স্বপ্নে ভরা বুক ও তারুণ্য
স্বপ্ন কী? রাতে ঘুমে যে ভাবনার ভুবনে বিচরণ, তার নাম কি স্বপ্ন? আর দিবাস্বপ্ন? দিনের বেলা কোনো নিরালা জায়গায় বসে কোনো তরুণ বা তরুণী যে কল্পনা করে, তাকে কি স্বপ্ন নামে ডাকা যায়? অথবা রাতে ঘুম না হলে, যদি কোনো পুরুষ বা নারী ভাবনার রাজ্যে ডুব দেয়, তাহলে ওই ভুবনটিকে কি স্বপ্নভুবন বলা যাবে? স্বপ্ন দেখে কারা? তরুণ-তরুণী? বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা কি স্বপ্ন দেখেন না? নাকি যৌবনে যাকে স্বপ্ন বলে, বার্ধক্যে তা চিন্তা অথবা দুশ্চিন্তা হয়ে যায়? চিন্তাও কি স্বপ্ন?
প্রিয় পাঠক, এতক্ষণ অনেক প্রশ্নের মধ্যে ডুবে ছিলাম আমরা। আসুন, এবার এই জিজ্ঞাসাগুলোর সমাধান খুঁজে বের করার চেষ্টা করি। ধরা যাক, কোনো তরুণ কবি লিখছেন, ‘তোমাকে বলা হয়নি/ কাল সারা রাত একটুকুও ঘুমুতে পারিনি/ জানালার গরাদে মাথা রেখে তাকিয়ে ছিলাম/ আকাশের জেগে-থাকা তারাটির দিকে।/ তোমাকে বলা হয়নি/ বাগানের গোলাপ গাছটি মারা গেছে/ কাঠফাটা রোদের খরায়।/ তোমাকে বলা হয়নি/ আমাদের স্বপ্নগুলো পালিয়ে গেছে/ সোনালি আঁশের দড়ি ছিঁড়ে।’ তখন কি কবির কলম স্বপ্নের ডানায় ভর দিয়ে ভেসে বেড়ায় অজানা কোনো কল্পনারাজ্যে? তখন কি কবি প্রচ্ছন্ন নিয়তি থেকে প্রকট বেলুন-বাতাসে প্রবেশ করলেন? তার ডান হাতে কলম আর বাম হাত ভাঁজ করে রেখেছেন চিবুকের তলায়? কিংবা কবির কলম থেকে একফলা হলুদ আগুন আচমকা বেরিয়ে, ঢুকে পড়ে অন্তরাত্মার ঘোর-অন্ধকার বারান্দায়? হয়তো-বা। তারপর? তারপর আগুনের তেজ স্তিমিত হলে বাড়তে থাকে কবির দহনজ্বালা। অবশ্য আগুনের আলোয় তিনি দেখতে পান যেন ঠিক নিজেকে। আর তিনি বোধ হয় তখন অনুভব করেন, তার কলম বেয়ে কবিতা ক্রমশ ব্যক্তিত্বের অন্দরে প্রবেশের ছাড়পত্র লাভ করেছে। নতমস্তক কবি তার কলম নিয়ে খেলতে থাকেন; আঙুলের ফাঁকে, অল্প অল্প লোমের স্পর্শ এড়িয়ে, শুদ্ধ-সরল-সুন্দর-স্বচ্ছন্দ ভঙ্গিতে, ঘুরতে থাকে কবির কলম। সম্ভবত এভাবেই কবিরা তারুণ্যের সব সম্ভাবনা ও আলো ছড়িয়ে দেন তাদের স্বপ্নময়তার ভেতর দিয়ে।
