর থেকে স্টেনগানটা বের করে। সারা রাত দুলালীকে অস্ত্র চালানো শেখায়। অস্ত্রের কোন অংশের কী নাম বুঝিয়ে বলে। কীভাবে গুলি করতে হয়, তা–ও দেখায়। ছোট ছেলেটাও হাঁ করে বাবার কথা শোনে। সেও যেন অস্ত্র চালনা শিখছে।

অনেক রাত। চোখে ঘুম আসে সালামের। সে অস্ত্রটা খাটের তলায় রেখে শুয়ে পড়ে। হঠাৎ হইচই পড়ে বাড়িতে। সালামদের বাড়ি ঘিরে ফেলে রাজাকাররা। শাবল দিয়ে দরোজা ভেঙে ফেলে সালামদের। সালাম ঘুম থেকে উঠে বসতে আমজাদ তার দিকে অস্ত্র তাক করে ধরে। আরেকজন গিয়ে তার দুই হাত বেঁধে ফেলে।

দুলালী খাটের নিচে ঢুকতে যাচ্ছিল, কিন্তু পারল না। আরেকজন তার চুলের মুঠি ধরে টেনে বার করল, ‘কী, খাটের নিচে লুকাইতে চাও কেন। চলো, এখন পাকিস্তানি আর্মিগো খাটের ওপরই থাকবা।’

দুলালী ও সালামকে ওরা ধরে নিয়ে যায়।

সকালবেলা সেই বোবা মেয়েটা ঠিক সেভাবেই দৌড়ে আসে। ফুলজানের হাত ধরে টানতে থাকে। তাকে দ্রুত টেনে নিয়ে যায় ছোট খালটিতে। সালাম বাবার মতো পড়ে আছে। সঙ্গে আরও কয়েকজন গ্রামের মানুষ। তাদেরকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে।

ফুলজান দৌড়ে আসে বাড়ি। হাতে তুলে নেয় স্টেনগান। সে ছুটে যায় আর্মি ক্যাম্পের দিকে। দুলালীকে যখন সালাম স্টেনগান চালানো শিখাইছিল, তখন সে চৌকিতে বসে সব খেয়াল করছিল।

ক্যাম্পের কাছে যেতেই সে গুলি ছুড়তে থাকে। সেখানে জাহানুর মিয়াও ছিল। দুজন পাকিস্তানির গায়ে গুলি লাগে। তারা লুটিয়ে পড়ে। জাহানুর মেম্বারের বুকেও গুলি লাগে।

আর্মিরাও গুলি ছুড়তে থাকে। কিছুক্ষণ পরই ফুলজান মাটিতে পড়ে যায়। গুলিতে তার বুক ঝাঁঝরা হয়ে গেছে। সে চিৎকার করে ওঠে, সালাম, সালাম। তার চোখে ভেসে ওঠে তাদের ঘরবাড়ি। সেসব আগুনে দাউ দাউ করে জ্বলছে। সে আগুন থেকে হামাগুড়ি দিয়ে বের হয়ে আসছে তার নাতি। তার মুখে হাসি। সে খিলখিল করে হাসছে।