সেদিন বৃষ্টি ছিল

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

শহরজুড়ে লোডশেডিং,
হাতজোড়া মাথার নিচে, ইজিচেয়ারে বসে বুকের ওপর প্রিয় গিটার রেখে কিছু একটা ভাবছি।
আকাশে ঝলমলে চাঁদ ওঠায় শহরটা পুরোপুরি অন্ধকারে ডুবে যায়নি।
আমি কিছুক্ষণ চুপচাপ চোখ বন্ধ করে বসে,
অতঃপর উঠে ব্যালকনির গ্রিলে মাথা ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে চেয়ে থাকি।
সামনের রাস্তাটা মনে হচ্ছে সে–ও যেন আমারই মতো নিঃসঙ্গ।
কিছুটা দূরের পথে ল্যাম্পপোস্টের নিচে কুকুর অযথাই চেঁচাচ্ছে, কুকুরের চিৎকারে আমি বিরক্তি হয়ে তাকিয়ে আছি,
অদৃশ্য এক ছায়া যেন মৃদু বাতাসে, অনুভব করি নূপুরের আওয়াজ! এই আওয়াজে আমার মনে পড়ে গেল সেদিনের সে কথা যা, আজও মনের গহিনে নাড়া দিয়ে যায়,
সেদিন ছিল মেঘলা আকাশ, তার সাথে বৃষ্টির অঝোর ধারাপাত, চারিদিক পাতলা কুয়াশার আবর্তে ঢাকা।

প্রকৃতি যেন সবার অলক্ষ্যে কোনো গোপন অভিসারে ব্যস্ত, সেদিন অঝোর বৃষ্টিপাতে কলাপাতার ছাউনিতে
হাঁসের ছানার পিছু ছুটতে দেখি, এক মানবী বৃষ্টির ঝুমঝুম শব্দ আর নূপুরের আওয়াজে বেখেয়ালি হয়ে ওঠে আমার মন, আমি অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে দেখলাম প্রকৃতি আর মানবীর রূপের ব্যবধান,
যেন প্রকৃতিও হেরে গেলে মানবীর রূপের কাছে,
আমি দূর হতেই দেখলাম মানবীকে,
নিমেষেই প্রেমে পড়ে গেল এই উচাটন হৃদয়,
মনের গভীরে শুরু হলো অচেনাকে নিয়ে স্বপ্ন বোনা,
সেই হতে কত রাত কাটিয়ে দিয়েছি ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে শুধু অপেক্ষা, কখন নামবে বৃষ্টি।

আবার দেখি সেই মানবীকে,
কিন্তু সময় ফুরায় অপেক্ষা নয়।
বৃষ্টি আমার ভীষণ ভালো লাগে বলেই
মাঝে মাঝে অকারণে হারিয়ে যাই বৃষ্টির গানে,
বৃষ্টিঝরা রাতে আমি চোখজোড়া বন্ধ করে দাঁড়িয়ে আছি
হঠাৎ শুনতে পাই সেই নূপুরের শব্দ ভাবলাম বৃষ্টির গান,
তাই ভেবে চোখ বুজেই অনুভবে হারিয়ে গেলাম নিজের মাঝে,
হঠাৎ মনে হলো কেউ একজন আমার পাশে দাঁড়িয়ে আমায় স্পর্শ করছে!
চোখ মেলে দেখি সেই মানবী আমার সম্মুখে দাঁড়িয়ে আছে,
নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারিনি বলে
নিজের গায়ে নিজেই চিমটি কেটে নিই,
দূরের সেই ল্যাম্পলাইটের নিবুনিবু আলোতে দেখতে পাই মায়াবিনীর মায়াবী মুখচ্ছবি,
মায়াভরা কাজল কালো হরিণী চোখের পাপড়িগুলোতে বৃষ্টির ফোঁটা টপ টপ ঝরছে, গোলাপি রঙের বাঁকা ঠোঁট দুটিতে গড়িয়ে পড়ছে তৃষ্ণার্ত জল, অর্ধ কপালজুড়ে একমুষ্টি চুল বেয়ে গাল ঢেকে দিয়েছে,
ভেজা শরীরে যে নারীদের রূপ দ্বিগুণ করে,
আমার সেদিনই বিশ্বাস হলো।

আকাশে সজোরে বিদ্যুৎ চমকাতেই বালিকা চিৎকার করে আমায় জড়িয়ে ধরল!
মুহূর্তেই আমার শরীর পাথরের মূর্তিতে পরিণত হয়ে ওঠে,
তার মুলায়েম শরীরের গরম স্পর্শে আমার রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যাচ্ছে,
যেন সমস্ত পৃথিবীর সুখ আমার পায়ের কাছে ধুল খাচ্ছে। মন বলছে চিৎকার করে সমস্ত পৃথিবীটাকে জানিয়ে দিই আমি কতটা সুখী!
কিছুটা সময় অতিবাহিত হতেই দেখি আমার বাহুবন্ধন হতে বালিকা নিজেকে মুক্ত করে হারিয়ে যাচ্ছে,
আমি ডাকতেই আধো আধো চোখে এক পলক তাকিয়ে
নিমেষে অন্ধকারে হারিয়ে গেল,
মেঘাছন্ন রাতে আমি একা দাঁড়িয়ে রই,
এক গাল হেসে চোখ দুটি বন্ধ করে হাত দুটি পাখির ডানার মতো মেলে দিলাম আকাশ পানে।

সমুদ্রের ডাকে আমার ঘুম ভেঙে যায়, সমুদ্র বলল আমি কফি নিয়ে আসতেই তুই ঘুমিয়ে পড়লি, আমি কোনো কথা না বলে প্রকৃতির পানে তাকিয়ে রইলাম।
নীরব কষ্টে বুকের ভেতরটা খাঁ খাঁ করছে,
মনে মনে কী যেন এক অপেক্ষা, নেশা জাগা দুটি চোখ
মনে হয় কতকাল ঘুমহীন শুধুই অপেক্ষা
মনে হচ্ছে এই অপেক্ষা যেন আজন্মকালের
সমুদ্র কফির কাপ এগিয়ে দিয়ে বলল কিরে গিটারে নতুন গানটা তুলেছিস?
জয় কফিতে চুমুক দিয়ে বলল না, তবে একটা গল্প লিখেছি, গল্পের নাম সেদিনও বৃষ্টি ছিল,
সমুদ্র বলল সেই মেয়ের ভূত এখনো তোর মাথা হতে যায়নি?
আচ্ছা গানটা ধর
আর জয় গিটারে সুর তুলল।
আকাশের মন ভালো নেই
বৃষ্টি ঝরে অঝোরে,
আমিও নেই ভালো নেই
তোমাকে মনে পড়ে।
--------- সমাপ্ত --------