তারুণ্যের স্বপ্নে ভরা বুকে কি শুধুই স্বপ্ন? নাকি কষ্টও থাকে কিছু? হ্যাঁ, কষ্ট জমা হয়। স্বপ্নের বারান্দায় ভিড় করে যন্ত্রণার বহর। স্মৃতির ছাদে ঠায় দাঁড়িয়ে কবিকে আবার ডুব দিতে হয় স্বপ্নের রঙিন জগতে। কবিকে তখন লিখতে হয় বেদনার বিবরণ : ‘বাশিলার ঘাটে বাঁশঝাড়ের নিচে দাঁড়িয়ে স্থির চোখে তাকিয়ে-থাকা/ ডলি খালা-/ কত দিন হলো?/ হয়তো প্রায় পঁচিশ বছর; কিংবা তার সামান্য কিছু কম/ একবার বাপন চক্রবর্তীর কবিতায় পড়েছিলাম- ‘বনগাঁ লাইনে বেঁচে ওঠে/ চাঁপাবউদির শরীর’;/ আচ্ছা, ডলি খালা, তোমার শরীর কি সেদিন মৃত ছিল? অথবা অচল?/ আমারও ঠিক মনে পড়ে না/ কিংবা, রেলস্টেশনে ট্রেনের অপেক্ষায় তুমি গভীর চোখ আমার চোখে যখন/ মেলে ধরেছিলে/ তখন কি তোমার শরীর জেগে উঠেছিল গোপনে?/ সেসব কত দিন আগেকার কথা, মনে আছে, ডলি খালা?/ একদিন সন্ধ্যায় ইলেকট্রিসিটি অফ হলে তুমি ভয় পেয়েছিলে/ আঁকড়ে ধরেছিলে আমার শরীর/ আমার ভেতর তখন মরা বাঁশের বাঁশি ভেদ করে কালো মেঘের বৃষ্টি/ নেমেছিল- যত দূর মনে পড়ে;/ কেবল এইটুকু ভাবতে পারি।/ আজ এতকাল পর তোমাকে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করে-/ সত্যিই কি সেদিন ওই হঠাৎ নিঝুম অন্ধকারে ভয় পেয়েছিলে তুমি।’
স্বপ্ন আর ভয়। ভয় আর স্বপ্ন। কল্পনা আর অনিশ্চয়তা। অনিশ্চয়তা আর অপার ভাবনা। বোধ করি বুকভরা স্বপ্ন নিয়ে বাঁচতে হলে ভয় আর অনিশ্চয়তার সাথে বসবাস করতে হয় প্রতিনিয়ত। পাওয়া না-পাওয়ার আনন্দ আর যাতনাও থাকে বুকের গহিনে। কিন্তু এসব ইতিবাচকতা ও নেতিবাচকতা, আকর্ষণ ও বিকর্ষণ, আশা ও নিরাশার ভেলায় ভেসে ভেসে পার হয় যে জীবন, তাতে থাকে সুন্দর আর সাধনার আভিজাত্য। আর্ট অব লাইফ বলতে যা বোঝায়, স্বপ্নময়তা ছাড়া তা কী করে আশা করা চলে! জীবনকে সুন্দর করতে, আনন্দঘন করতে তরুণ-তরুণীর বুকভরা স্বপ্ন সব সময়ই সক্রিয় থাকে। পৃথিবীতে যা কিছু সুন্দর, যা কিছু আরাধ্য, তার সন্ধান মেলে অনাবিল স্বপ্নের হাত ধরে। আমরা সাধারণত বলে থাকি, আজকের তরুণরাই আগামী দিনের কর্ণধার। কিন্তু কীভাবে? এটা সচরাচর বলি না। ব্যাপার আসলে এই, তরুণ প্রজন্মের স্বপ্নের ভেতর দিয়েই তৈরি হয় কোনো সমাজের অনাগত সময়ের সব সম্ভাবনার সূত্র। আর ধীরে ধীরে সময়ের অমিত পরিক্রমায় এসব তরুণের স্বপ্নের বারান্দা দিয়ে সামনের প্রান্তরে প্রসারিত হতে থাকে সভ্যতার সব সত্য ও চাবিকাঠি। কাজেই স্বপ্নে ভরা তারুণ্য ও সমকালীন সমাজ আমাদের সবার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ। তবে স্বপ্ন বা কল্পনার সাথে পরিকল্পনারও সুন্দর সম্পর্ক ও সামঞ্জস্য থাকা চাই। যদি কেবল স্বপ্ন থাকে, পরিকল্পনা না থাকে, তাহলে কল্পনা সহজেই দিবাস্বপ্নে করুণ পরিণতি লাভ করতে পারে।
প্রসঙ্গত বিপ্লবী রাজনীতিবিদ ও কবি, এই প্রজন্মের তরুণের স্বপ্নপুরুষ, চে’ গুয়েভারা তার লেখা শেষ কবিতা ‘হাওয়া আর ঢেউয়ের উল্টোদিকে’র কথা মনে পড়ছে। কবিতাটি তিনি লিখেছিলেন তার শেষ অভিযাত্রার কালে। তার যে সময় ফুরিয়ে আসছে, এ কবিতায় সে ইঙ্গিত স্পষ্ট। কবিতাটির কথামালা তিনি সাজিয়েছিলেন তার কিউবান বংশোদ্ভূত দ্বিতীয় স্ত্রী আলেইদার উদ্দেশে। এ কবিতায় ধরা আছে তার জীবনের অন্তিম অভিপ্রায়। সেই কবিতা থেকে খানিকটা পাঠ নিতে পারি : ‘এই যে কবিতা, বইবে আমার স্বাক্ষর/ তোমাকে দিয়েছি ধ্বনিমুখরিত ছয়টি মাত্রা-/ একটি চাহনি যা বয়ে বেড়ায় (আহত পাখির মতন)/ কোমল বেদনা,/ কুসুমগরম অথৈ পানির একটু স্বস্তিহীনতা,/ একটি আঁধার দপ্তর যার আলোর উৎস/ মাত্র আমারই কবিতা/ তোমার অনেক একঘেয়ে রাতে জীর্ণ একটি/ আঙুলের আবরণ/ আমাদের যত ছেলেমেয়েদের একটি আলোকচিত্র/ আমার সঙ্গী পিস্তলটির অতি অপরূপা গুলি,/ সন্তানদের (সতত গোপন অথচ অতল) যুক্তিরহিত স্মৃতি/ যা কিনা একদা ধারণ করেছি আমরা,/ এবং আমার কাছে গচ্ছিত জীবনের কিছু শান্তি,/ সবই (সানন্দে আর অকাতরে) দিয়ে দিই বিপ্লবকে/ এমন তো কোনো শক্তি নেই যা/ মিলতে দেবে না আমাদের।’- এটা স্বপ্নেরই কোনো রূপান্তরের অভিব্যক্তি, না স্বপ্ন শেষের গল্প? তিনি কি নতুন কোনো স্বপ্নভুবন নিয়ে হাজির হতে চান তার প্রেয়সীর কাছে? নাকি সময়ের হাতে হারাতে বসেছেন জীবনের সব স্বপ্নময়তা? এই অনুভূতি কি একই সাথে স্বপ্নডানা ও স্বপ্নভাঙার গল্প?
বর্তমান সমাজের তরুণ-তরুণীরা কি স্বপ্নবান? কী স্বপ্ন দেখে তারা? সমাজ পরিবর্তনের, নাকি নিজের ভাগ্য বদলের। নাকি দেশ ছেড়ে অন্য দেশের নিশ্চিত ভুবনে পাড়ি জমানোর স্বপ্নে বিভোর তারা? চাকরি কিংবা সংসারের স্বপ্নও বোধ করি কিছুটা প্রভাবিত করে তরুণ-তরুণীকে। আর স্বাপ্নিক তরুণের বা তরুণীর বিষয়-আশয়কে কীভাবে দেখেন তাদের অভিভাবকেরা? তারা কি সন্তানদের স্বপ্ন দেখতে অনুপ্রাণিত করেন, নাকি তাদের দেখা স্বপ্ন বা কল্পনাকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেন? নিশ্চয় প্রাণময় তারুণ্য চায় আনুকূল্য ও সহযোগিতা। অগ্রগমনের পথে প্রয়োজন কিছু নির্দেশনাও। কাজেই, আমরা বুঝতে পারছি, অভিভাবকের পরামর্শ বা সঠিক দিকনির্দেশনা হয়তো কোনো তরুণের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে সহায়তা করতে পারে। আবার কারও অসহযোগিতা স্বপ্নে ভরা তরুণের বুকে হানতে পারে প্রবল আঘাত। অবশ্য কোনো কোনো তরুণ সব প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে তাদের স্বপ্নের ভুবনে গড়তে পারেন বাস্তবের পর্বত। তবে এই সংখ্যা বোধ করি খুব বেশি হবে না। আর এমনটা যারা পারেন না, তারা হয়তো ডুবে যান হতাশার অতল জগতে।
এক কিশোর (নাকি তরুণ) সম্বন্ধে সম্ভবত তার স্বপ্নে পরিভ্রমণ ও বাস্তবতার সাথে কিছু অমিলের বিষয়াদি নিয়ে, তারুণ্যের কবি আবুল হাসান লিখেছেন একটি চিন্তা-জাগানিয়া কবিতা। ‘ক্লান্ত কিশোর তোমাকে ভীষণ ক্লান্ত দেখায়’ কবিতায় তিনি বলছেন : ‘দুপুর ঘুরে কিশোর তুমি বিকেলবেলায়/ বাড়ি ফিরলে ক্লান্ত দেখায় ক্লান্ত দেখায়।/ ক্লান্ত মুখটি ক্লান্ত দেখায়, ক্লান্ত চোখটি ক্লান্ত দেখায়।/... কোথায় ঘোরো সারা দুপুর, ক্লান্ত কিশোর কোথায় ঘোরে?/ বুকের মধ্যে কিসের একটা কঠিন দুঃখ রুক্ষ দুপুর শাসন করে,...।’ তারুণ্যের দোরগোড়ায় দাঁড়ানো এই কিশোর কি স্বপ্নভাঙা বুক নিয়ে হতাশার গহিনে ডুবে গেছে? হয়তো-বা। এ রকম বহু তরুণকে তার স্বপ্নের ডালি নিয়ে সম্ভবত আমাদের অজান্তেই পাড়ি দিতে হয় স্বপ্নভাঙার অপার সমুদ্র!
তারুণ্য যদি স্বপ্নের প্রতীক হয় অথবা স্বপ্নের উৎপাদক ও লালনকারী, তাহলে সমাজের গতি ও অগ্রগতি নির্ধারণে আমাদের অবশ্যই বিষয়টিকে প্রথমত অনুধাবন করতে হবে। অতঃপর এর সম্ভাব্য সব প্রকাশে ও বিকাশে সহায়তার হাত ও মানসিকতা প্রসারিত রাখতে হবে। তবে চারপাশের অন্য সবাইকে এবং বিশেষত তরুণসমাজকে খেয়াল রাখতে হবে, সময়ের অগ্রসর কোনো প্রসঙ্গ কিংবা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রবল প্রবাহে যেন তাদের স্বপ্ন দুঃখ বা হতাশাকে আমন্ত্রণ না জানায়। স্বপ্ন বুকে ধারণ করে সাফল্যের সিঁড়ি সাবধানে পার হতে হলে সদা সতর্ক থাকতে হয়। কেবল কল্পনা নয়, কল্পনা ও পরিকল্পনার সমন্বয়েই তরুণেরা গড়ে তুলতে পারে সুন্দর ভবিষ্যৎ।